অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এ বেশ কয়েকটি ভালো জীবনীগ্রন্থ বা বায়োগ্রাফি প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জীবনী লেখা হয়েছে বিজ্ঞানীদের নিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের একটি ভালো মানের সায়েন্টিফিক বায়োগ্রাফি লেখা হয়েছে (জামাল স্যারের মহাবিশ্ব, প্রদীপ দেব), মাইকেল ফ্যারাডে ও মেরি কুরি নিয়েও চমৎকার বায়োগ্রাফি প্রকাশিত হয়েছে এই বইমেলায়। পাশাপাশি লিনাস পলিং (১৯০১-১৯৯৪), যিনি এককভাবে দুবার নোবেল পুরস্কার (১৯৫৪, ১৯৬২) পাওয়ার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, তাঁকে নিয়ে একটি মনোগ্রাহী জীবনী প্রকাশিত হয়েছে, যা নানা কারণে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
বইটির নাম লিনাস পলিং। লেখক রাহনুমা দিশা। বইটির উপশিরোনামে লেখা হয়েছে ‘রাসায়নিক বন্ধন ও শান্তির অগ্রদূত’। উপশিরোনাম থেকে আন্দাজ করা যায়, এখন অবশ্য এটা অনেকটাই সাধারণ জ্ঞান যে পলিং একবার রাসায়নিক বন্ধনের রহস্য ভেদ করার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, এর ৮ বছর পর বিশ্বশান্তির অগ্রদূতিয়ালি করার জন্য এবং বোমাবিরোধী বৈশ্বিক মতামত সৃষ্টির জন্য দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার পান। তাঁর প্রকাশিত বই বা প্রবন্ধের সংখ্যা সব মিলিয়ে ১ হাজার ২০০-এর বেশি। রসায়নের জগতে লিনাস পলিং এক বিখ্যাত নাম। তাঁর গবেষণা, লেখালেখি (বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ও পাঠ্যপুস্তক), একাগ্রতা ও অ্যাকটিভিজম—সবই অনুসরণীয়।
ক্যালটেকে ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে পলিং বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তাঁর সুপারভাইজার চেয়েছিলেন পলিং ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলে পোস্টডক ফেলোশিপ নিক, কিন্তু পলিং বার্কলেতে বিখ্যাত কেমিস্ট গিলবার্ট লুইসের কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানী রসায়নে হাতেখড়ি নেন বাবার রেখে যাওয়া ওষুধের ব্যক্তিগত ল্যাবরেটরি থেকে। কিশোর বয়স থেকে তিনি এই ল্যাবরেটরিতে এটা-সেটা নাড়াচাড়া করতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে পিতৃবিয়োগ ঘটেছে, মা একটা বোর্ডিংহাউস চালানোর প্রাণান্ত পরিশ্রম করছেন। মা চাইলেন, ছেলে স্কুল শেষে চাকরিতে ঢুকুক, সংসারের হাল ধরুক। কিন্তু লিনাস তো তখন বিজ্ঞানের অন্ধপ্রেমে পড়ে গেছেন। তাঁর সমাধান ছিল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে কাজ করার—রসায়নও হবে, আবার টাকাও হবে। কিন্তু সেটার জন্য লাগবে কলেজের ডিগ্রি। ওরেগন অ্যাগ্রিকালচারাল কলেজে (ওএসি) ভর্তি হলেন নিখরচায় রসায়ন শেখা যাবে, এই আশায়। সেখানে রসায়নের ল্যাবে তিনি একটা কাজ পেয়ে যান, একটা বসার টেবিল-চেয়ারসমেত; আর পান আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নাল পড়ার অফুরন্ত সুযোগ। এভাবে নিজ চেষ্টায় তিনি গবেষণাও শিখে ফেলেন। ওএসির ডিগ্রি সমাপনান্তে তিনি ক্যালটেকে ডক্টরেট করতে গেলেন বিখ্যাত অধ্যাপক নয়েসের সঙ্গে কাজ করার উদ্দেশ্যে। ক্যালটেকে গিয়ে ওএসির শিক্ষাবর্ষগুলোর অনেক ঘাটতি পুষিয়ে নিলেন। ভৌত রসায়ন, উচ্চতর গণিতের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং রসায়নের অন্যান্য টুল তিনি ক্যালটেকেই আয়ত্ত করেন।
একনজরে
লিনাস পলিং: রাসায়নিক বন্ধন ও শান্তির অগ্রদূত
লেখক: রাহনুমা দিশা
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০২৫
পৃষ্ঠা: ১৫৮
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
১৯২৩ সালে আভা হেলেনকে বিয়ে করেন লিনাস পলিং, যিনি ছিলেন তাঁর গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের রসায়ন ক্লাসের ছাত্রী। ক্যালটেকে ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে পলিং বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। তাঁর সুপারভাইজার চেয়েছিলেন পলিং ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলে পোস্টডক ফেলোশিপ নিক, কিন্তু পলিং বার্কলেতে বিখ্যাত কেমিস্ট গিলবার্ট লুইসের কাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রায় বার্কলেতে চলেই গিয়েছিলেন, যখন শেষ মুহূর্তে নয়েসের মধ্যস্থতায় পলিং গুগেনহাইম ফেলোশিপ নিয়ে ইউরোপে চলে গেলেন কোয়ান্টাম মেকানিকস ভালো করে শেখার আশায়। কারণ, রাসায়নিক বন্ধন নিয়ে লিনাস তখন আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছেন, আর কোয়ান্টাম জগতের বলবিদ্যা না জানলে রাসায়নিক বন্ধনের রহস্য ভেদ করা মুশকিল হবে। যা–ই হোক, ইউরোপের আলোকদীপ্ত ভ্রমণ ও শিক্ষাসফর শেষে লিনাস ফিরে এলেন ক্যালটেকে জয়েন করবেন বলে। ইউরোপের জ্ঞানের শিখা, বড় বড় বিজ্ঞানীর চিন্তার দুর্বার বিস্ফোরণ লিনাসকে কিছুটা হীনম্মন্য করে তুলেছিল, আমেরিকার তখনকার মফস্সল মার্কা বিজ্ঞানের কালচারে। কোথায় সেই সব জ্ঞান ও চিন্তাবিদেরা আর কোথায় এই প্রেইরির প্রান্তর!
