জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণা ও জীবনের গভীরে

অনেক খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে বা বাংলায়। জগদীশ চন্দ্রবসু, কুদরাত-ই-খুদা থেকে শুরু করে হালের জাহিদ হাসান—নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনেক। কিন্তু হাল আমলে জামাল নজরুল ইসলাম ‘বাংলাদেশি বিজ্ঞানী’র যতটা সমার্থক হয়ে উঠেছেন, তাঁকে নিয়ে যত মাতামাতি হয়েছে, তেমনটা হয়েছে খুব কম মানুষকে ঘিরেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা মানুষকে তাঁর কর্ম দিয়ে মূল্যায়ন করতে পারি না। এর পেছনের কারণটি বোঝা খুব কঠিন নয়। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত বা বিজ্ঞান কিংবা নির্দিষ্ট বিষয়ের যথেষ্ট গভীর জ্ঞানের অভাব। স্বাভাবিক। এ জ্ঞান ছাড়া সেই বিষয়ে একজন মানুষের কাজের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। ঠিক এই বিষয়টিই ঘটেছে জামাল নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে। কেউ কেউ তাঁকে বলেছেন ‘স্টিফেন হকিংয়ের চেয়েও বড় বিজ্ঞানী’, কেউ বলেছেন ‘তাঁর আসল কাজ হলো দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স, যা কেমব্রিজের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। বলা বাহুল্য, দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স একটি জনপ্রিয় ধারার বই। এটি পাঠ্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর জামাল নজরুল ইসলামকে হকিংয়ের চেয়ে বড় বিজ্ঞানী বলাটাও অকারণ মাতামাতি বা বাঙালি জাত্যাভিমান, আর কিছু নয়।

বিজ্ঞানচর্চা বা কারো বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পেছনে জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখালেখির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা কাউকে ‘বিজ্ঞানী’র স্বীকৃতি দেয় না। সে জন্য গবেষণা করতে হয়। সেই গবেষণা প্রকাশ করতে হয় জার্নালে। পিয়ার রিভিউয়ের মাধ্যমে গবেষণা যাচাই করার পর তা প্রকাশিত হয়। এইটুকু বলে নিয়ে একটু থেমে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তা, জামাল নজরুল ইসলাম গবেষণা করেছেন কী নিয়ে’—হয়তো থমকে যাবেন অনেকেই। কারণটি আর কিছু নয়। জামাল নজরুল ইসলামের ব্যক্তিত্ব, তাঁর দেশে ফেরা বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখালেখি নিয়ে যতটা চর্চা হয়েছে, তাঁকে মানবিক সীমাবদ্ধতার সীমানা পেরিয়ে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ক্যানভাসে আঁকার যে চেষ্টা চোখে পড়ে, তাঁর সত্যিকার কাজ বা গবেষণাগুলো নিয়ে আলোচনা ততটাই কম—একটু আগে বেড়ে ‘প্রায় শূন্য’ বললেও আসলে বাড়িয়ে বলা হয় না।

আরও পড়ুন
১৯৬৭ থেকে ১৯৭০—এই তিন বছরে ৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তিনি। এই গবেষণাপত্রগুলো ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি বা গাণিতিক বিশ্বতত্ত্ববিদ্যার মৌলিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। নক্ষত্রগুলো নিজেদের মহাকর্ষীয় চাপে নিজের ওপরেই সংকুচিত হয়ে চুপসে যেতে চায়।

জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণাজীবনের নানা দিক যাঁরা জানতে-বুঝতে চান, জামাল স্যারের মহাবিশ্ব বইটি তাঁদের জন্য। এই বাংলাদেশি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের সহকর্মী ছিলেন, রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর বাসায় দাওয়াত খেতে এসেছেন কিংবা তিনি ছিলেন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মামাতো ভাই—এসব চকমকে বিষয় বা জামাল নজরুল ইসলামের ব্যক্তিজীবনও বইটিতে এসেছে, স্বাভাবিকভাবে, প্রয়োজনে। প্রতিটি বাক্য লেখা হয়েছে হিসাব করে, তথ্য যাচাই করে—সেই তথ্যগুলো উল্লেখও করা আছে স্পষ্টভাবে। কিন্তু বইটির মূল স্বার্থকতা এখানে নয়।

স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। ফ্রেড হয়েলের মতো বড় বিজ্ঞানীও ছিলেন এ তত্ত্বের আধুনিক প্রবক্তাদের অন্যতম, ছিলেন আইনস্টাইনও। এই তত্ত্বের কিছু মৌলিক বিষয়—চার্জিত কণাগুলোর মধ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের মিথস্ক্রিয়া এবং আপেক্ষিতা তত্ত্বের প্রয়োগের মাধ্যমে ভরের স্থান-কালের উপযুক্ত ব্যাখ্যা নিয়ে কাজ করেছেন আমাদের জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০—এই তিন বছরে ৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তিনি। এই গবেষণাপত্রগুলো ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি বা গাণিতিক বিশ্বতত্ত্ববিদ্যার মৌলিক ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। নক্ষত্রগুলো নিজেদের মহাকর্ষীয় চাপে নিজের ওপরেই সংকুচিত হয়ে চুপসে যেতে চায়। আবার এর ভেতরে যে ফিউশন বিক্রিয়া হয়, তার ফলে সৃষ্টি হয় গ্যাসের বহির্মুখী চাপ। এই দুইয়ে মিলে নক্ষত্রেরা সমতায় থাকে। এই সমতা ভেঙে গেলে শুরু হয় নক্ষত্রের মৃত্যু প্রক্রিয়া। এই সমতা বা ভারসাম্য রক্ষার জন্য আপেক্ষিকতা তত্ত্বের যেসব চলক বিভিন্ন শর্ত মেনে চলে, আমাদের জামাল নজরুল ইসলাম সেগুলো সহজীকরণ করেছেন। আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণের একধরনের সমাধানে তাঁর এই পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

