ভ্রূণ গবেষণায় নতুন মাত্রা

১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় পশ্চিম নেদারল্যান্ডসে। ১৯৪৫ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস স্বাধীন হয়। সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য পরিস্থিতির উন্নতি হয় দ্রুত।

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ক্লিমেট স্মিথ ও তাঁর দল ওই অঞ্চলে একটা স্বাস্থ্য জরিপ চালান সে সময়, দুর্ভিক্ষের সময় যেসব নারী গর্ভধারণ কিংবা সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের ওপর। সেই গবেষণায় দেখা যায়, দুর্ভিক্ষের সময় বা পরপরই যেসব শিশু (F1 নাম দেওয়া হয় এদের) জন্মেছে, তাদের ওজন স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে গড়ে ২০০ গ্রাম কম। এটা দুর্ভিক্ষের সময়ের জন্য অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, যেসব শিশু স্বাভাবিক ওজন ও সুস্বাস্থ্য নিয়ে জন্মেছিল, পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যেও দেখা যায় বিভিন্ন রোগের প্রকোপ। যেমন: হৃদরোগ, নানা ধরনের মানসিক সমস্যা, স্থূলতা, রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ, স্তন ক্যানসার ইত্যাদি। কিন্তু যুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডসের যেসব এলাকায় দুর্ভিক্ষ হয়, সেখানকার নবজাতকদের মধ্যে কিন্তু এ ধরনের রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে যেসব মা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছেন, তাঁদের সন্তানদের মধ্যে এসব রোগের প্রবণতা বেশি ছিল।

প্রতিদিন সারা পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি লোক পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়। আমরা চারপাশে যেসব অসুখ-বিসুখ দেখি, তার বেশির ভাগেরই শুরুটা হয় মাতৃগর্ভে।

এ ঘটনাটি আসলে ইঁদুর বা অন্য প্রাণীর ওপর করা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো ছিল। ধরা যাক, গর্ভকালীন মায়ের শরীরে ভিটামিন সির অভাব হলে সন্তানের ডিএনএ বা জিনোমের ওপর কোনো প্রভাব পড়ে কি না, তা জানতে চাই। একজন গর্ভবতী মাকে ভিটামিন খেতে না দেওয়া অনৈতিক, এর প্রভাব তাঁর গর্ভজাত সন্তানের ওপর পড়তে পারে। ফলে নানা রকম অসুখে ভুগতে হতে পারে সেই সন্তানকে। তাই গবেষণাটি আমরা করব অন্য কোনো প্রাণীর ওপর।

২০টি গর্ভবতী ইঁদুরকে দুটি গ্রুপে ভাগ করা যাক। এদের ১০টিকে স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে এবং বাকি ১০টিকে এমন খাবার দিতে হবে, যাতে ভিটামিন সি ছাড়া সব উপাদানই আছে। পরে দুই গ্রুপের ইঁদুরের ছানাদের জিনোম সিকোয়েন্স করা হবে। দুই গ্রুপের সিকোয়েন্সের পার্থক্যগুলো যাচাই করলেই পেয়ে যাব আমাদের প্রশ্নের উত্তর। ডাচ দুর্ভিক্ষের পর আসলে মানুষের মধ্যেই এমন দুটি গ্রুপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কোনো প্রাণীর মডেল নয়, বরং সরাসরি F1 শিশুদের রক্ত থেকেই জানা সম্ভব হয়েছিল মায়ের পুষ্টির সঙ্গে সন্তানের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক। ডাচ এই দুর্ভিক্ষ আর গবেষকদলটি গত কয়েক দশকে মা-শিশুর স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণাকে নিয়ে গেছে অনেক দূর।

ডাচ মেডিকেল দলটি রক্তের নমুনা সংগ্রহ এবং সব তথ্যের রেকর্ড চমৎকারভাবে সংরক্ষণ করেছে। F1–দের মধ্যে যারা এখনো বেঁচে আছে, কয়েক বছর পরপর তাদের ফলোআপ করা হচ্ছে এবং রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এমনকি F1-এর সন্তানদের দিকেও নজর রেখেছেন গবেষকেরা। একজন রোগীর পূর্বপুরুষ কিংবা সন্তানদের জীবনযাপনের ধরন এবং রোগের ইতিহাস জানা থাকলে রোগের কারণ জানা ও চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ণয় সহজ হয়। এ জন্য ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রির রেকর্ড রাখাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

