নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হরগোবিন্দ খোরানা

ব্রিটিশ ভারতের অধীনে পাঞ্জাবের ছোট্ট একটি গ্রাম রায়পুর। এই গ্রাম এতই ছোট যে তখনকার ভারতীয় ম্যাপে এর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেত না। মাত্র শ খানেক মানুষের বাস ছিল এই গ্রামে।

রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার বিজ্ঞান যে মূলত পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের সমন্বিত রূপ, তা এখন আমরা সবাই জানি। আমাদের জীবনের মূল সুর ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ডিএনএর কার্যকলাপ বিশদভাবে গবেষণা করা হয় বিজ্ঞানের যে শাখায়, তার নাম মলিকিউলার বায়োলজি বা আণবিক জীববিজ্ঞান। এই আণবিক জীববিজ্ঞানের অগ্রদূত ছিলেন আমাদের উপমহাদেশের সন্তান হরগোবিন্দ খোরানা।

জীবকোষের রসায়ন খুবই জটিল। প্রাণরসায়ন বা বায়োকেমিস্ট্রি বিজ্ঞানের আলাদা শাখা হিসেবে দ্রুত প্রসারিত হতে শুরু করেছে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে। কিন্তু তার মূলে যে রাসায়নিক জীববিজ্ঞান বা কেমিক্যাল বায়োলজি, সেই কেমিক্যাল বায়োলজির প্রধান স্থপতি ছিলেন হরগোবিন্দ খোরানা। তিনিই প্রথম ডিএনএর জেনেটিক কোড সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। এই আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলে গিয়েছে। এই আবিষ্কারের হাত ধরেই পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত হয়েছে অসংখ্য জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাপদ্ধতি, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া শনাক্তকরণ পদ্ধতি, বংশগতিবিদ্যা, জিনঘটিত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা এবং এ–সংক্রান্ত অসংখ্য কারিগরি পদ্ধতি—বায়োটেকনোলজি। ডিএনএর কোড ব্যাখ্যা করার সঠিক পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ১৯৬৮ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বিজ্ঞানী হরগোবিন্দ খোরানা, যাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে একটি প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত ছিল না, শৈশবে গাছতলায় বসে যাঁকে শিখতে হয়েছিল বর্ণমালা।

ব্রিটিশ ভারতের অধীনে পাঞ্জাবের ছোট্ট একটি গ্রাম রায়পুর। এই গ্রাম এতই ছোট যে তখনকার ভারতীয় ম্যাপে এর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেত না। মাত্র শ খানেক মানুষের বাস ছিল এই গ্রামে। গ্রামের সবাই নিরক্ষর কৃষিজীবী। শুধু একজন ছিলেন কিছুটা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন, সাধারণ যোগ-বিয়োগের হিসাব যিনি জানতেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রামের চাষিদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য জমি রেজিস্ট্রি করার কাজে নিয়োগ করেছিল। এই পেশার নাম ছিল পাটোয়ারি। খোরানা পদবির এই দরিদ্র পাটোয়ারির এক মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হরগোবিন্দ খোরানা। অক্ষরজ্ঞান ছিল বলে বলা চলে খোরানা পরিবারই ছিল সেই গ্রামের একমাত্র শিক্ষিত পরিবার।

গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। তবু হরগোবিন্দের বাবা চেয়েছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। লেখাপড়া না শিখে হালচাষ করে জীবিকানির্বাহ করা ভীষণ কষ্টের, তা তিনি প্রতিদিনই দেখছেন চাষিদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে গিয়ে। ইংরেজের রাজত্বে লেখাপড়া জানলে কেরানির চাকরি হলেও জুটবে। এই বিশ্বাসে তিনি নিজেই ছেলেমেয়েদের হাতেখড়ি দিলেন, অক্ষরজ্ঞান দিলেন গ্রামের এক গাছতলায় বসে নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

সেই সময় জন্মনিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়নি বলে সঠিক জন্মতারিখের কোনো হিসাব ছিল না হরগোবিন্দের। একটু বড় হতেই গ্রামের গাছতলার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল। সবচেয়ে কাছে যে হাইস্কুলটি আছে, সেটা মুলতান শহরে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে সেই স্কুল। কয়েক ঘণ্টার হাঁটাপথ, গরুর গাড়িতেও লাগে অনেকক্ষণ। দিনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা যায় পথে পথে। তবু লেখাপড়ার প্রতি আকর্ষণের কাছে পথের কষ্ট কিছুই নয়। মুলতান স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় জন্মতারিখের দরকার পড়ল। অনেক হিসাব করে জন্মতারিখ দেওয়া হলো ১৯২২ সালের ৯ জানুয়ারি। তখন থেকে এ তারিখই হরগোবিন্দ খোরানার জন্মতারিখ হিসেবে বিবেচিত হলো।