আরও পড়ুন

একনজরে

জামাল স্যারের মহাবিশ্ব

প্রদীপ দেব

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

প্রথম প্রকাশক: ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

পৃষ্ঠা: ১৪৩

দাম: ৩৮০ টাকা

প্রদীপ দেবের জামাল স্যারের মহাবিশ্ব নিঃসন্দেহে জামাল নজরুল ইসলামের বেড়ে ওঠা, তাঁর গবেষণা, মনস্তত্ত্ব বা চিন্তাধারা এবং সার্বিক জীবন নিয়ে অন্যতম প্রামাণ্য—হয়তো বলা চলে, সবচেয়ে প্রামাণ্য—এবং নির্ভরযোগ্য কাজ।

এগুলো কেবলই কিছু উদাহরণ। এরকম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা জামাল নজরুল ইসলামকে বড় বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ পল ডিরাক তাঁর গবেষণাপত্র পড়েছেন—এটা শুধু অমুক তমুককে চেনে, এমন বিবৃতি নয়; বরং তাঁর কাজ এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে সে কালের বিজ্ঞানীরা তাঁর কাজ দেখেছেন, পড়েছেন, নিজেদের গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। আপেক্ষিতা তত্ত্বের সমাধান, মহাবিশ্বের শেষ পরিণতিবিষয়ক তত্ত্বগুলো নিয়ে জামাল নজরুল ইসলামের কাজ প্রবাদতুল্য। সেই কাজের সূত্র ধরে তিনি সবার বোঝার মতো করে লিখেছেন দ্য আলটিমেট ফেট অব দি ইউনিভার্স। বিজ্ঞান না বোঝার কারণে, সবার বোঝার মতো যা ছিল, তা-ই নিয়ে সবাই মাতামাতি করেছেন। এটাই স্বাভাবিক।

জামাল নজরুল ইসলাম দেশে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল, ভূমিকা ছিল এ দেশে গবেষণার মৌলিক কাঠামো গড়ে দেওয়াতেও। তবে মানবিক সীমাবদ্ধতার কারণেই, পরিস্থিতির বাস্তবতায় দেশে ফিরে তিনি জড়িয়ে গেছেন নানা কাজে। তাতে মূল বিষয় বা গবেষণা থেকে সরে এসেছেন বহু দূরে। এই সীমাবদ্ধতাগুলোও উঠে এসেছে বইটিতে।

প্রদীপ দেবের জামাল স্যারের মহাবিশ্ব নিঃসন্দেহে জামাল নজরুল ইসলামের বেড়ে ওঠা, তাঁর গবেষণা, মনস্তত্ত্ব বা চিন্তাধারা এবং সার্বিক জীবন নিয়ে অন্যতম প্রামাণ্য—হয়তো বলা চলে, সবচেয়ে প্রামাণ্য—এবং নির্ভরযোগ্য কাজ। বিজ্ঞানে আগ্রহী, গবেষণায় আগ্রহী, জামাল নজরুল ইসলামে আগ্রহী বা শুধু বিজ্ঞানবিষয়ক জনপ্রিয় ধারার গভীর বোধসম্পন্ন বই পড়তে চান—এমন সবারই বইটি ভালো লাগবে। তবে বইটির কিছু দিক চোখে পড়ে—তথ্যসূত্র ভারাক্রান্ত হওয়ায় বইটিতে যে ‘একাডেমিক’ ধাঁচ এসেছে, তাতে সাধারণ পাঠকের পাঠের আনন্দে ব্যাঘ্যাত ঘটতে পারে। আবার পড়তে পড়তে আফসোসও হতে পারে—কিছু বিষয় আরও ধীরেসুস্থে ব্যাখ্যা করলে পড়ে বোঝাটা সহজ হতে পারত। তবে এত স্বল্প কলেবরে সেটা তুলে ধরা কঠিনও বটে। আশাকরি, ভবিষ্যতে এসব বিষয় নিয়ে লেখক আরও বিশদ আলোচনা করবেন অন্য কোনো বইয়ে।

আরও পড়ুন

লেখককে সাধুবাদ জানাতে হয়, ঘেঁটে ঘেঁটে জামাল নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত অনেক অজানা কাহিনি বা অপ্রচলিত ঘটনা তিনি তুলে এনেছেন। গবেষণাপত্রগুলো যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে এ ধরনের বৈজ্ঞানিক জীবন নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে আদর্শ উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রদীপ দেব আরএমআইটির প্রফেসর, তাঁর অভিজ্ঞতার ছাপ এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখার ফলে সহজে বোঝানোর হাত—দুটোই এ ক্ষেত্রে পাঠকের জন্য সহায়ক। নাহয় জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণার এতটা গভীরে এত সহজে ঢুঁ দেওয়া খুব সহজ নয়, তা বলা বাহুল্য—এতদিন এই গবেষণাগুলো আড়ালে রয়ে যাওয়ার ইতিহাসটুকুই যার প্রমাণ।

আগ্রহীরা বইটি পাবেন প্রথমা ডটকম, প্রথমার বইয়ের দুনিয়াসহ অনলাইন-অফলাইন বিভিন্ন বইয়ের দোকানে।

আরও পড়ুন