আকাশ চেনার ‘হ্যান্ডবুক’, শৌখিন জ্যোতির্বিদের পাথেয়

দীপেন ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানচর্চার একটি স্নিগ্ধ নাম। ‘স্নিগ্ধ’ এ কারণে যে তাঁর গদ্য এত সাবলীল, এত সুন্দর এবং সে গদ্য পাঠান্তে এমন এক অনাবিলতা বিরাজ করে মননে যে এক সার্বিক প্রশান্তির ব্যাপার ঘটে। সাহিত্য পাঠে যে শান্তি আমরা আকাঙ্ক্ষা করি, যেন তারই এক মধুক্ষরা গ্রন্থি দীপেন ভট্টাচার্য আবিষ্কার করেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলো এরই উদাহরণ।

বিজ্ঞানসাহিত্যে তাঁর প্রবেশ কল্পবিজ্ঞানের হাত ধরে। এ পর্যন্ত তাঁর প্রায় নয়টি গ্রন্থ উন্মোচিত হয়েছে—সবকটিই গল্পগ্রন্থ কিংবা কল্পবিজ্ঞান কাহিনি। ‘দিতার ঘড়ি’ নামের যে গ্রন্থটির মধ্য দিয়ে আমি পাঠক হিসেবে লেখক দীপেন ভট্টাচার্যকে আবিষ্কার করেছিলাম, সে এক অনবদ্য কাহিনি। এত হার্দিক, এত সূক্ষ্ম, রূপকের মাধ্যমে এত ইতিহাসাশ্রয়ী একটি কল্পবিজ্ঞান চিন্তাই করা যায়নি। অথচ কাহিনিটি কল্পবিজ্ঞানের—তার মধ্যে সত্য বিজ্ঞান আছে, কাহিনির উত্তেজনা আছে, আবার ইতিহাস এমনভাবে রয়েছে যেন আমরা বুঝতে পারি ভৌগোলিক পরিবেশটি। তাঁর ভাষাও চমৎকার, তদ্ভব-ভারাক্রান্ত হলেও বাক্যগুলো কানে একরকমের অনুরণন আনে। সব মিলিয়ে বলা যায়, দীপেন ভট্টাচার্য পাঠ একটি সুখকর অভিজ্ঞতা।

সূচকের ব্যবহার দেখানোর সাহায্যে সেখানে লেখক দেখিয়েছেন, বায়ুমণ্ডলের ওপর থেকে ১ বর্গসেন্টিমিটার ব্যাসের একটা সিলিন্ডার যদি দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ‘শেষ’ প্রান্ত পর্যন্ত টানা যায়, তবে তার মধ্যে যত কণা থাকবে; আমাদের ঘরের ভেতরে যে পরিমাণ বালুকণা আছে, তা তার চাইতে বেশি। মহাবিশ্ব এতটাই খালি!

কল্পবিজ্ঞানের বাইরে কথাসাহিত্যের গদ্যে শ্রী ভট্টাচার্য হাত মকশো করলেও তাঁর পেশার ও নেশার জায়গাটি বিজ্ঞান। প্রবাস জীবনে তিনি যেমন পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করছেন; তেমনি দেশে যখনই আসেন, তাঁকে দেখা যায় রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ অভিযানে কিংবা এলিট বিজ্ঞান সভায়, সাহিত্যের বাসরে নয়। অথচ বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর সাকুল্যে একটি বই ছিল, সেটি ব-দ্বীপ সংক্রান্ত আরেক মুগ্ধকর পাঠ। সম্প্রতি (ডিসেম্বর ২০২৩) প্রথমা প্রকাশিত আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবই বইটি তাঁর পেশার সঙ্গে এবং পরিচিতির সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে বিজড়িত বলা যায়। বিজ্ঞানচিন্তা মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর লেখনীর কিছু অংশ এবং আরও অতিরিক্ত কিছুর সমন্বয়ে এই ছোট্ট বইটি। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯৫। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আরাফাত করিম।

বইটিতে বাইশটি ছোট ছোট অধ্যায় আছে। এখানে আকাশ দেখার আনন্দের কথা বলা হয়েছে, দেখার যন্ত্রপাতির কথা বলা হয়েছে, আকাশে কী ধরনের বস্তু দেখা যায়, তার বিবরণ আছে, তাদের পরিচিতি আছে, প্রয়োজনীয় জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক রাশিসমূহের পরিচিতি আছে, কিছু সমীকরণও আছে, সঙ্গে ঋতুভেদে রাতের আকাশের পরিচিতিও আছে। মোট কথা, রাতের আকাশ যাঁরা পর্যবেক্ষণ করতে চান বা করে থাকেন, তাঁদের জন্য একটা চমৎকার হ্যান্ডবুকের মতো কাজে দেবে বইটি।