মুলতান স্কুলে কিছুটা হলেও শহুরে ভাব আছে। স্কুলের শিক্ষকেরা ভালো ছাত্রদের পেছনে প্রচুর সময় দেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক রতনলালের উৎসাহে বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করলেন হরগোবিন্দ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও তাঁর সমান আকর্ষণ। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে পড়ে ফেলেছেন জর্জ বার্নাড৴ শর রচনা। মনে মনে ইচ্ছা তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করার।

পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে খুব অস্বাভাবিক ভালো কোনো রেজাল্ট করেছিলেন, তা নয়। আর দশজন স্বাভাবিক ভালো ছাত্রের মতোই ছিল তাঁর রেজাল্ট।

উচ্চমাধ্যমিকের সমতুল্য ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যেতে হলো পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তির জন্য দুটি বিভাগে দরখাস্ত করেছিলেন হরগোবিন্দ খোরানা। তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল ইংরেজি সাহিত্য, দ্বিতীয় পছন্দ রসায়ন। কিন্তু ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হতে গেলে একটি ইন্টারভিউ দিতে হয়। শিক্ষকদের মুখোমুখি হয়ে মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে ভীষণ সংকোচ লাগছিল হরগোবিন্দের। তিনি মৌখিক পরীক্ষা দিতে গেলেন না। রসায়নে ভর্তির জন্য কোনো ভর্তি পরীক্ষার দরকার হয়নি বলে তিনি রসায়নেই ভর্তি হলেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করলেন ১৯৪৫ সালে।

পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে খুব অস্বাভাবিক ভালো কোনো রেজাল্ট করেছিলেন, তা নয়। আর দশজন স্বাভাবিক ভালো ছাত্রের মতোই ছিল তাঁর রেজাল্ট। তবে সেই সময় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা করার জন্য ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে খুব একটা প্রতিযোগিতা ছিল না। একটু ভালো রেজাল্ট করে আবেদন করলে ব্রিটিশ সরকারের বৃত্তি পাওয়া যেত। ভারতে তখন স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে। ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করার জন্য স্বদেশি আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা তখন খুব খারাপ। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সম্মানজনকভাবে বিদায় নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ভেতরে–ভেতরে। ইংরেজ বিদায় নেওয়ার পর ভারতীয়রা যেন ঠিকমতো দেশ গঠন করতে পারে, সে জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় ছাত্রদের জন্য বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের জন্য কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই বৃত্তি প্রকল্পের আওতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রশিক্ষণ লাভের বৃত্তির জন্য মনোনীত হলেন হরগোবিন্দ খোরানা। ঠিক হলো তাঁকে ইংল্যান্ডের ইনস্টিটিউট অব বার্কশায়ারে পাঠানো হবে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করে ভারতে ফিরে এসে কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য।

বৃত্তির চিঠি পেয়ে সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছালেন হরগোবিন্দ খোরানা। চিঠি নিয়ে লন্ডনের ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের অফিসে যাওয়ার পর জানতে পারলেন বার্কশায়ার ইনস্টিটিউটে তাঁর জন্য যে বৃত্তি ঠিক করা হয়েছিল, তা বাতিল হয়ে গেছে। তার বদলে তাঁকে অন্য একটি বৃত্তি দেওয়া হয়েছে, লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়নে পিএইচডি করার জন্য। হরগোবিন্দ খোরানা জানতেনই না যে তিনি জৈব রসায়নে পিএইচডি করবেন। অথচ এখান থেকেই শুরু হলো হরগোবিন্দ খোরানার গবেষণাজীবন।

১৯৪৯ সালের শুরুতে বৃত্তির শর্ত পূরণ করার জন্য তিনি ভারতে ফিরে এলেন। শর্ত ছিল, তিনি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ভারতে চাকরি করবেন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন ভারতে সে রকম কোনো চাকরি নেই।

লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সদ্য যোগ দেওয়া প্রফেসর রজার বিয়ারের অধীন পিএইচডি গবেষণা শুরু করলেন খোরানা। ইংরেজরা হরগোবিন্দ উচ্চারণ করতে পারে না বলে হরগোবিন্দ হয়ে গেলেন গোবিন্দ। অ্যালকালয়েড সিন্থেসিস বা ক্ষারক সংশ্লেষণ এবং মেলানিন–সম্পর্কিত গবেষণা করে ১৯৪৮ সালে পিএইচডি অর্জন করলেন খোরানা।

