সময় প্রহেলিকার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান

সময় কী? এ প্রশ্নের জবাবে পদার্থবিজ্ঞান বলে, সময় একটা রাশি। মানে, পরিমাপক। একটা ঘটনা ঘটল। এই ঘটনাকে চিহ্নিত করবেন কীভাবে? দুটি জিনিস দিয়ে—কোথায় ঘটল, আর কখন ঘটেছে। অর্থাৎ স্থান ও কাল। এভাবে সময় দিয়ে ঘটনা বা ঘটনার পরিবর্তন চিহ্নিত করা যায়। মাপা যায়।

আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। পদার্থবিদ্যার বরপুত্র আইজ্যাক নিউটন ভেবেছিলেন, পরম সময়ের তুলনা করে বা সাপেক্ষে সবকিছু মাপা হয়। সময়ের ধারণার প্রয়োগও তিনিই প্রথম করেছেন গাণিতিকভাবে। তাতে গতিবিদ্যার সূত্রগুলো হয়ে উঠেছে চিরপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু নিউটনের পরম সময়ের ধারণা ভেঙে দেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি দেখালেন, আলো ছাড়া মহাবিশ্বের সবকিছুর গতি আপেক্ষিক। ফলে সময় পরম কিছু হতে পারে না। সময়ের প্রসারণ, সংকোচন যেমন হতে পারে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষকের (বা মানুষ) কাছে সময় ভিন্ন হতে পারে। আপেক্ষিকতা তত্ত্বে এর প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, আইনস্টাইনের এই ধারণা বাস্তব। প্রকৃতিতে সত্যিই এমন হয়।

আরেকটি তত্ত্বে সময় আসলে অভিজ্ঞতার পাল্লায় মাপা হয়। অতীত আর ভবিষ্যতের পার্থক্য হলো, আমাদের অতীতের স্মৃতি আছে। ভবিষ্যতের কোনো স্মৃতি আমাদের নেই বা থাকে না। কেন?

পদার্থবিজ্ঞানের একদম মৌলিক তত্ত্ব বলে, সময় যেমন সামনে এগোতে পারে, তেমনি পেছনে যেতেও এর কোনো বাধা নেই। অথচ বাস্তবে সময় শুধু সামনে এগোয়। এর ব্যাখ্যায় বলা হয় এনট্রপির কথা। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রে পাওয়া যায় এই এনট্রপি। অর্থাৎ বিশৃঙ্খলার পরিমাপ। যত সময় যায়, বাড়ে বিশৃঙ্খলা। কিন্তু এ তত্ত্বও পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না সময়ের একমুখিতা।

একনজরে

হোয়াট ইজ টাইম

সময়ের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিশ্লেষণ

আবদুল গাফফার রনি

প্রকাশক: পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.

প্রচ্ছদ: মলয় চন্দন সাহা

প্রথম প্রকাশ: ২০২৫

পৃষ্ঠা: ১৬০

দাম: ৪৫০ টাকা

এইটুকু পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, সময় এক প্রহেলিকা। এর মাথামুণ্ডু অনেক কিছু বুঝতে পারেন না বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাও। তাতে অবশ্য বিজ্ঞান বসে নেই। কাজ করে চলেছে সময় ও মহাবিশ্বের নানা রহস্য নিয়ে। এককালে সময় বা মহাবিশ্বের মতো ধারণাগুলোর ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হতো দর্শন। আজ সেই দর্শন পরিণত হয়েছে বিজ্ঞানে। কালে কালে সময়ের ধারণায় এসেছে বহু পরিবর্তন। সময়ের ব্যাখ্যায় গড়ে উঠেছে বহু দার্শনিক ধারণা, নানারকম বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস ও তত্ত্ব। এরকম বহু তত্ত্ব, ধারণা ও দর্শন নিয়ে আবদুল গাফফার রনির হোয়াট ইজ টাইম

পদার্থবিজ্ঞানের একদম মৌলিক তত্ত্ব বলে, সময় যেমন সামনে এগোতে পারে, তেমনি পেছনে যেতেও এর কোনো বাধা নেই। অথচ বাস্তবে সময় শুধু সামনে এগোয়। এর ব্যাখ্যায় বলা হয় এনট্রপির কথা।

বইটিতে অনেকগুলো ছোট ছোট অধ্যায়। যেমন ‘সময় কি নদীর মতো?’ অধ্যায়ের মূল প্রশ্নটি হলো, সময় কি চিরপ্রবাহমান? লেখক দেখিয়েছেন, তা নয়। দেখিয়েছেন, এক ব্যাখ্যায় সময়কে দেখানো হয় গাছের মতো। এই ব্যাখ্যাটি অনেকটাই সঙ্গত—অ্যানালজি বা উদাহরণ হিসেবে ভালো। গাছের শীর্ষটাই বর্তমান, যা প্রতিমুহূর্তে অতীতে পরিণত হচ্ছে, বাড়ছে ডাল-পাতা তথা শীর্ষ; অর্থাৎ গাছের এখনো না গজানো পাতা-ডালপালাই ভবিষ্যৎ।

