জীবনকোডে হাতেখড়ি

এই লেখাটি যাঁরা পড়ছেন, প্রায় তিন বছর আগের দুঃস্বপ্নের মতো সময়টির কথা তাঁদের নিশ্চয়ই খুব ভালোভাবেই মনে আছে। সময়টা কীভাবে কেটেছে, সেই স্মৃতি হয়তো অনেকেরই নেই। তবে এ কথা নিশ্চয়ই মনে আছে—দুঃস্বপ্নের মতো এক জীবন শুরু হয়েছিল আমাদের। বাসার বাইরে বেরোনোর উপায় নেই, কারো সঙ্গে গল্প করার উপায় নেই। পুরো পৃথিবী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। বিজ্ঞানে ঠিক আগ্রহী নয়, এরকম প্রায় সবাই বিজ্ঞানের ভেতরের জগৎটার কথা খানিকটা জেনেছেন সে সময়, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। করোনাভাইরাস আমাদের জীবনে হাজির হয়েছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে। সেই সময় বিজ্ঞানীরা টিকা বানানোর কাজ শুরু করেন। ইতিহাসে এত দ্রুত আর কোনো মহামারির টিকা আবিষ্কৃত হয়নি।

এই টিকা বানানোর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে জীববিজ্ঞানের সঙ্গে কম্পিউটারবিজ্ঞানের সমন্বয়। প্রোগ্রামিং বা কোডিং। এবং সিমুলেশন। একটা টিকা কাজ করবে কি না, সেটা জীবদেহের ওপর পরীক্ষা করার আগে কম্পিউটারে সিমুলেশন করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এই সিমুলেশন বানাতে হয়েছে প্রোগ্রামিং বা কোড করে। এর মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে কার্যকর টিকা আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশে বসে কি এ ধরনের বিশ্বমানের গবেষণা করা সম্ভব? সত্যি বলতে, সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনের সেল অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন হাসান উজ-জামান শ্যামল। তিনি বিজ্ঞানচিন্তায় ‘বাংলাদেশে কম্পিউটেশনাল বায়োলজি ঘরে বসে বিজ্ঞান গবেষণা?’ শিরোনামের একটি লেখায় লিখেছেন, ‘কিন্তু আজ, মানে পিএইচডির তিন বছর পেরোনোর পর আমার উত্তর খানিকটা ভিন্ন হবে। পয়সার অভাব আসলেই আছে বটে, কিন্তু সেটাই সব নয়; বরং দামি সাজসরঞ্জাম আর উন্নত ল্যাব ছাড়াও দেশে উঁচুমানের জীববিজ্ঞান গবেষণা করা সম্ভব। বিশেষ করে দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের অনেকে সেটা করছেনও।’

কম্পিউটার একটা বোকা যন্ত্র। এটি নিজে নিজে কিছু করতে পারে না। তাকে বলে দিতে হয়, ধাপে ধাপে সে একটা কাজ কীভাবে করবে।

কীভাবে সম্ভব এরকম গবেষণা? আগ্রহীরা সে প্রশ্নের উত্তরই শুধু নয়, হাতে-কলমে প্রাথমিক ধারণাও পেয়ে যাবেন বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৌমিত্র চক্রবর্তীর লেখা প্রোগ্রামিঙে জীবনপাঠ বইতে।

১৭৬ পৃষ্ঠার ছোট বই। পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে বইতে। এতে একাধারে জীববিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোর ধারণার পাশাপাশি উঠে এসেছে পাইথন প্রোগ্রামিংয়ের মূল বিষয়গুলো। শুধু তাই নয়, উদাহরণ ও হাতে-কলমে কোড করতে করতে বইয়ের শেষ দিকে পৌঁছে আগ্রহীরা বুঝতে পারবেন, গবেষণার মূল বিষয়গুলোও আয়ত্তে চলে এসেছে।

প্রথম অধ্যায়টির নাম ‘ভণিতা’। জীবনের বৈশিষ্ট্য, অভিব্যক্তি—অর্থাৎ জীবজগৎ কীভাবে ধীরে ধীরে বদলে যায়, কীভাবে পরিবর্তন হয়, এর পেছনের সম্ভাব্য কারণগুলো কী, এই পরিবর্তনের গাণিতিক মডেলটা কেমন হতে পারে, অধ্যায়ের শুরুতেই এসব বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তারপর শুরু প্রোগ্রামিংয়ের ধারণা। এ জন্য প্রথমেই বুঝতে হবে, অ্যালগরিদম জিনিসটা কী।