বৃত্তির শর্ত ছিল পিএইচডি শেষ করে তিনি নিজের দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু কোথায় নিজের দেশ? ১৯৪৫ সালে তাঁর গ্রাম রায়পুর থেকে তিনি এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সেই রায়পুর পড়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। খোরানার পরিবারের সবাই উদ্বাস্তু হয়ে দিল্লিতে উদ্বাস্তুশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর অনেক আত্মীয়স্বজন প্রাণ হারিয়েছেন দাঙ্গায়। এই অবস্থায় খোরানা কোথায় ফিরবেন? ধর্মের ভিত্তিতে যখন দেশ ভাগ হয়েছে, ফিরতে হলে খোরানাকে ভারতেই ফিরতে হবে। তাঁর জন্মভূমিতে তিনি আর ফিরতে পারবেন না, অন্তত এখন নয়।

ভারতে এখনই ফিরে না গিয়ে ইউরোপের জার্মান ভাষাভাষী কোনো দেশে পরবর্তী এক বছর পোস্ট–ডক্টরেট করার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি ভারত সরকারের কাছে চিঠি লিখলেন। ভারতে তখন দেশ গঠনের জন্য লোক দরকার। এই অবস্থায় পোস্ট–ডক্টরেট করার জন্য খরচ দেওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। খোরানার দরখাস্ত মঞ্জুর হলো না। কিন্তু তাতেও খোরানার সিদ্ধান্ত বদলাল না। তিনি সুইজারল্যান্ডের জুরিখে চলে গেলেন প্রফেসর ভ্লাদিমির প্রিলোগের অধীনে গবেষণা করার জন্য।

দেশভাগ ছাড়াও সেই সময় ভারতে ফিরে না আসার আরও একটি কারণ ছিল খোরানার। ১৯৪৭ সালে পিএইচডির ছাত্র হিসেবে খোরানা প্রাগে গিয়েছিলেন যুব ছাত্রদের ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার জন্য। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সুইস তরুণী এস্থার সিলভারের। পরিচয় থেকে ভালো লাগা, ক্রমে ভালোবাসা। এস্থারের কাছাকাছি থাকাটাও তাঁর জুরিখে থাকার অন্যতম কারণ।

সময়টা খোরানার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ কষ্টকর ছিল। কোনো ধরনের স্কলারশিপ ছাড়া, ভাতা ছাড়া তিনি ভ্লাদিমির প্রিলোগের ল্যাবে কাজ শুরু করলেন। প্রিলোগ তখন প্রতিষ্ঠিত রসায়নবিদ হলেও তাঁর হাতে তেমন কোনো ফান্ড ছিল না, যেটা দিয়ে খোরানাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়। খোরানা ১১ মাস ধরে ল্যাবেই ঘুমাতেন, খাদ্য ছিল ভাত আর রেশনের ফ্রি দুধ। এস্থার মাঝেমধ্যে কিছু খাবার দিয়ে যেতেন—এটুকুই।

এস্থারের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময়টুকু ছাড়া বাকি সবটুকু সময় খোরনার কাটত ল্যাব আর লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিতে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত গবেষণাপত্র পড়তে পড়তে অনেক পুরোনো একটা পেপার থেকে প্রায় অজানা একটি সিন্থেটিক রি–এজেন্ট কার্বোডিমাইট সম্পর্কে জানতে পারেন। পরবর্তী সময়ে এই কার্বোডিমাইট ব্যবহার করে তিনি প্রাণরসায়নে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন।

১৯৪৯ সালের শুরুতে বৃত্তির শর্ত পূরণ করার জন্য তিনি ভারতে ফিরে এলেন। শর্ত ছিল, তিনি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ভারতে চাকরি করবেন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন ভারতে সে রকম কোনো চাকরি নেই। লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর অমুসলিম শিক্ষকেরা সবাই ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে এসে এখন বেকার। খোরানাও তখন কার্যত উদ্বাস্তু। মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে। লিভারপুলের পিএইচডি, জুরিখের পোস্টডক নিয়ে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতাও জোটাতে পারছেন না তিনি।

