প্রকৃতিতে পাওয়া সবচেয়ে কঠিন ও দামী বস্তুর নাম হীরা। ইংরেজিতে বলে ডায়মন্ড। এই বস্তুটির চাহিদা ব্যাপক হলেও পৃথিবীতে কম পাওয়া যায়। হীরা উজ্জ্বল ও শক্ত পদার্থ। প্রচণ্ড তাপ ও চাপেও নষ্ট হয় না। আবার অন্য কোনো বস্তু দিয়ে হীরার ওপর আঁচড় কাটা যায় না। এসব অতুলনীয় গুণের কারণে এ রত্ন সবার কাছেই লোভনীয়। মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে হীরা নিয়ে কিছু মজার কথা বলে নিই।
গ্রিক শব্দ Adamas থেকে ইংরেজি ডায়মন্ড (Diamond) শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ অভঙ্গুর, অপরিবর্তনীয়। গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল, হীরা হলো ঈশ্বরের অশ্রু। অন্যদিকে রোমানদের বিশ্বাস ছিল হীরা যা তা বস্তু নয়, নক্ষত্রের খসে পড়া টুকরো। খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগে থেকে মানুষ হীরার খোঁজ জানত বলে জানা যায়। ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রে এর প্রমাণ রয়েছে। সে সময় ভারতের হায়দ্রাবাদ ছিল হীরার প্রধান উৎস। প্রাচীনকাল থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত ভারত থেকেই গ্রিস ও রোমসহ ইউরোপে হীরা রপ্তানি হতো। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপ ছিল হীরার অন্যতম উৎস। পরে দক্ষিণ আফ্রিকা, ঘানা, তানজানিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হীরার সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯ শতকে দক্ষিণ আফ্রিকাই হয়ে ওঠে হীরার প্রধান উৎস। বর্তমানে ২৫টি দেশে হীরার খনি আছে ।
হীরা নিয়ে অনেক গোয়েন্দা ও অ্যাডভেঞ্চার গল্প-উপন্যাস ছড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে। তবে বাস্তব ঘটনাও গল্প-উপন্যাসকে হার মানিয়েছে। হীরার কারণে খুনোখুনি বা রাজ্যদখলের ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। ভারতের মুঘল সম্রাটদের বিখ্যাত হীরা কোহিনুর পৃথিবীখ্যাত এক রত্ন। শুরুতে এর নাম ছিল মুঘল সম্রাট ‘বাবরের হীরা’। পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ দিল্লি দখলের পর এ মূল্যবান রত্ন তাঁর হাতে আসে। এ হীরার দ্যুতি দেখে তিনি বলে উঠেছিলেন, কোহ-ই-নুর (আলোর পাহাড়)। সেই থেকেই এ হীরার নাম কোহিনুর। এই হীরা নিয়েও আরও অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে নানা হাত ঘুরে এটি ব্রিটিশদের দখলে আসে। তারপর থেকে কোহিনুর ব্রিটেনে। ভারত-পাকিস্তান হীরাটা ফিরিয়ে আনার দাবি জানালেও লাভ হয়নি।
ফ্রেঞ্চ রাজপরিবারের বিখ্যাত সবুজ হীরা হোপ। আরেকটি বিখ্যাত হীরা কালিনান। এটিও ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পত্তি। থাই রাজপরিবারের সম্পত্তি বিখ্যাত গোল্ডেন জুবলি নামের হীরা। এ ছাড়া ভার্গাস, রিজেন্ট, সানসি, টিফানি, অরলভ, ড্রিসডেন গ্রিন নামকরা হীরা।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে এতসব হৈচৈয়ের জন্য দায়ী হীরা আসলে কার্বনের একটি রূপ। মজার বিষয় হলো, প্রচণ্ড চাপ ও তাপে কয়লা থেকে প্রাকৃতিকভাবে হীরা তৈরি হয়। আবার একইভাবে তৈরি হয় গ্রাফাইট, যেটি আমরা পেন্সিলে ব্যবহার করি। দুটোই কার্বনের বহুরূপিতার ফল। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মাটির প্রায় ১৫০ কিলোমিটার নীচে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৫০ কিলোবার চাপে বিশুদ্ধ কার্বন হীরায় রূপান্তিত হয়। পৃথিবীর টেকনোটিক প্লেটের নড়াচড়ায় মাটির গভীর থেকে হীরা ভূপৃষ্ঠের কাছে চলে আসে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
এই মূল প্রক্রিয়া উদ্ঘাটনের পর বিজ্ঞানরা কৃত্রিমভাবে হীরা তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এ পদ্ধতিতে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে গ্রাফাইটের ওপর প্রচণ্ড তাপ (২৫ হাজার সেলসিয়াস) ও চাপ প্রয়োগ করা হয়। এতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে লোহা। ঠান্ডা হওয়ার পর এই গলিত বস্তুতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃত্রিম হীরা থাকে, যা লোহা দিয়ে শক্তভাবে আবৃত থাকে। অ্যাসিড প্রয়োগে এই লোহা দ্রবীভূত করে হীরা মুক্ত করা হয়।