তবু জীবন কেটে যায়! পলিং ঘনিষ্ঠ হন ওপেনহাইমারের সঙ্গে। উপলক্ষ রাসায়নিক বন্ধন—গণিতের দিকটা ওপেনহাইমার সামলাবেন, আর রাসায়নিক দিকটি লিনাস। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সেই সদ্ভাভ আর রইল না, তাঁদের পথ দুই দিকে সরে যেতে বাধ্য হলো। কারণ, ওপেনহাইমারের প্রমিস্কুইটি। তবে পলিংয়ের নেতৃত্বে ক্যালটেকে ইলেকট্রন ডিফ্র্যাকশন টেকনিকের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়, তাঁর ল্যাবে একটি যন্ত্রও নির্মিত হয়, তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। ১৯৩৭-৩৮ সালে লিনাস কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে একটি আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ১৯টি লেকচার প্রদান করেন, যা দিয়ে পরে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য নেচার অব কেমিকাল বন্ড রচিত হয়। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত এই বই আজও উল্লিখিত হয় কোনো না কোনো প্রবন্ধে। এই বইকে বলা হয় ‘কেমিস্ট্রির সবচেয়ে প্রভাবশালী বই এবং এর বাইবেল’।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর শুরু হয় বিশ্বশান্তি নিয়ে লিনাসের পথপরিক্রমা। সে গল্প তাঁর রসায়ন গবেষণার মতোই চমকপ্রদ। আশা করব পাঠক অধ্যাপক রাহনুমার বইটি থেকে বাকিটুকু জেনে নেবেন
অবশ্য এর আগেই ১৯৩৫ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, ইন্ট্রোডাকশন টু কোয়ান্টাম মেকানিকস উইথ অ্যাপ্লিকেশনস টু কেমিস্ট্রি, সহলেখক ই বি উইলসন। এই বই আমি ব্যক্তিগতভাবে মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেছি, বইটির গুরুত্ব গাণিতিক পদ্ধতি ও কোয়ান্টাম ধারণাগুলোর বিশদ ব্যাখায় এবং বইটির একটি ব্যতিক্রমী স্বভাব হলো প্রায়ই মূল বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলোর রেফারেন্স উল্লেখ। প্রাথমিক কাজের প্রাইমারি রেফারেন্স পেতে এই বই বেশ কাজের এবং এর বর্ণনাও বেশ সহজ।
রাসায়নিক বন্ধনের পর লিনাস একে একে প্রোটিন, হিমোগ্লোবিন, ডিএনএ, ভিটামিন সি—এসব নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেছেন। ক্রিক ও ওয়াটসনের ডিএনএ গবেষণা শেষতক নোবেল পুরস্কার পায়, অথচ তাঁরা ভেবেছিলেন, লিনাস পলিং জিতে যাবেন, এই ভেবে তাঁরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করে গেছেন। লিনাস নিউক্লিক অ্যাসিডের তিনটি হেলিক্স বা কুণ্ডলী আছে ধারণা করেছিলেন। কিন্তু সঠিক উত্তর হলো কুণ্ডলীর প্যাঁচ দুটি। জীবনে এভাবে আর কখনো হেরে যাননি লিনাস পলিং।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর শুরু হয় বিশ্বশান্তি নিয়ে লিনাসের পথপরিক্রমা। সে গল্প তাঁর রসায়ন গবেষণার মতোই চমকপ্রদ। আশা করব পাঠক অধ্যাপক রাহনুমার বইটি থেকে বাকিটুকু জেনে নেবেন।
নিজে রসায়নের অধ্যাপক, তাই রসায়ন ও লিনাস পলিংয়ের বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। ছোট ছোট অধ্যায়ে লিনাসের পুরো জীবনটা একদম ছবির মতো খেলে ওঠে। এমনকি লিনাসের প্রথম নোবেল জয়ে যে গানটি ছেলেমেয়েরা গেয়েছিল, তার একটি জম্পেশ অনুবাদ রাহনুমা পেশ করেছেন বইটিতে—
ড. লিনাস পলিং আমার সেই জন
উল্টেপাল্টে দিল এসে আমার রসায়ন।
মরি মরি, যখন সে চোখ তুলে চায়
আমার পরমাণু সব আয়নিত হয়ে যায়।
এলে কাছে, রক্ত–অণু আনন পরে জোটে
অম্ল কি ক্ষারক পারি না বলতে।
…
ড. পলিংয়ের ভাষণ চপল
অনুরণন কম্পাঙ্কে মোর বাধায় গন্ডগোল।
আমার সব যোজনী বদলে যায়,
কক্ষপথ বিন্যাসিত নবসজ্জায়।
একটি দারুণ বায়োগ্রাফি। শুধু দুটি গন্ডগোল—বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি আর আরউইন শ্রোয়েডিঙ্গারকে আমরা ‘পলি’ আর ‘স্রোডিনজার’ বলি না।