রসায়নের শত গল্প
হেনিং ব্রান্ডটের ‘পরশ পাথর’
প্রকৃতির সবখানেই রসায়ন। আমাদের দেহের কথাই বলি বা চারপাশ ঘিরে থাকা বাতাস, ফুলের ঘ্রাণ—সবকিছুতেই আছে রসায়ন। এর মূল কথাগুলো কি সহজে জানা সম্ভব? মহাবিশ্বের মতো বিপুল রসায়নের জগতের মূল বিষয়গুলো সহজ ভাষায় তুলে আনার সেই চেষ্টা করেছেন লেভ ভ্লাসভ ও দ্মিত্রিই ত্রিফোনভ। বাংলায় অনূদিত হয়েছে সরাসরি রুশ থেকে, রসায়নের শত গল্প নামে।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) মস্কোয় ছিল প্রগতি প্রকাশন। সেখান থেকে সরাসরি বাংলা অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। সেটা ১৯৭৮ সালের কথা। অনুবাদ করেন দ্বিজেন শর্মা। অঙ্গসজ্জা করেছেন লেওনিদ লাম। ক্লাসিক এই বই এতদিন পরও প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি প্রকাশিত হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে।
মধ্যযুগের কোনো এক পর্বে জার্মানির হামবুর্গ শহরে হেনিং ব্রান্ডট নামে এক বণিক বাস করতেন। ব্যবসাক্ষেত্রে তার মৌলিকত্ব সম্বন্ধে আমরা অবশ্য কিছুই জ্ঞাত নই, রসায়নে তার দখল সম্পর্কেও আমাদের কমই জানা আছে।
তাই বলে সে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেনি। কাজটি ছিল খুব সোজা—শুধু সর্ববিদিত সেই ‘পরশ পাথর’টি জোগাড় করা। কিমিয়াবিদদের (আলকেমিস্ট) মতে, তা দিয়ে খোয়া পাথরকেও স্বর্ণ বানিয়ে ফেলা যায়।
...বছরের পর বছর গেল। ক্ষীণ হয়ে এল ব্রান্ডটের স্মৃতি। বণিকদের কোনো আলোচনায় দৈবাৎ তার নাম উচ্চারিত হলে দুঃখের সঙ্গে তারা মাথা নাড়াত। ইতিমধ্যে হাজারো রকমের খনিজ ও মিশ্র দ্রব্য গলিয়ে, মিশিয়ে, ছেঁকে, তাতিয়ে তার হাত দুটি অ্যাসিড আর ক্ষারের দুরারোগ্য দাগে ভরে উঠেছে।
এভাবে নেহাৎ ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত হলো ফসফরাস। নামটি গ্রিক শব্দজাত, অর্থ ‘আলোর ধারী’ বা ‘আলোবাহী’। বহু ভাস্বর যৌগেরই প্রধান উপাদান ফসফরাস।
এক শুভ সন্ধ্যায় বণিকের ভাগ্য হঠাৎ প্রসন্ন হলো। তার বকযন্ত্রের তলায় তুষারসাদা একটি বস্তু জমে উঠল। বস্তুটি দ্রুত দাহ্য, এর ঘন ধোঁয়া শ্বাসরোধী। আর সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল অন্ধকারে এর উজ্জ্বলতা। এই শীতল আলোয় ব্রান্ডট অক্লেশে তার কিমিয়াবিদ্যার নিবন্ধাবলী (আলকেমি শাস্ত্রবিদ্যা) পড়তে পারত (ততদিনে এগুলো তার ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠিপত্র ও রসিদের স্থলবর্তী হয়েছে)।
...এভাবে নেহাৎ ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত হলো ফসফরাস। নামটি গ্রিক শব্দজাত, অর্থ ‘আলোর ধারী’ বা ‘আলোবাহী’। বহু ভাস্বর যৌগেরই প্রধান উপাদান ফসফরাস। আপনাদের কি সেই বিখ্যাত বাস্কারভিল কুকুরটির কথা মনে আছে? শার্লক হোমস যার সামনে অনেক দিন পড়েছিলেন? ওর মুখে ফসফরাস মাখা ছিল।
পর্যায় সারণির অন্য কোনো প্রতিনিধিই এমন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়।
ফসফরাসের মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মের সংখ্যা বহু।
ফসফরাস যেকোনো জীবেরই দেহসংস্থার অন্যতম জরুরি ‘ইষ্টক’স্বরূপ। আদতে, অস্থিকলার মূল উপকরণ ক্যালসিয়াম ফসফেট। সাদা ফসফরাসের ওপর সব সময়ই ফসফরাস বাষ্পের মেঘ জমে থাকে।
বিখ্যাত জার্মান রসায়নবিদ মলেশট একদা বলেছিলেন: ‘ফসফরাস ছাড়া মনন অসম্ভব।’ কথাটি সত্যি। আমাদের গুরু মস্তিষ্কের কোষকলা বহু জটিল ফসফরাস যৌগে বোঝাই।
আর ফসফরাস ছাড়া প্রাণের অস্তিত্বই তো অসম্ভব। একে বাদ দিলে শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়া অচল হয়ে পড়বে, পেশীতে কোনো শক্তিই জমা থাকবে না। আর শেষে বলা উচিত, ফসফরাস যেকোনো জীবেরই দেহসংস্থার অন্যতম জরুরি ‘ইষ্টক’স্বরূপ। আদতে, অস্থিকলার মূল উপকরণ ক্যালসিয়াম ফসফেট।
তাহলে দেখুন, এ কি ‘পরশ পাথর’-এর চেয়ে কিছু কম হলো? এতে জড় পদার্থে জীবন সঞ্চারিত হয়।
কিন্তু ফসফরাস ভাস্বর কেন?
সাদা ফসফরাসের ওপর সব সময়ই ফসফরাস বাষ্পের মেঘ জমে থাকে। বাষ্পটি জারিত হয় ও প্রভূত শক্তি উৎকীর্ণ (বা নিঃসরিত) করে। এই শক্তিই ফসফরাস পরমাণুকে উত্তেজিত করে, আর তাই আলোর ঝলকানি।