কয়েকটি মজার বিষয় এখানে উল্লেখ করা যায়। মহাকাশ কতখানি ফাঁকা, সেটা বোঝাতে দ্বিতীয় অধ্যায়ে একটি ছোট আলোচনা আছে। সূচকের ব্যবহার দেখানোর সাহায্যে সেখানে লেখক দেখিয়েছেন, বায়ুমণ্ডলের ওপর থেকে ১ বর্গসেন্টিমিটার ব্যাসের একটা সিলিন্ডার যদি দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ‘শেষ’ প্রান্ত পর্যন্ত টানা যায়, তবে তার মধ্যে যত কণা থাকবে; আমাদের ঘরের ভেতরে যে পরিমাণ বালুকণা আছে, তা তার চাইতে বেশি। মহাবিশ্ব এতটাই খালি! তৃতীয় অধ্যায়ে বিভিন্ন রকম মহাজাগতিক গতির পরিচয় করিয়ে দিয়ে লেখক একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন—আমরা মোটামুটি সাত রকমের গতির মধ্য দিয়ে যাই—আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, স্থানীয় কাঠামোর গতি, গ্যালাক্সির আপেক্ষিক গতি, সুপারক্লাস্টারের গতি ইত্যাদি। দুরবিন কেনার ক্ষেত্রে অনেকেরই প্রশ্ন থাকে, লেখক এখানে সংক্ষেপে তাঁর বিবেচনা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, দুরবিনের ক্ষেত্রে আলোক-সিস্টেম এবং অভিলক্ষ্যের ব্যাস হচ্ছে দুটো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। তিনি আরও জানিয়েছেন, ভালো বাইনোকুলারের পর কেউ যদি টেলিস্কোপ কিনে আকাশ দেখতে চান, তবে তার উচিত হবে ৮”(৮ ইঞ্চি) ব্যাস দিয়ে শুরু করা। এরকম রাতের আকাশের বেশ কিছু টোটকা তথ্য পাঠক এ বইয়ে পেয়ে যাবেন। তা ছাড়া রয়েছে নানাবিধ মহাজাগতিক বস্তুর বর্ণনা, পরিচিতি ও সারসংক্ষেপ। তবে কেউ যদি এই বইয়ে ব্ল্যাকহোল নিয়ে জানতে চান, মহাবিশ্বের পরিণতি নিয়ে জানতে চান, তাহলে তিনি নিরাশ হবেন। আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবইয়ে এসব নেই। কারণ রাতের আকাশ যাঁরা দেখেন, তাঁদের চোখে অন্তত ব্ল্যাকহোল ধরা পড়বে না।

'আকাশ পর্যবেক্ষকের নোটবই' বইয়ের প্রচ্ছদ
আরও পড়ুন

বইটির কিছু দুর্বলতাও বলা দরকার। বইটি বেশি ছোট ও সংক্ষিপ্ত, এটা একটা সমস্যা। ৫৫ পৃষ্টার ১৩নং চিত্র এত হিজিবিজি যে এর বার্তাটি অনুসরণ করা অনেক পাঠকের জন্য হয়তো মুশকিল হবে। হের্ৎস্প্রুঙ-রাসেল চিত্র বা এইচ-আর ডায়াগ্রাম জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত দরকারি চিত্র। এটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন ছিল। এই চিত্রে যে প্রধান ধারাটি দেখা যায়, যাকে সবাই ‘মেইন সিকোয়েন্স’ বলে, তার বাংলা লেখক করেছেন ‘প্রধান সারণি’। ‘সিকোয়েন্স’ অর্থে বাংলায় আমরা ‘সারণি’ ব্যবহার করি না, ‘টেবিল’ অর্থে ‘সারণি’ ব্যবহৃত হয়। ফলে এই পরিভাষা চয়নটি যুতসই হয়নি।

বইয়ের পরিচিতিতে এ কথা লিখিত আছে—‘এ বইটি জ্যোতির্বিদ্যার, জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার নয়।’ তবে এই বইটি কীসের—যেখানে তারা, তারার উজ্জ্বলতা, এইচ-আর ডায়াগ্রাম, জোড়া তারা, উজ্জ্বল তারার তালিকা, নীহারিকা, গ্যলাক্সি এসব নিয়ে আলোচনা করে? লেখক লিখেছেন, ‘এই লেখার একটি বাক্য পড়তে যদি আপনার ২০ সেকেন্ড সময় লাগে এবং আপনার শরীরের সমচ্ছেদ ক্ষেত্রফল যদি ১ বর্গমিটার ধরা হয়, তাহলে ওই সময়ে আপনার শরীরের মধ্য দিয়ে প্রায় ১৪ কোটি নিউট্রিনো কণিকা পার হয়ে গেছে’—এটি কি জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান নয়? সম্ভবত লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, আকাশ পর্যবেক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় আইডিয়াগুলোর একটি সারসংক্ষেপ এই বইটি। কিংবা পাঠকের কাছে যা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান হিসেবে বহুল পরিচিত—যেমন মহাবিশ্বের সূচনা বা পরিণতিবিষয়ক আলোচনা, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদি—তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, সে বিষয়গুলো এ বইয়ের আলোচ্য বিষয় নয়। খেরোখাতা বা নোটবই হলেও বইটির বড় গুণ হলো, লেখকের ছিমছাম গদ্য পাঠককে বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করবে, সন্দেহ নেই। তবে লেখকের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, তিনি আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ মাত্রার জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের বই উপহার দেবেন ভবিষ্যতে।

লেখক: অধ্যাপক ও পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব এনার্জি অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)