শ্যাম্পু নিয়ে যত কথা

কয়েক দিন চুল পরিষ্কার না করলে কিছুটা তৈলাক্ত হয়ে যায়। চুলে শ্যাম্পু ব্যবহার করলে আবার ঝলমলে ও মসৃণ হয়। শ্যাম্পুতে কী থাকে যাতে চুলের তৈলাক্তভাব কেটে যায়? চুলে শ্যাম্পু দিলে কেন ফেনা হয়? জেনে নিন শ্যাম্পুর ভেতরের যত রাসায়নিক কর্মযজ্ঞ...

নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, চুল কয়েক দিন পরিষ্কার না করলে কিছুটা তৈলাক্ত হয়ে যায়। এর কারণ, স্ক্যাল্প বা মাথার খুলির ত্বক থেকে একধরনের প্রাকৃতিক তেল উৎপন্ন হয়। এটিকে সেবাম বলে। সেবামের এই স্তর না থাকলে আমাদের চুলে থাকা প্রোটিনগুলো সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তবে কয়েক দিন চুল না ধুলে সেবামের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে চুল তেলতেলে ও ভারী হয়ে ওঠে। তখন শুধু পানি দিয়ে এই তেল সরানো যায় না, প্রয়োজন পড়ে শ্যাম্পুর।

সেবাম সহজে পানির সঙ্গে মিশতে চায় না। বিশেষ করে পানি যদি ঠান্ডা থাকে। কিন্তু পানির সঙ্গে শ্যাম্পু মেশালে সেবাম সরানো সহজ হয়। শ্যাম্পুতে একধরনের অণু থাকে, যেগুলোকে বলে সারফ্যাকট্যান্ট। এরা ফেনা তৈরি করে। এদের দুটি মেরু থাকে। হাইড্রোফোবিক (জলরোধী) ও হাইড্রোফিলিক (জলাকর্ষী)। ফলে এরা ওই তেলের সঙ্গে পানির মিশ্রণে সহায়তা করে। তাই শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করলে চুলে থাকা সব ময়লা ও তেল সহজেই চলে যায়।

আরও পড়ুন

ভিন্ন ধরনের চুলের জন্য ভিন্ন গুণাবলির শ্যাম্পু

চুল ঝলমলে ও মসৃণ করতে প্রায়ই অ্যান্টি–ফ্রিজ শ্যাম্পুতে সিলিকন যোগ করা হয়। (এই ফ্রিজ মানে জমাট বাঁধা নয়, অনিয়ত বা কুঁচকে-পেঁচিয়ে যাওয়া চুল; ইংরেজি Frizz) এই সিলিকন আর্দ্রতার বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে। শুষ্কতা থেকে মুক্ত রাখে। এমনকি স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে চুল ঝরঝরে রাখতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত সিলিকনযুক্ত শ্যাম্পু যে চুল বেশি সুন্দর করে, বিষয়টা মোটেও এমন নয়। কেননা, এটি চুল আরও ভারী করে তুলতে পারে। ফলে চুল ফেটে যেতে পারে। আবার যাঁরা খুশকির সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের জন্য আছে ভিন্ন ধরনের শ্যাম্পু। খুশকির জন্য যেসব মেডিকেল পণ্য পাওয়া যায়, সেগুলোর বেশির ভাগই চুলের জন্য ক্ষতিকর। তাই এ সমস্যার সমাধানের জন্য (ম্যালাসেজিয়া ইস্টকে চুল থেকে দূর করতে) যেসব শ্যাম্পুতে পাইরিথিওন জিংক আছে, সেগুলো ব্যবহার করতে হয়।

হেয়ারড্রেসাররা গ্রাহকের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের চুলে নানা রকম শ্যাম্পু ব্যবহার করেন।

আরও পড়ুন

যা যা থাকে শ্যাম্পুতে

সুগন্ধি (০.৩-০.৫%)

