বুড়ো হলে মানুষের চুল পাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই নিয়ম একটু দ্রুতই কাজ করে। বুড়ো না হতেই চুল সাদা হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৩০ বছরের পর থেকে গড়ে প্রতি এক যুগে চুল পাকার সম্ভাবনা ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ে। আর ৬১ থেকে ৬৫-এর মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ মানুষের চুল পেকে সাধা হয়ে যায়।
পশ্চিমারা আবার ইংরেজিতে বলেন ‘গ্রে হেয়ার’। বাংলা করলে মনে হয় ধূসর। কিন্তু আমরা তো চোখের দেখায় জানি, পাকা চুল আসলে সাদাই হয়। প্রশ্ন হলো, কেন? চুল পাকলে কেন সাদা হয়ে যায়?
চুল, ত্বক ও চোখের রং কেমন হবে, তা নির্ধারণে একটি কণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর নাম মেলানিন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্যানুসারে, চুলে দুই ধরনের মেলানিন থাকে সাধারণত। ইউমেলানিন—সাধারণত কালো, বাদামী ও রূপালি চুলে থাকে। আর ফিওমেলানিন—সাধারণত লাল চুলে থাকে।
মেলানোসাইটিস নামে একধরনের কোষ আছে। চুলের মেলানিন উৎপাদিত হয় এ কোষের ভেতরে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিমিংহামের ইউনিভার্সিটি অব আলবামার এক গবেষণাসূত্রে জানা যায়, এই কোষ থাকে চুলের গোড়ায়। চুলের যে অংশ বাইরে বেরিয়ে থাকে, মেলানোসাইটিস ওর ভেতরে এই মেলানিন ঢুকিয়ে দেয়। সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট রঙের চুল বেরিয়ে আসে এই গোড়া বা হেয়ার ফলিকল থেকে।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চুলের গোড়ায় মেলানোসাইটিস কোষের সংখ্যা কমে যায়। ফলে কমে যায় মেলানিনের পরিমাণ। আর মেলানিন যত কমে, চুল তত সাদা হতে থাকে।
মূল ঘটনার এখানেই শেষ। তবে বিজ্ঞানীরা আরও জানতে চান। জানতে চান, কেন কমে যায় মেলানোসাইটিস কোষের সংখ্যা। জানতে হলে গবেষণা করতে হবে। বিজ্ঞানীরা তা করেছেন।
মানুষের দেহে অল্প কিছু কোষ থাকে, ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় স্টেম সেল। এই স্টেম কোষের বিশেষত্ব হলো, এরা যেকোনো কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। মেলানোসাইটিস কোষ জন্ম নেয় বিশেষ ধরনের মেলানোসাইট স্টেম কোষ থেকে। বিজ্ঞানীদের দীর্ঘদিনের ধারণা ছিল, এই কোষগুলো বারবার বিভাজিত হয়ে একইরকম আরও মেলানোসাইট স্টেম কোষের জন্ম দেয়। আর মাঝে মাঝে কিছু মেলানোসাইট স্টেম কোষ চুলের গোড়ায় নেমে আসে, পরিণত হয় মেলানোসাইটে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিন এবং এনওয়াইইউ ল্যাংগোর হেলথের সূত্রে এ তথ্য জানা যাচ্ছে।
চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল নেচার-এ ইঁদুরের দেহে মেলানোসাইট স্টেম কোষের আচরণ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। দুবছর ধরে ইঁদুরের দেহে মেলানোসাইট স্টেম কোষের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছেন এই গবেষকরা। এ গবেষণার সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই কোষগুলো চুলের গোড়ায় ওপরে বা নিচে স্থানান্তরিত হতে পারে। তবে বয়স হয়ে গেলে কোষগুলোর স্থানান্তর কমে যায়। তখন চুলের গোড়ায় থাকা বেশিরভাগ মেলানোসাইট কোষ ওখানেই আটকে যায়। গোড়া থেকে সরে এসে নিজেরা বিভাজিত যেমন হয় না, তেমনি অন্য মেলানোসাইট স্টেম কোষকেও এখানে এসে মেলানোসাইট কোষে পরিণত হতে বাধা দেয়। তাই মেলানোসাইট কোষ তৈরি হওয়ার পরিমাণ কমে যায়। ফলে কমে যায় মেলানিন উৎপাদন।
আর কোনো স্টেম কোষের এরকম ওঠা-নামা করার কথা বিজ্ঞানীদের জানা নেই। তবে এ গবেষণার ফলে এই কোষগুলোর আচরণ যেমন জানা গেছে, তেমনি এ থেকে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেও কাজ করা যাবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, নেচার, উইকিপিডিয়া