প্রকৃতির বুকে লুকানো অমৃতের সন্ধানে

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের কেউ কেউ হয়তো ঔষধি গাছের কথা শুনলে ভাবেন, এতে আর এমন কী হয়! হয়তো মনে হতে পারে, পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবী আধুনিক হয়েছে, এখন কি আর মানুষ ওষুধের জন্য শুধু উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে? যাঁরা এমনটা মনে করেন, তাঁদের জন্য একটি অবাক করা তথ্য দেওয়া যাক। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, পৃথিবীর প্রায় ৮০% মানুষ আজও চিকিৎসার জন্য মূলত ঔষধি গাছের ওপর নির্ভরশীল। তথ্যটা রীতিমতো গবেষণা থেকে পাওয়া।

সারা পৃথিবীতে এরকম প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ৭০০-এর বেশি, ভারতে আছে প্রায় ৪ হাজার। এসব ঔষধি গাছ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় সেই চিন্তা থেকেই ঔষধি গাছ নিয়ে লিখতে শুরু করেন। একে একে চারটি খণ্ড প্রকাশ করেছেন তিনি এসব উপকারী উদ্ভিদ নিয়ে। চতুর্থ খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি, ২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায়।

এই বইটিতে ১৩টি ঔষধি উদ্ভিদের কথা আলোচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে ১০১টি অসুখের চিকিৎসা দেখিয়েছেন তিনি। এসব চিকিৎসার সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে বইতে। বইয়ের শুরুতে রয়েছে একটি সূচনামূলক অধ্যায়। অধ্যায়টিতে বিশেষভাবে উঠে এসেছে মানুষের ভাইরাসঘটিত রোগ ও এদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধি উদ্ভিদের কথা। এ অধ্যায়টি সংযোজনের কারণ আর কিছু নয়—করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাস আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এরকম আরও অনেক ভাইরাসঘটিত রোগ রয়েছে, যেমন জন্ডিস, হাম, মাম্পস, গুটিবসন্ত, জলবসন্ত ইত্যাদি। এগুলোর উদ্ভিদনির্ভর চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা রয়েছে এ অধ্যায়ে।

পরের ১৩টি অধ্যায়ে ধারাবাহিকভাবে রয়েছে একটি করে উদ্ভিদের বর্ণনা। উদ্ভিদতাত্ত্বিক বর্ণনার পাশাপাশি এসব উদ্ভিদের রাসায়নিক উপাদান, ঔষধি গুণ, ব্যবহার, কী কী অসুখের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় এবং কীভাবে সে জন্য এসব ঔষুধি উদ্ভিদ ব্যবহার করা যায়, সেসব বিষয় সংক্ষেপে কিন্তু গোছানোভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। রয়েছে উদ্ভিদের ছবি, পাশাপাশি এসব উদ্ভিদ চাষাবাদের উপায়ও জানা যাবে বইতে।

বইটির সবচেয়ে ভালো দিক, প্রতিটি তথ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রের উল্লেখ রয়েছে। লেখক ভূমিকায় স্পষ্টভাবে লিখেছেন, এটি মৌলিক বই নয়। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য এ বইতে ব্যবহৃত হয়েছে অকৃপণভাবে। বৈজ্ঞানিক যেকোনো বইতে, বিশেষ করে চিকিৎসা নিয়ে আলোচনার জন্য এ ধরনের তথ্যসূত্র জরুরি। প্রতিটি সূত্রের সবিস্তার উল্লেখ রয়েছে অধ্যায়ের শেষে ‘তথ্যসূত্র’ অংশে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভালো দিক, ১৩টি ঔষধি গাছের নামে সূচিপত্র দেওয়ার পাশাপাশি রোগ অনুযায়ীও একটি সূচী দেওয়া আছে। আগ্রহীরা যে রোগের চিকিৎসা চাচ্ছেন, তা সহজেই খুঁজে বের করতে পারবেন এ থেকে। এ ছাড়াও বইতে ৯৬টি ঔষধি উদ্ভিদের রঙিন ছবি আছে। পাঠক বই পড়ে সহজেই এসব উদ্ভিদ চিনতে পারবেন ও চিকিৎসাকাজে ব্যবহার করতে পারবেন।

তবে কিছু বিষয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। যেমন এসব ঔষধি উদ্ভিদ কি যে কেউ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করতে পারবেন? যেমন ডেঙ্গুর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে ৩০ প্রজাতির উদ্ভিদ ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে পেঁপে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বইতে লেখক দেখিয়েছেন, লোকচিকিৎসার অংশ হিসেবে পেঁপে পাতা ও ফল খেলে কী ধরনের উপকার হতে পারে। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সৌমিত্র চক্রবর্তী বিজ্ঞানচিন্তায় ‘ডেঙ্গু চিকিৎসায় পেঁপেপাতার রস’ শিরোনামের এক লেখায় লিখেছেন, ‘প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে পেঁপেপাতা বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে নিরাপদ, তবে সবার ক্ষেত্রে নয়। গর্ভাবস্থায় বিকাশমান ভ্রূণের ওপর এর বিরূপ প্রভাব নেই, এমনটি বলা যায় না। যাঁরা লিভারের কোনো অসুখে ভুগছেন, তাঁদের জন্য পেঁপেপাতা বা যেকোনো হারবাল ওষুধ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। ডায়াবেটিক রোগী, বিশেষত যাঁরা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার করেন, তাঁদের বেলায় পেঁপেপাতা ব্যবহারে হঠাৎ করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক বেশি হারে কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে, যা কখনো কখনো প্রাণঘাতী। তাই রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আপাতত পেঁপেপাতা ব্যবহার না করা ভালো।’

একনজরে

ওষধি গাছ (চতুর্থ খণ্ড)

মৃত্যুঞ্জয় রায়

প্রকাশক: অনিন্দ্য প্রকাশ

প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০২৪

পৃষ্ঠা: ১৬০

দাম: ৪০০ টাকা

আমি নিজে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নই। সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার মতামত, বইটি উপকারী নিঃসন্দেহে, তবে এ ধরনের চিকিৎসা নিজে গ্রহণের আগে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে আগ্রহীদের জন্য বইটি বাংলায় এক অমূল্য সংযোজন। বাংলাদেশের এতসব ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে লোকজ চিকিৎসার প্রচলন রয়েছে বটে, তবে গবেষণাগারে গবেষণার পাশাপাশি ট্রায়ালের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, আমার জানামতে, খুব কম। এ ধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে এ বই হতে পারে পাথেয়। আর এ ধরনের গবেষণা নিঃসন্দেহে অনেকের জীবন বাঁচাতে পারে, স্বল্প ব্যয়ে, প্রাকৃতিক উপায়ে। এর প্রয়োজনীয়তা তাই কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

অনিন্দ্য প্রকাশ প্রকাশিত বইটি পাওয়া যাবে বিভিন্ন অনলাইন-অফলাইন বইয়ের দোকানে।