প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে আছে ছন্দ এবং প্যাটার্ন। খোলা চোখে যা সরাসরি ধরা পড়ে না। ব্যাখ্যা করলেই কেবল বোঝা যায়। এই ছন্দ আর প্যাটার্নগুলোকে বলে ভৌতজগতের নিয়ম। এ নিয়মগুলো নিয়ে এক ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের ‘রকস্টার’ অধ্যাপক রিচার্ড ফাইনম্যান। সেখান থেকে সাতটি বক্তৃতা নিয়ে লেখা হয়েছে দ্য ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল। ভৌত নিয়মগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে এই বইয়ে। বাংলায় বইটি অনুবাদ করেছে প্রথমা প্রকাশন।
পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের অনেক পরিচয় আছে। ১৯৫৪ সালে ‘গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান বৃদ্ধিতে অসাধারণ অবদানের’ জন্য পেয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন পুরস্কার। এই পুরস্কার দেওয়া হয় প্রতি তিন বছরে একবার। তাই এর গুরুত্ব বেশি। নোবেল পুরস্কারও আছে এই বিজ্ঞানীর ঝুলিতে। খ্যাতিমান ও কল্পনাপ্রবণ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানী তিনি। নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার গোপন পারমাণবিক প্রকল্প—ম্যানহাটান প্রজেক্ট। এই প্রকল্পে যে বিজ্ঞানীরা কাজ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি হয়তো ছিলেন সবচেয়ে রসিক। কাজ করতেন কোয়ান্টাম জগৎ নিয়ে। ক্ষুদ্র কণার জগৎ নিয়ে তাঁর দিন কাটত।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া লেকচারের নাম ছিল মেসেঞ্জার লেকচার। লিখিত বক্তৃতা ছিল না, সামান্য কিছু নোটের ওপর ভিত্তি করে উপস্থিত বক্তৃতা দিয়েছিলেন ফাইনম্যান। সেগুলোর লিখিত রূপ এই বই।
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যালামোসে পারমাণবিক প্রকল্পে কাজের সময় তিনি এক অদ্ভুত মজা করে খ্যাত হয়েছিলেন। এই প্রকল্পের গবেষকেরা গোপন নথি রাখার জন্য সেফ বা লকার ব্যবহার করতেন। এসব লকারের তালা খুলত কম্বিনেশন বা নাম্বার ব্যবহার করে। নিজের অফিসে ফাইনম্যান প্র্যাকটিস করলেন কীভাবে লক খোলা যায়। লক খোলায় হাত পাকালেন সহকর্মীদের লকগুলো খুলে খুলে। ফাইনম্যান দেখলেন, বেশিরভাগ সেফের কম্বিনেশন খুব সহজ। কেউ হয়তো শুধু তিনটা শূন্য দিয়ে লক দিয়েছেন। কেউ দিয়েছেন এক-দুই-তিন।
দ্য ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল
লেখক: রিচার্ড ফাইনম্যান
অনুবাদক: উচ্ছ্বাস তৌসিফ
পৃষ্ঠা: ২১৬
দাম: ৪৫০ টাকা
প্রচ্ছদ: এআই আর্ট অবলম্বনে অনুবাদক
প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ২০২৪
প্রকাশক: প্রথমা
১৯৫৪ সালে ‘গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান বৃদ্ধিতে অসাধারণ অবদানের’ জন্য পেয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন পুরস্কার। এই পুরস্কার দেওয়া হয় প্রতি তিন বছরে একবার। তাই এর গুরুত্ব বেশি। নোবেল পুরস্কারও আছে এই বিজ্ঞানীর ঝুলিতে।
যাই হোক, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া লেকচারের নাম ছিল মেসেঞ্জার লেকচার। লিখিত বক্তৃতা ছিল না, সামান্য কিছু নোটের ওপর ভিত্তি করে উপস্থিত বক্তৃতা দিয়েছিলেন ফাইনম্যান। সেগুলোর লিখিত রূপ এই বই। সে সময় লেকচারগুলোর ভিডিও ধারণ করেছিল বিবিসি। এসব লেকচারে ফাইনম্যান বাছাই করা কিছু ভৌত নিয়মের সংক্ষিপ্ত ধারণা দিয়েছিলেন। লেকচারগুলো ইউটিউবে পাওয়া যায়। এই বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ যদি ভিডিওগুলো দেখে নেয়, তবে মন্দ হবে না। ভিডিও থেকে দেখা যাবে, পদার্থের আলাপ শুনে ঘন ঘন হেসে উঠছেন দর্শকেরা।
বইটি পড়লে আলাদা কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র না হয়েও জগতের নিয়মগুলো সহজে বোঝা যাবে। ভিডিও দেখলে গাইড হিসেবে কাজ করবে বই। এইচডি বা ফোর-কে ভিডিও দেখে যাদের অভ্যাস, আদ্যিকালের সাদাকালো ভিডিও সে চাহিদা মেটাতে পারবে কি না সন্দেহ!
