শূন্য ও শূন্যতার রহস্যময়তার গভীরে

‘কিছুই না’—জিনিসটা কল্পনা করতে পারেন? একটু থেমে ভাবুন—শূন্য।

শূন্য মানে কিছু নেই, শূন্যতা।

ধরুন, আপনার কোনো হেলিকপ্টার নেই। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, আপনার কয়টা হেলিকপ্টার আছে? নিশ্চয়ই বলবেন না, শূন্যটি। বরং আমরা বলি, একটাও নেই। ফলে শূন্যতা কল্পনা করা বড় কঠিন। কিছু না বোঝালেও শূন্য একটা সংখ্যা। এমন এক সংখ্যা, যা নিজে কিছু নয়, কিন্তু সবকিছুর হিসাব-নিকাশ বদলে দিতে পারে! শূন্যকে যেকোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে সব নেই হয়ে যায়, মানে শূন্য হয়ে যায়। আবার যোগ বা বিয়োগ করলে হিসাবে কোনো পরিবর্তন আসে না। গণিতের দুনিয়ার অন্যতম রহস্যময় সংখ্যা শূন্য। আর এই রহস্যময় শূন্যের ইতিহাস নিয়েই চার্লস সিফ লিখেছেন জিরো: দ্য বায়োগ্রাফি অব আ ডেঞ্জারাস আইডিয়া। এই বইয়ে গণিতের পাশাপাশি লেখক দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম ও ইতিহাসকে এক সুতোয় বেঁধেছেন দারুণভাবে। 

শূন্য মানে শূন্যতা, শূন্য মানে কিছু নেই—এই ভাবনা তখনকার দার্শনিকদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এমনকি ইউরোপের খ্রিস্টানেরা শূন্যকে শয়তানের সৃষ্টি বলেও ভাবত!

লেখক তাঁর লেখার ধরনেই প্রমাণ করেছেন, গণিত নিছক সংখ্যা নয়, বরং চিন্তার বিপ্লব। শূন্যের ধারণাটি প্রথম জন্ম নেয় ভারতীয় গণিতবিদদের হাতে। তাদের কাছ থেকে সেটি গ্রহণ করে চর্চা করতে শুরু করে আরব গণিতবিদেরা। আরও পরে আরববিশ্ব থেকে সেটি চলে যায় ইউরোপে। কিন্তু পাশ্চাত্য অনেকদিন এই ধারণা মানতে চায়নি। কারণ শূন্য মানে শূন্যতা, শূন্য মানে কিছু নেই—এই ভাবনা তখনকার দার্শনিকদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এমনকি ইউরোপের খ্রিস্টানেরা শূন্যকে শয়তানের সৃষ্টি বলেও ভাবত! কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসে শূন্য হলো গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি পাল্টে দেওয়া রহস্যময় এক নায়ক। নিউটনের ক্যালকুলাস থেকে শুরু করে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, এমনকি ব্ল্যাকহোল ও বিগ ব্যাং—সব কিছুর মূলেই রয়েছে এই শূন্য। চার্লস সিফ চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন, কীভাবে শূন্য আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলো বুঝতে সাহায্য করেছে।

বইটির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক এর গল্প বলার ধরন। গণিতের বই শুনলেই অনেকের মনে ভয় ঢুকে যায়। কিন্তু লেখক এত সহজ ও সুন্দরভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেছেন যে যেকোনো কৌতূহলী পাঠক এই বই পড়ে মুগ্ধ হবেন। বইয়ে তিনি শুধু তত্ত্ব বলে যাননি, বরং গল্প বলেছেন—কখনো ধর্মীয় কুসংস্কার, কখনো মহাজাগতিক রহস্য, কখনো বা দার্শনিকদের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন শূন্যের অভিযাত্রা।

একনজরে

জিরো: দ্য বায়োগ্রাফি অব আ ডেঞ্জারাস আইডিয়া

মূল: চার্লস সিফ

অনুবাদ: আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ

মূল্য: ৪২৫ টাকা

পৃষ্ঠা: ২০০

প্রচ্ছদ: এআই আর্ট/ উচ্ছ্বাস তৌসিফ

প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর, ২০২৪

স্কুল-কলেজশিক্ষার্থী পাঠকদের জন্য বইটি বিশেষভাবে উপযোগী। শূন্য বলতে আমরা শুধু সংখ্যা বুঝি। কিন্তু শূন্যের ইতিহাস, এটি কীভাবে এল, কেন শূন্য নিয়ে দেশে দেশে এত যুদ্ধ হয়েছে, তা গল্পে গল্পে জানলে শিক্ষার্থীরা গণিতে আরও বেশি আগ্রহী হবেন। পাশাপাশি বইয়ের শেষে শূন্যের কিছু মজার খেলা রয়েছে। এর সাহায্যে আপনি মানুষকে যুক্তি দিয়ে যেকোনো ফল বা ফুলে পরিণত করতে পারবেন! প্রমাণ করতে পারবেন—১ ও ০ সমান। এরকম আরও কিছু মজার জিনিস রয়েছে পরিশিষ্টতে। 

যাঁদের গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন বা মহাবিশ্বের অজানা রহস্যে আগ্রহ রয়েছে, তাঁদের জন্যই এ বই। কিছুই না থাকাটা যে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা দেখিয়েছেন চার্লস সিফ।

বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে, বিজ্ঞান আর দর্শনের সীমানা যেন মিলে গেছে। তবে এখানে একটা কিন্তু আছে। সহজ ভাষায় লেখা হলেও যাদের গণিত বা বিজ্ঞানে তেমন আগ্রহ নেই, তাদের কাছে কখনও কখনও বোরিং মনে হতে পারে। গল্প বা থ্রিলার উপন্যাস পড়ে যাদের অভ্যাস, তাদের কাছেও এই বই কিছুটা কঠিনই হয়তো মনে হবে। তবে ননফিকশন যাঁদের ভালো লাগে, বইটি তাঁদের নিঃসন্দেহে দারুণ আনন্দ দেবে।

সব মিলিয়ে জিরো বইটি শুধু গণিতপ্রেমীদের জন্য নয়, বরং যে কেউ পড়তে পারেন। যাঁদের গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন বা মহাবিশ্বের অজানা রহস্যে আগ্রহ রয়েছে, তাঁদের জন্যই এ বই। কিছুই না থাকাটা যে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা দেখিয়েছেন চার্লস সিফ। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আব্দুল্যাহ আদিল মাহমুদ। এর আগেও তিনি গণিতের বই অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনূদিত মালবা তাহানের দ্য ম্যান হু কাউন্টেড পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এই বইটিও যথেস্ট সহজ ও সাবলীল ভাষায় অনুবাদ করেছেন তিনি। বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। অফলাইন বিভিন্ন বইয়ের দোকান, বইমেলায় প্রথমার প্যাভিলিয়নসহ অনলাইনেও বইটি কেনা যাবে।