পুষ্টির অভাবে আসলে মায়ের ভ্রূণে স্ট্রেস বা নেতিবাচক চাপ তৈরি হয়। কৃত্রিমভাবে কোষের ওপর স্ট্রেসের প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু সরাসরি মানবদেহে এমন গবেষণার সংখ্যা হাতে গোনা। অসুখ-বিসুখে বা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহে স্ট্রেস তৈরি হয়। একসময়ে স্ট্রেসের শারীরিক উপসর্গ ব্যাপারগুলো নিয়েই শুধু গবেষণা করা হতো। কিন্তু মানুষ এবং আরও অনেক প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্স এখন জানা হয়ে গেছে। স্ট্রেস কীভাবে জিনোমকে পরিবর্তন (মিউটেশন ও ভেরিয়েশন) করে রোগ তৈরি করে, সরাসরি সেটাই জানতে পারি। জিনোম সিকোয়েন্স জানা থাকায় চলে যেতে পারি সমস্যার একদম মূলে। প্রায়ই স্ট্রেস জিনোমের কিছু অস্থায়ী পরিবর্তন ঘটায়। যেমন জিনোমে বা জিনোমের সঙ্গে যুক্ত হিস্টন প্রোটিনে কোনো রাসায়নিকমূলক যোগ বা বিয়োগ (এপিজেনেটিক চেঞ্জ) করা। জেনেটিক বা এপিজেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে স্ট্রেস নানা রোগ তৈরি করতে পারে। ডাচ দুর্ভিক্ষেও এই তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েছে। F1 শিশুদের ভ্রূণ অবস্থায় জেনেটিক ও এপিজেনেটিক নানা পরিবর্তন হয়েছিল, যা তাদের জিনোম সিকোয়েন্স থেকে জানা গেছে। জেনেটিক ও এপিজেনেটিক পরিবর্তনগুলো কীভাবে রোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে? এই পরিবর্তনগুলো ক্যানসার তৈরিতে সহায়ক কোনো জিনকে ‘সুইচ অন’ করতে পারে, কিংবা ক্যানসাররোধী কোনো জিনকে ‘সুইচ অফ’ করে দিতে পারে।

জিনের সুইচ অফ সব সময় একদম সরাসরি হয় না। অধিকাংশ সময়ই একটি জিন বা প্রোটিন একা কাজ করে না; বরং আরও অনেক জিন বা প্রোটিনের সাহায্যে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে কাজ করে। এই নেটওয়ার্কের একটি জিন বা প্রোটিনের কোনো পরিবর্তন হলে পুরো নেটওয়ার্কটিই বদলে যায়।

জাম্পিং জিন নামে আমাদের একধরনের জিন আছে। এদের আরেক নাম ট্রান্সপোসনস, কেউ কেউ বলে জাঙ্ক ডিএনএ। সত্যি বলতে কি, এই জিনগুলোর কয়েক মিলিয়ন কপি আমাদের জিনোমে আছে। নাম শুনেই বোঝা যায়, এই জিনগুলো লাফ দেয়। এরা লাফ দিয়ে ঢুকে যায় জিনোম বা ক্রোমোজোমের অন্যান্য জায়গায়। সেসব জায়গায় থাকতে পারে বিশেষ কোনো জিন বা এমন কোনো নিউক্লিওটাইড সিকোয়েন্স। সেখানে জাম্পিং জিনগুলো ঢুকলে সিকোয়েন্সটা বদলে যাবে মিউটেশনের মতো। এভাবে জিনের পুরো একটি নেটওয়ার্ক বদলে যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা ট্রেইট। এটা হতে পারে শারীরিক বা আচরণগত কোনো বৈশিষ্ট্য, কিংবা কোনো অসুখের প্রতি তার সংবেদনশীলতা। জাম্পিং জিনকে সক্রিয় করে স্ট্রেস। আর গর্ভকালীন মায়ের কোনো স্ট্রেস হলে ভ্রূণের জাম্পিং জিন সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। ভেবে দেখুন, মানুষের জিনের নেটওয়ার্কে পরিবর্তন বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত বা পরিবর্তিত হতে পারে ভ্রূণ অবস্থা থেকেই। সন্তানের ভবিষ্যৎ রোগবালাইয়ের আশঙ্কাগুলোও লেখা হয়ে যায় এ সময়। সেই শিশুর বৈশিষ্ট্যগুলো তার সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হবে কি না, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায়নি।

আমার বর্তমান গবেষণায় পরীক্ষা করছি কোন কোন ধরনের স্ট্রেস, ভ্রূণের কোষের জাম্পিং জিনকে সক্রিয় করে এবং কতখানি করে। এই কাজটুকু আমি করব সেল কালচারে, অর্থাৎ ভ্রূণের স্টেম সেলকে কৃত্রিমভাবে উৎপাদন করাব বিভিন্ন স্ট্রেসের উপস্থিতিতে। এসব সেলের জিনোম সিকোয়েন্স করে জানতে পারব জাম্পিং জিনগুলো কতটুকু সক্রিয় হয়েছে এবং লাফ দিয়ে জিনোমের কোথায় গিয়ে ঢুকেছে। পাশাপাশি গর্ভবতী ইঁদুরকে বিভিন্ন স্ট্রেসে রেখে একইভাবে ইঁদুরছানাদের ওপর জাম্পিং জিনের ওপর স্ট্রেসের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করব। সবশেষে ডাচ দুর্ভিক্ষের সময় জন্মানো F1 সন্তানদের জিনোম সিকোয়েন্স করে বোঝার চেষ্টা করব, তাদের অসুখ-বিসুখের পেছনে যে মাতৃকালীন অপুষ্টি যুক্ত ছিল, সেখানে জাম্পিং জিনের ভূমিকা কতটুকু। ডিএনএ সিকোয়েন্সারের সহজলভ্যতা ও সুলভ মূল্যের কারণে এ ধরনের গবেষণা অনেকখানি সহজ হয়ে এসেছে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পোস্টডক্টরাল ফেলো, লুনেনফেল্ড-টানেনবাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট, টরন্টো