আরেকটি তত্ত্বে সময় আসলে অভিজ্ঞতার পাল্লায় মাপা হয়। অতীত আর ভবিষ্যতের পার্থক্য হলো, আমাদের অতীতের স্মৃতি আছে। ভবিষ্যতের কোনো স্মৃতি আমাদের নেই বা থাকে না। কেন? কেনই-বা অতীতের সবটা, অর্থাৎ মহাবিশ্বের সব অতীত আমরা দেখতে পাই না? কতটা দেখতে পাব, তা নির্ধারিত হয় কীভাবে? নির্ধারিত হয় আলোক কোণ বা শঙ্কুর মাধ্যমে। এরকম মজার ও গুরুত্বপূর্ণ সব তাত্ত্বিক ধারণা বইটিতে উঠে এসেছে বইটির প্রতিটি অধ্যায়ে। পাঠক জানবেন, এনট্রপি কী; জানবেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব সময় নিয়ে কী বলে। বিগ ব্যাং বা সময়ের শুরুটা কেমন ছিল? মহাবিশ্বে সময়ের গুরুত্ব কী, সিঙ্গুলারিটিতে কেন ভেঙে পড়ে স্থান-কাল—এমনই নানা বিষয় উঠে এসেছে বইটির পাতায় পাতায়।

এ বইয়ের একটা বড় ইতিবাচক দিক হলো, এতে আধুনিক গবেষণাগুলোর কথাও তুলে এনেছেন লেখক। সময় নিয়ে ১৯ শতকের প্রথমাংশে যে বিপ্লব ঘটে গেছে, তা হজম করতেই আমাদের লেগে গেছে বহুকাল। তারপরে বহুদিন সময়ের ধারণা ও সংশ্লিষ্ট গবেষণায় অগ্রগতি হয়নি সেই অর্থে। কিন্তু বর্তমানে সময় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক গবেষণা হচ্ছে। এর কিছু কিছু মানস পরীক্ষা, কিছু কিছু সিমুলেশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখতে পারছেন বিজ্ঞানীরা। এভাবে জানা যাচ্ছে সময়ের সুপারপজিশন হতে পারে—অর্থাৎ সময় বা ঘটনার অনুক্রম একই সঙ্গে হতে পারে দুই রকম! হ্যাঁ, উদ্ভট, অবিশ্বাস্য কিন্তু বাস্তব এমনই সব আধুনিক গবেষণার কথাও রয়েছে বইটিতে।

বইটির সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো, একদম সহজ ভাষায় বোঝানো হয়েছে সময়ের গভীর সব ধারণা। সব বয়সী পাঠকই এটি পড়তে পারবেন। তা ছাড়া সময় নিয়ে এত বিস্তারিতভাবে খুব বেশি বই বাংলায় নেইও।

এ বইয়ের দুর্বলতা দুটি। একটিকে ঠিক দুর্বলতা নয়, বরং পাঠকের আশার সঙ্গে অমিল বলা ভালো। বইটিতে ছোট ছোট অধ্যায় আলোচনা যেভাবে এগিয়েছে, তাতে শুরুর দিকের অধ্যায় বা ধারণাগুলো অনেকক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে খানিকটা একঘেয়ে। এর অনেকগুলোতেই রয়েছে শুধুই দার্শনিক আলোচনা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধ্যায়গুলোকে পারস্পরিক সম্পর্কহীন বলেও মনে হয়। অবশ্য বইয়ের অর্ধেক পেরিয়ে এসে পাঠক বুঝবেন, ধারণাগুলো প্রয়োজনীয় বটে। তা ছাড়া ইন্টারেস্টিং যে কনসেপ্ট বা আলোচনা রয়েছে শেষের দিকে, সেগুলো ভালোভাবে বুঝতে ওই ধারণাগুলো কাজে লাগবে। তবে বইটিকে ঠিক ধারাবাহিক বলা চলে না, একটানা বা ক্রমান্বয়ে পড়ার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।

তথ্যগত কিছু ছোটখাটো ভুল চোখে পড়ে মাঝেমধ্যে—বলা বাহুল্য, এগুলো অনিচ্ছাকৃত। যেমন কার্লো রোভেলির দ্য অর্ডার অব টাইম বইটির নাম হয়ে গেছে ‘দ্য সাইকেল অব টাইম’। তবে বানান ভুল বা পরিভাষাগত ভুল নেই বললেই চলে।

বইটির সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো, একদম সহজ ভাষায় বোঝানো হয়েছে সময়ের গভীর সব ধারণা। সব বয়সী পাঠকই এটি পড়তে পারবেন। তা ছাড়া সময় নিয়ে এত বিস্তারিতভাবে খুব বেশি বই বাংলায় নেইও। লেখক ভূমিকায় লিখেছেন, এটি একটি ট্রিলজি (তিন খণ্ডে সমাপ্য) সিরিজের প্রথম বই। এ বই শেষে বাকি দুটি বইয়ের জন্য হয়তো অপেক্ষায় থাকবেন পাঠক।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. থেকে প্রকাশিত এই বই আগ্রহীরা পাবেন পাঞ্জেরীর পিবিএস, রকমারি, প্রথমাসহ বিভিন্ন অনলাইন-অফলাইন বুকশপে।

আরও পড়ুন