ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জীবনরহস্য

বাংলাদেশের একমাত্র ছাগল প্রজাতি ব্ল্যাক বেঙ্গলের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন হয়েছে। কেন এই সিকোয়েন্সের কথা মাথায় এল, কীভাবেই-বা সেটা করা হলো, এ প্রশ্ন বিজ্ঞানপ্রেমীদের মনে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু ছাগলের ডিএনএ সিকোয়েন্সিং কীভাবে হলো, সেটা জানতে আমাদের আগে জানা উচিত ডিএনএ কী, কী কী কাজ করে এটা আর কী প্রক্রিয়ায়ই-বা এটাকে সিকোয়েন্সিং করা হলো? এসব প্রশ্নের জবাব আগের একাধিক লেখায় এসেছে। তাই এই বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব না। তার চেয়ে বরং সিকোয়েন্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত দুটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় অ্যাসেম্বলিং ও অ্যাটেনশন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। তারপর ব্ল্যাক বেঙ্গলের গল্পে যাব।

বায়োইনফরমেটিকসের পরিভাষায় সিকোয়েন্স অ্যাসেম্বলি বলতে অপেক্ষাকৃত লম্বা ডিএনএ সূত্রকের খণ্ডাংশগুলোকে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে মূল ডিএনএ সূত্রকটি পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আধুনিক ডিএনএ সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তিগুলো পুরো ডিএনএ সূত্রককে একবারে পড়তে পারে না, কিন্তু প্রযুক্তিভেদে অপেক্ষাকৃত ছোট ২০-৩০ হাজার বেস পেয়ারের মধ্যে খণ্ডাংশগুলোকে পড়তে পারে। এ জন্য পরে সিকোয়েন্স অ্যাসেম্বলির প্রয়োজন হয়। ছোট এই খণ্ডাংশগুলোকে রিড বলা হয়। এটা জিনোমিক জিডিএনএ অথবা জিন ট্রান্সক্রিপ্টের (ESTs) শটগান সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া যায়।

আরেকটি বিষয় হলো জিনোম অ্যাসেম্বলি। অনেকগুলো ছোট ছোট ডিএনএ সিকোয়েন্স একত্র করে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে এবং পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে মূল ক্রোমোজোমগুলোকে পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়াক হলো জিনোম অ্যাসেম্বলি। এ প্রক্রিয়া থেকে ওই ডিএনএটিকেই পাওয়া যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রকল্পে কোনো জীবের ডিএনএকে প্রথমেই লাখ লাখ টুকরো করে কেটে নেওয়া হয়। এই টুকরোগুলোকে পরে স্বয়ংক্রিয় সিকোয়েন্সিং মেশিনের সাহায্যে পড়া হয়। একবারে এক হাজার নিউক্লিওটাইড বেস পর্যন্ত পড়তে পারে মেশিন। এভাবে অসংখ্য ওভারল্যাপিং রিড তৈরি করে। জিনোম অ্যাসেম্বলি প্রোগ্রাম বা অ্যালগরিদমের সাহায্যে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয় সব কটি রিডকে একত্র করে। তারপর পরস্পরের ওভারল্যাপিং প্রান্ত জোড়া লাগিয়ে যত দূর সম্ভব মূল ডিএনএ সূত্রকটি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলতে থাকে।

জিনোম অ্যাসেম্বলি একটি অত্যন্ত জটিল গণনাপ্রক্রিয়া। প্রায়ই এতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ, এমন অনেক জিনোম আছে, যারা প্রচুর পরিমাণ অভিন্ন ডিএনএ সিকোয়েন্স ধারণ করে। এদের পুনরাবৃত্ত ডিএনএ বলা হয়ে থাকে। এরা সহস্রাধিক নিউক্লিওটাইড পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং জিনোমের সহস্রাধিক জায়গায় অবস্থান করতে পারে। বিশেষ করে, উচ্চতর উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিশালাকৃতির জিনোমে। এর ফলে যে খসড়া জিনোম সিকোয়েন্স পাওয়া যায়, সারিবদ্ধ একগাদা কন্টিগের (contigs) সমাহার। এগুলোকে পরে যুক্ত করে অপেক্ষাকৃত বড় বড় স্ক্যাফোল্ড (scaffolds) পাওয়া যায়। এই স্ক্যাফোল্ডগুলোকে আবার ক্রোমোজোমের ফিজিক্যাল ম্যাপ বরাবর বসিয়ে একটি ‘গোল্ডেন পাথ’ তৈরি করা হয়।