খোরানার হতাশার কথা তিনি চিঠিতে লিখছেন তাঁর ইউরোপের পরিচিত শিক্ষক ও সহবিজ্ঞানীদের কাছে। প্রেমিকা এস্থার দিন গুনছেন জুরিখে। জুরিখে খোরানার পরিচয় হয়েছিল কেমব্রিজের অধ্যাপক কেনারের সঙ্গে। প্রফেসর কেনার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর আলেকজান্ডার টডের ল্যাবে একটি ফেলোশিপের বন্দোবস্ত করে দিলেন খোরানাকে। ১৯৪৯ সালের শেষে আবার ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেন খোরানা। যোগ দিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর টডের ল্যাবে। এই ল্যাবে শুরু হলো খোরানা, টড ও কেনারের যৌথ গবেষণা। প্রফেসর টড ১৯৫৭ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

খোরানা যখন কেমব্রিজে গবেষণা করছেন, তখন তাঁর ল্যাব পরিদর্শনে এসেছিলেন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রিসার্চ কাউন্সিলের হেড গর্ডন শ্রাম। তিনি একজন গবেষকের সন্ধান করছিলেন, যিনি ভ্যাঙ্কুভারে গিয়ে একটি গবেষণাগারের দায়িত্ব নিতে পারবেন। প্রফেসর টড খোরানার নাম প্রস্তাব করলে গর্ডন শ্রাম খোরানাকে ভ্যাঙ্কুভারে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ১৯৫২ সালে সেই গবেষণাগারের দায়িত্ব নিয়ে ভ্যাঙ্কুভারে চলে গেলেন খোরানা। যাওয়ার সময় এস্থারকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে গেলেন।

নতুন দেশে নতুন ল্যাবে নতুন সংসারের পাশাপাশি নতুন জীবন শুরু হলো খোরানার। পরবর্তী আট বছরে তিনটি সন্তানের মা–বাবা হন হরগোবিন্দ ও এস্থার। ২০০১ সালে এস্থারের মৃত্যু পর্যন্ত সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করেছিলেন তাঁরা।

দীর্ঘ গবেষণাজীবনে আড়াই শতাধিক গবেষকের সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিজ্ঞানী খোরানা।

১৯৫৪ সালে খোরানা কার্বোডিমাইট বিক্রিয়া ব্যবহার করে এডিপি ও এটিপির রাসায়নিক সংশ্লেষণ প্রকাশ করেন। খোরানার গবেষণা দ্রুত খ্যাতিলাভ করতে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহলে। ১৯৬০ সালে তিনি আমেরিকার উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব এনজাইম রিসার্চে যোগ দিলেন। এখানেই তিনি ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের যথাযথ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তিনি নিউক্লিওটাইডের রাসায়নিক উপাদানগুলো কীভাবে কাজ করে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ডিএনএর গাঠনিক উপাদানগুলোর মধ্যে ঠিক কোথায় প্রোটিন সংশ্লেষণ শুরু হয়, কোথায় গিয়ে শেষ হয়, তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হন তিনি। তাঁর এই গবেষণার জন্য ১৯৬৮ সালে তিনি রবার্ট হলি ও মার্শাল নিরেনবার্গের সঙ্গে যৌথভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।

এর পরবর্তী ৪৩ বছর ধরে ২০১১ সালের ৯ নভেম্বর মৃত্যুর আগপর্যন্ত খোরানা গবেষণা করেছেন আরও বিভিন্ন বিষয়ে।

১৯৭২ সালে খোরানা এমআইটিতে যোগ দেন। এরপর আজীবন তিনি সেখানেই ছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত পথ ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় কেমিক্যাল বায়োলজি বা রাসায়নিক জীববিজ্ঞান। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে জার্নাল অব মলিকিউলার বায়োলজি ৩১৩ পৃষ্ঠার পুরো সংখ্যাটির ১৫টি গবেষণাপত্রের সব কটিই ছিল হরগোবিন্দ খোরানার। আরএনএ সংশ্লেষণের গবেষণাসংক্রান্ত এই পেপারগুলো থেকে পরবর্তী সময়ে উদ্ভাবিত হয়েছে পিলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন বা পিসিআর পদ্ধতি (করোনাভাইরাস শনাক্ত করার নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি)। এর জন্য খোরানা আরেকটি নোবেল পুরস্কারের দাবিদার ছিলেন।

দীর্ঘ গবেষণাজীবনে আড়াই শতাধিক গবেষকের সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিজ্ঞানী খোরানা। গবেষণার চূড়ায় ওঠার পরও তিনি ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী। নিজেকে তিনি চিরদিনের গবেষণাছাত্র হিসেবেই পরিচয় দিতেন।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, বায়োমেডিকেল ফিজিকস বিভাগ, আরএমআইটি, মেলবোর্ন অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: টমাস সাকমার, প্রসিডিংস অব দ্য আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি (২০১৭), হরগোবিন্দ খোরানা, সায়েন্স (২০০০), nobelprize.org.