সেকালে ফাইনম্যান ক্লাসরুম ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মনে। বইটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, ক্লাসরুমে বসে আছি। সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন একজন অধ্যাপক। পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে ব্যাখ্যা করছেন। রসিয়ে বলার ভঙ্গি তাঁর। এখানে শুধু পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। পদার্থবিদ্যা কীভাবে কাজ করে, কেন নিয়মগুলো এমন হলো ইত্যাদি। এই নিয়মগুলো পড়তে পড়তে ভৌত জগৎকে একটু আলাদাভাবে দেখা সম্ভব হবে।
প্রকৃতি সবসময় সবচেয়ে কম পরিশ্রমে কাজ সারতে চায়। খুব সাধারণ একটা কথা। এর ভেতরে আছে প্রকৃতির গভীর এক গোপন নিয়ম। আছে সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে অধ্যায়। এখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
ফাইনম্যান বলেছেন, প্রকৃতি খুব রহস্যময়। তবে এতে অদ্ভুত শৃঙ্খলা রয়েছে। আর শৃঙ্খলার নিয়মগুলোই পদার্থবিজ্ঞান। নিউটনের নীতিগুলো এমন সহজ করে বলেছেন, মনে হবে পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা সব পাঠকের পক্ষেই সমাধান করা সম্ভব। মহাকর্ষ নিয়ে আলোচনায় তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে গ্যালিলিও ও নিউটনের আবিষ্কারগুলো পৃথিবী ও মহাবিশ্ব বোঝার ভিত্তি তৈরি করেছিল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা জানা যাবে। ফাইনম্যানের মতে, বিজ্ঞানের কোনো কিছুই চূড়ান্ত না। আজ যা সত্য বলে জানি, কাল সেটা বদলে যেতে পারে।
বইয়ে অনেকগুলো সাধারণ নীতি পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে ‘লিস্ট অ্যাকশনের নীতি’। এটি বলে, প্রকৃতি সবসময় সবচেয়ে কম পরিশ্রমে কাজ সারতে চায়। খুব সাধারণ একটা কথা। এর ভেতরে আছে প্রকৃতির গভীর এক গোপন নিয়ম। আছে সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে অধ্যায়। এখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। ফাইনম্যানের স্বভাবজাত রসিকতা বিষয়টিকে উপভোগ্য করেছে।
অনুবাদে বইয়ের ভাষাটা পড়তে ফাইনম্যানের সঙ্গে আলাপের মতো। যেন তিনি বলছেন, শ্রোতা হিসেবে পাঠক তাঁর কথা শুনছেন। মজার সব উপমা পড়ে হাসতে হবে। পদার্থবিজ্ঞানের গভীরে যেতে চাইলে বইটি সাহায্য করবে। কঠিন কোনো সূত্র বা গাণিতিক হিসাব এখানে নেই। মূলত পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলোই বড় ক্যানভাসে দেখা যাবে।
লেখার ফাঁকে ফাঁকে আছে অনুবাদকের টিকা। বইয়ের শেষে পরিভাষাটাও বাড়তি সুবিধা যোগ করেছে। রসিক অধ্যাপকের মুখে বাংলা ভাষায় বইটি পড়তে চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন দ্য ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল।
কৌতূহলী পাঠক পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করবেন এই বই পড়ে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলে গল্প পড়ছেন বলে মনে হতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান জানা থাকলেও অধ্যায়গুলো থেকে দারুণ পদার্থবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা পাওয়া অসম্ভব না।
অনুবাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ ফাইনম্যানের এই বইটির আগে অনুবাদ করেছেন ফাইনম্যানের সিক্স ইজি পিসেস। অপদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রদের বোঝার কোনো অসুবিধা অনুবাদক রাখেননি। লেখার ফাঁকে ফাঁকে আছে অনুবাদকের টিকা। বইয়ের শেষে পরিভাষাটাও বাড়তি সুবিধা যোগ করেছে। রসিক অধ্যাপকের মুখে বাংলা ভাষায় বইটি পড়তে চাইলে সংগ্রহ করতে পারেন দ্য ক্যারেক্টার অব ফিজিক্যাল ল। আগেই বলেছি চমৎকার এ বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। বইমেলাসহ অনলাইন-অফলাইনে বইটি কেনা যাবে।