অন্যদিকে জিনোমিক সিকোয়েন্সের সঙ্গে বায়োলজিক্যাল ইনফরমেশন বা তথ্য সংযুক্ত করার প্রক্রিয়াকে অর্থাৎ একটি জিনোমের সব কটি জিন এবং অন্যান্য নন-কোডিং এলাকাগুলো চিহ্নিত করে জিনোমে এদের অবস্থান এবং কার্যকলাপ নির্ণয় করার প্রক্রিয়াই হলো ‘জিনোম অ্যানোটেশন’। এটি আসলে একধরনের নোট, যা ব্যাখ্যা অথবা মন্তব্যের মাধ্যমে সিকোয়েন্সের সঙ্গে যোগ করা হয়। যখন একটি জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়, তাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য জিনোম অ্যানোটেশনের প্রয়োজন হয়। এটি মূলত ৩টি ধাপে করা হয়। প্রথম ধাপে জিনোমের যেসব অংশ কোনো প্রোটিন তৈরি করে না, তাদের শনাক্ত করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে জিনোমের উপাদান অর্থাৎ জিনগুলোকে খুঁজে বের করা। তৃতীয় ধাপে এসব উপাদানের সঙ্গে বায়োলজিক্যাল ইনফরমেশন যুক্ত করা হয়। অ্যানোটেশন দুই প্রকার: স্ট্রাকচারাল অ্যানোটেশন, যা জিনোমের ওপেন রিডিং ফ্রেম (ORFs) এবং এদের অবস্থান, জিনের গঠন, কোডিং এলাকা, নিয়ন্ত্রক মোটিফ এবং এদের অবস্থান শনাক্ত করে।

অন্যদিকে ফাংশনাল অ্যানোটেশন জিনোমিক উপাদানসমূহের বিভিন্ন কাজ যেমন, প্রাণরাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ, জৈবিক ক্রিয়াকলাপ, নিয়ন্ত্রণ এবং মিথস্ক্রিয়া, অভিব্যক্তি ইত্যাদির তথ্যগুলো সংযুক্ত করে।

স্বয়ংক্রিয় অ্যানোটেশন পদ্ধতিতে এ কাজগুলোই কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রোগ্রামের সাহায্যে করা যায়। অন্যদিকে ম্যানুয়াল অ্যানোটেশন পদ্ধতিতে মানুষের দক্ষতার প্রয়োজন। একটি আদর্শ অ্যানোটেশন পাইপলাইনে এই দুটি পদ্ধতিই পাশাপাশি থাকে এবং এরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। আর এভাবেই জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জটিল প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হয়।

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জিনোম

ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জীবন জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিভাসু)। এর আগে বাংলাদেশে পাট ও ইলিশের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে, কিন্তু ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জিনোমের আকারই এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়।