কম্পিউটার একটা বোকা যন্ত্র। এটি নিজে নিজে কিছু করতে পারে না। তাকে বলে দিতে হয়, ধাপে ধাপে সে একটা কাজ কীভাবে করবে। নির্দেশ দেওয়ার এই ধারাবাহিক উপায়কেই বলা হয় অ্যালগরিদম। এই অ্যালগরিদমের পাশাপাশি কম্পিউটারে পাইথন প্রোগ্রাম কীভাবে রান করতে হয়, এর মূল ধারণা ও ধাপে ধাপে কীভাবে করতে হবে, সে সব নিয়েই প্রথম অধ্যায়। পাইথন প্রোগ্রামের একটা বড় সুবিধা হলো, বিশ্বের বড় বড় প্রোগ্রামাররা একটা কাজ কীভাবে করতে হবে, তার কিছু টেমপ্লেট বা ছাঁচ বানিয়ে রেখেছেন। ধরুন, আপনি চা বানাবেন। এই চা-টা ধাপে ধাপে কেমন করে বানাতে হবে, কয় চামচ চা পাতার সঙ্গে কয় চামচ চিনি দিলে চায়ের স্বাদ কেমন হবে—তার একটা যৌক্তিক কাঠামো বানানোই আছে। সেই কাঠামোটা কোডে শুধু নিয়ে এলেই হয়। চা বানানোর আগেই আপনি কোড করে পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন, চা-টা কেমন হতে পারে। প্রোগ্রামিংয়ের ভাষায় এই গোছানো ছাঁচগুলোকে বলা হয় লাইব্রেরি। এ ধরনের লাইব্রেরি ইমপোর্ট করে, মানে কোডে নিয়ে এসে কীভাবে কাজ করতে হয়, তাও সহজে জানা যাবে এ অধ্যায়ে।

একনজরে

প্রোগ্রামিঙে জীবনপাঠ

সৌমিত্র চক্রবর্তী

প্রকাশক: অনুপম প্রকাশনী

প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ

প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০২৪

পৃষ্ঠা: ১৭৬

দাম: ৩৫০ টাকা

বইয়ের শুরুতে লেখক বলে দিয়েছেন, বইটা ক্রমান্বয়ে পড়তে হবে। ধাপে ধাপে কোডগুলো করে এগোতে হবে। এবং সবক্ষেত্রে লেখকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।

পরের অধ্যায়টিতে জীববিজ্ঞানের আরেকটু গভীরে ঢোকা। সঙ্গে গাণিতিক ধারণাগুলো পোক্ত করে নেওয়া। জীবের অস্তিত্ব, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রজনন, এর সঙ্গে একটি জীবের বংশবৃদ্ধির সম্পর্ক ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাবেন পাঠক এ অধ্যায়ে।

পরের অধ্যায়টি মিউটেশন নিয়ে। অর্থাৎ পরিবর্তন। কোডে ভুল হলে কম্পিউটার ভুল উত্তর দেয়। আর জীবের প্রজননের সময় ডিএনএ লেখার কাজে ভুল হলে পাল্টে যায় জীব। আসে তার নতুন ধরন। অনেক সময় জীব নিজেকে বদলাতে চায়। অনেক সময় পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে এটা ঘটে। করোনাভাইরাস যেমন নিজেকে বারবার বদলেছে। তাই বিভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাস দেখা গেছে বারেবারে। সেগুলোর জন্য বানাতে হয়েছে নতুন নতুন ধরনের টিকা। এই পরিবর্তনের বিষয়টা কোডে তুলে আনা, বংশবৃদ্ধি ও পরিবর্তনের হার ইত্যাদি নিয়ে এ অধ্যায়ের কোডগুলো।

প্রকৃতিতে টিকে থাকতে নিয়ত প্রতিযোগিতা করে জীবেরা। এই প্রতিযোগিতার ওপর নির্ভর করে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে বংশবৃদ্ধি ও পরিবর্তনের মাধ্যমে টিকে থাকে জীব। এই বিষয়গুলোর ওপর নির্ভর করে প্রকৃতিতে কোন জীব টিকবে, কোনটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এসব নিয়ে বইয়ের শেষ দুটি অধ্যায়।

বইয়ের শুরুতে লেখক বলে দিয়েছেন, বইটা ক্রমান্বয়ে পড়তে হবে। ধাপে ধাপে কোডগুলো করে এগোতে হবে। এবং সবক্ষেত্রে লেখকের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। বই শেষ করে কোনো পরীক্ষা দিতে হবে না। কোথাও কোড না করে শুধু পড়ে গেলে কেউ কিছু বলবে না। তবে তাতে ক্ষতি পাঠকের নিজেরই। এখানে একটুখানি বলে দেওয়া প্রয়োজন, বইটি পড়ার জন্য অন্তত অষ্টম শ্রেণির গণিতের ধারণা থাকলে ভালো। পড়তে পড়তে চিন্তা করা বেশি প্রয়োজন। সে জন্য একটানা না করে, একটু সময় নিয়ে ধারাবাহিকভাবে করলে প্রোগ্রাম বোঝা সহজ হবে।

বইটির ভাষা সহজ। উদাহরণগুলো সহজে বোঝা যায়। দেশি পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়গুলো সহজে বোঝানোর মতো করে লেখা হয়েছে। শুধু একটি কম্পিউটার বা স্মার্টফোন চালাতে পারলেই এ বই পড়ে ফেলা সম্ভব। কোডগুলো পড়ে ফেলা সম্ভব।

অনেকেই বলছেন, একুশ শতক আসলে জীববিজ্ঞানের। এবং তথ্য-প্রযুক্তির। যারা জীববিজ্ঞানে আগ্রহী, কম্পিউটারবিজ্ঞানে আগ্রহী, দেশে বসে বিশ্বমানের গবেষণা করতে চায়, এ বই তাদের জন্য। অনুপম প্রকাশনী প্রকাশিত বইটি পাওয়া যাবে অনলাইন-অফলাইনের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে।