লিটমাস পেপার। নামের সঙ্গে কাগজের একটা সম্পর্ক আছে। মূলত কাগজের তৈরি পাতলা স্ট্রিপের মতো হয়, রঞ্জক পদার্থ দিয়ে রঞ্জিত থাকে। এই রঞ্জক অ্যাসিড বা ক্ষারের প্রভাবে রং পরিবর্তন করে। কোন রং ধারণ করবে, তা নির্ভর করে অ্যাসিড বা ক্ষারের ঘনত্বের ওপর। অ্যাসিডযুক্ত দ্রবণে লিটমাস পেপার লাল রং ধারণ করে। আর ক্ষারযুক্ত দ্রবণের সংস্পর্শে নীল হয়ে যায়। নিরপেক্ষ দ্রবণে বেগুনি হয়।
লিটমাস পেপারের বিভিন্ন রঞ্জকের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো লাল লিটমাস। এটি ক্লোরোফিল থেকে পাওয়া যায়। আর নীল লিটমাস পাওয়া যায় ক্যারোটিনয়েড নামে একধরনের রাসায়নিক থেকে। এগুলোর পাশাপাশি হলুদ, কমলা ও সবুজ লিটমাস পেপারও পাওয়া যায়। তবে আমাদের দেশে লাল ও নীল লিটমাস পেপার বেশি প্রচলিত।
লিটমাস পেপারের ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রাচীন গ্রিসে অ্যারিস্টটল ও তাঁর ছাত্ররা লিটমাস পেপারের মতো একধরনের রঞ্জক ব্যবহার করে দ্রবণের অম্লতা ও ক্ষারতা পরীক্ষা করতেন। তবে এই রঞ্জকই যে লিটমাস পেপার, তা বলা যাবে না।
লিটমাস পেপারের আধুনিক ইতিহাসের সূচনা ১৩ শতাব্দীতে। এই সময়ে স্প্যানিশ চিকিৎসক আর্নাল্ডাস ডি ভিলা নোভা অ্যাসিড ও ক্ষার নিয়ে গবেষণার জন্য লিটমাসের ব্যবহার শুরু করেন। ১৬ শতকের পর থেকে নেদারল্যান্ডসে কিছু লাইকেন থেকে নীল রঞ্জক বের করা হতো। এই রঞ্জক পদার্থগুলো লিটমাস পেপার তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে ১৮ শতকে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, লিটমাস পেপারের রং অ্যাসিড বা ক্ষারের ঘনত্বের ওপর নির্ভর করে। এই আবিষ্কার লিটমাস পেপারকে আরও নির্ভরযোগ্য পরীক্ষণ-যন্ত্র করে তোলে। তবে অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী, লিটমাস পেপার প্রথম আবিষ্কার করেন আধুনিক রসায়নবিদ কার্ল উইলহেম শিল (Carl Wilhelm Scheele), ১৭৫৮ সালে। এই আবিষ্কারের পর তিনি ও তাঁর স্ত্রী মার্গারেটা শার্লোটা লিটমাসকে আরও উন্নত করে তোলার জন্য একসঙ্গে কাজ করেন দীর্ঘদিন।
রসায়নে লিটমাস পেপার দ্রবণের অম্লতা ও ক্ষারতা পরীক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। এটুকু আমাদের জানা। তা ছাড়া এটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রকৃতি নির্ধারণ করতেও ব্যবহৃত হয়।
পর্যায়ক্রমে বিজ্ঞানীরা নিজেদের প্রয়োজনানুসারে বিভিন্নভাবে লিটমাস পেপারের আরও উন্নয়ন করেছেন। সেই ধারাবাহিকতারই ফসল আজকের লিটমাস পেপার। এর মাধ্যমে আমরা সহজেই বলে দিতে পারি কোনো দ্রবণ অম্লীয় তথা অ্যাসিডিক, নাকি ক্ষারীয়।
লিটমাস পেপারের ব্যবহার সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কমবেশি প্রচলিত ধারণা বা আমরা মনে করি, লিটমাস পেপার শুধু রসায়নে ব্যবহৃত হয়। আসলে কিন্তু তা নয়। লিটমাস পেপার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটি রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়।
রসায়নে লিটমাস পেপার দ্রবণের অম্লতা ও ক্ষারতা পরীক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। এটুকু আমাদের জানা। তা ছাড়া এটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রকৃতি নির্ধারণ করতেও ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয় জীবন্ত কোষ ও টিস্যুর অম্লতা এবং ক্ষারতা পরীক্ষা করতে। জীবজগতের বিভিন্ন প্রক্রিয়া বোঝার জন্যও ব্যবহৃত হয় এটি। অপরদিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে লিটমাস পেপার রক্ত, প্রস্রাব ও অন্যান্য জৈব তরলের অম্লতা ও ক্ষারতা পরীক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য কাজে লাগে।
এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা এই লিটমাস পেপার ব্যবহার করি। তবে লিটমাস পেপারের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। লিটমাস পেপার অম্ল-ক্ষার নির্ধারণে সহায়তা করলেও এর ঘনত্বের, তথা অম্ল ও ক্ষারের সঠিক পরিমাপের হিসাব দিতে পারে না। এ জন্য আমাদের পিএইচ (pH) মিটারের সাহায্য নিতে হয়। সে যাহোক, লিটমাস পেপার যে যুগান্তকারী এক উদ্ভাবন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। শিশু-কিশোরদের হাতে-কলমে অম্ল-ক্ষার নির্ধারণ শেখা, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে আরও নানা ক্ষেত্রে এটি ভূমিকা রেখে চলেছে।