চট্টগ্রামের হাটহাজারি সরকারি ছাগলের খামার থেকে সংগৃহীত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের রক্ত থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর জিনোমের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ দশমিক শূন্য ৪ গিগাবাইট। এর মধ্যে প্রায় ৩১ দশমিক ৮৫ শতাংশ হলো রিপিট। ২৯ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২৬ হাজার ৪৫৮ জিন অনুমান করা হলেও এর মধ্যে ১২ হাজার ৫৮৯ জিনের স্ট্রাকচার অ্যানোটেশন করা হয়। কমপক্ষে একটা জিন অনটোলজি টার্ম পাওয়া যায় ৮ হাজার ১৭৩ জিনের মধ্যে। সম্প্রতি এই গবেষণা প্রকল্পটি বিখ্যাত সায়েন্টিফিক জার্নাল বিএমসিতে প্রকাশিত হয়েছে। সব ডেটাবেইস এনসিবিআইতে সংরক্ষিত আছে। ডেটা অ্যানালাইসিসের জন্য সিভাসুতে ১২৮ জিবি র‍্যান্ডম ক্ষমতাসম্পন্ন একটা কম্পিউটার স্থাপন করা হয় এবং ব্যবহার করা হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভার। গবেষণার অধিকাংশ বাংলাদেশ থেকে করা হয়েছে এবং কিছু অংশের জন্য আরও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভারের দরকার হয়। সেটি আবদুল বাতেন অস্ট্রেলিয়ার সাউদার্ন ক্রস বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভার ব্যবহার করে সম্পন্ন করেন। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে এ বিষয়ে গবেষণা ফলাফল বিখ্যাত স্প্রিঞ্জার নেচার প্রেস থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান জার্নাল বিএমসি রিসার্চ নোটস–এ প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণা প্রকল্পটির সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন নিউজিল্যান্ডপ্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আবদুল বাতেন এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আতিফ হাসান রহমান। এ ছাড়া সহযোগিতায় ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল স্টিয়ার, সিভাসুর জেনিটিকস ও অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক মো. কবিরুল ইসলাম খান এবং অধ্যাপক গউজ মিয়া এবং সিভাসুর গবেষণা ও সম্প্রসারণ পরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন। সিভাসুর উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশের একান্ত আগ্রহ ও সহযোগিতায় গবেষণাটি আলোর মুখ দেখে। সিভাসু ও বুয়েট ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসটিসি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

কেন এই গবেষণা?

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ছাগলের গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় অর্থনীতিতে ছাগলের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে ছাগল পালনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে। সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। বিশ্ববাজারে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের গ্রামের সাধারণ মানুষ এ ছাগল পালন করলেও অতি লাভের আশায় অন্য জাতের ছাগলের সঙ্গে এর সংকরায়ণও খুব একটা করে না। ফলে বিশ্বের হাতে গোনা যে ৪ থেকে ৫টি ছাগলের জাতের এখনো সংকরায়ণ হয়নি, স্বতন্ত্র জাত হিসেবে টিকে আছে, তার অন্যতম এই ব্ল্যাক বেঙ্গল। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই জাত টিকিয়ে রেখেছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, এ মুহূর্তে আড়াই কোটির বেশি ছাগল আছে বাংলাদেশে। এর ৯৫ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল। দেশের প্রায় ১ কোটি লোক ছাগল পালন করে। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটা একটা রেকর্ড। বাংলাদেশের এই ছাগলের সদ্যোজাত বাচ্চার মৃত্যুহার কম। খুব দ্রুত প্রজননক্ষম হয় বলে এই জাতের মাদি ছাগল বছরে দুবার গর্ভধারণ করতে পারে এবং প্রতিবার ৩ থেকে ৪টি বাচ্চা প্রসব করে। তা ছাড়া কম সময়ে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে বলে এই জাতের ছাগলের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বেশি। তাই অন্য জাতগুলোর তুলনায় এই জাতের ছাগলের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, এটি পালন করতে বড় চারণভূমি লাগে না। বাড়ির উঠান বা রান্নাঘরের পাশের ছোট্ট স্থানেও এরা দিব্যি বেড়ে ওঠে। তবে এফএওর গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুর্বল দিক হলো এর দৈহিক গঠন ও দুধের পরিমাণ অন্যান্য ছাগলের চেয়ে কম। ছাগলের জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এর দুর্বল বৈশিষ্ট্যগুলো দূর করে আরও উন্নত প্রজাতির ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত তৈরি করা যাবে, যা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: গবেষক, জিনোমিকস রিসার্চ গ্রুপ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়