শ্যাম্পুতে সুগন্ধি যুক্ত করতে একাধিক উপাদান মেশানো হয়। এর মধ্যে আছে প্রাকৃতিক সুগন্ধি মেনথল বা কৃত্রিমভাবে তৈরি সুগন্ধির মতো নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এ ছাড়া আছে জুঁইয়ের গন্ধযুক্ত অ্যামিল সিনামাল।

সারফ্যাকট্যান্টস (১০-২০%)

এই উপাদানগুলো তেল ও পানিকে একসঙ্গে মেশায়। এরপর চুলে থাকা তেল ও ময়লাকে একত্র করে। এতে চুল ধুয়ে পরিষ্কারের সময় সেসব ময়লা দূর হয়ে যায়।

প্রিজারভেটিভ (১%)

প্রিজারভেটিভ বা সংরক্ষক উপাদানের মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম বেনজোয়েট, পটাশিয়াম সরবেট বা সরবিক অ্যাসিডের মতো বিভিন্ন রাসায়নিক। এগুলো শ্যাম্পুর বোতলের ভেতরে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে বাধা দেয়, শ্যাম্পু থাকে ব্যাকটেরিয়ামুক্ত।

কন্ডিশনার (২%)

চুলে প্রাকৃতিক তেল ও চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে গ্লিসারিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

জানেন কি? শ্যাম্পু প্রচলনের আগে ভেজিটেবল স্টার্চ ও কাঠ পোড়ানো ছাই ব্যবহৃত হতো চুল পরিষ্কারের জন্য।

ঘনকারী উপাদান (২%)

অ্যালকোহল, কার্নাউবা মোম ও জ্যান্থান গাম সাধারণত ঘনকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে। এরা শ্যাম্পুর বহতা ও ঘনত্ব রক্ষায় সাহায্য করে।

বাহক উপাদান (৭৫-৮০%)

শ্যাম্পুর বেশির ভাগই পানি। এটি শ্যাম্পুর অন্য উপাদান ও চুলের তেলকে একসঙ্গে যুক্ত করার মাধ্যমে উপাদানগুলোকে সক্রিয় হতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন

শ্যাম্পু ব্যবহারের সঠিক উপায়

চুল পরিষ্কারের সময় রাসায়নিক যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো দেখে নিন একনজরে

তৈলাক্ত পদার্থ উৎপাদন

মাথার ত্বকে সেবাম নামের তৈলাক্ত পদার্থ তৈরি হয়। সেবাম চুলকে শুষ্ক হওয়া থেকে রক্ষা করলেও ধুলাবালু টেনে নেয়।

তেল অপসারণ

শ্যাম্পু সারফ্যাকট্যান্টগুলোর একটি অংশ পানিতে দ্রবণীয় আরেকটি অংশ তেলে দ্রবণীয়। তেলে দ্রবণীয় অংশ চুলের তেল ও ময়লাকে ঘিরে আলাদা করে নেয় চুল থেকে। আর পানিতে দ্রবণীয় অংশ সেই ময়লাকে পানিতে ধুয়ে যেতে সাহায্য করে।

তরলীকরণ

পানি যখন সারফ্যাকট্যান্ট ও ময়লা ধুয়ে সরিয়ে নিতে থাকে, তখন কন্ডিশনারের অণুগুলো ও সেগুলোর ফ্যাটি অ্যাসিড আবরণের মধ্যকার বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে।

কন্ডিশনারের আবরণ

ফ্যাটি অ্যাসিড আবরণ থেকে মুক্ত কন্ডিশনার অণু ধনাত্মকভাবে চার্জিত। এরা পরিষ্কার চুলের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাই এ সময় কন্ডিশনার পুরো মাথার চুলে ছড়িয়ে পড়ে। এতে চুলে ফুটে ওঠে সতেজ ভাব।

অতিরিক্ত চুল ধোয়ার ফলে চুল শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। কেননা, তখন সেবাম গ্রন্থিগুলো ঘন ঘন তেল উৎপাদন করে চুলকে আরও তেলতেলে করে তোলে।

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন