নোবেলজয়ী মরিচ গবেষণা

ধরুন, দিনের আলোয় আপনার সামনে দিয়ে একটা ইঁদুর হেঁটে গেল। আপনি দেখলেন, ইঁদুরটি কালো রঙের, বড় লেজওয়ালা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আপনি বড়জোর কোনো প্রাণীর নড়াচড়া বুঝতে পারবেন। সেটা ইঁদুর নাকি অন্যকোনো প্রাণী, আলো ছাড়া তা দেখা সম্ভব নয়। একই ঘটনা যদি সাপের সঙ্গে ঘটে? সাপ কিন্তু অন্ধকারে ঠিকই ইঁদুরকে চিনতে পারবে। কারণ সে ইঁদুরের শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করে ইঁদুরের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। সাপ আমাদের মতো করে ইঁদুরকে দেখে না। তার দেখার প্রক্রিয়া মানুষের চেয়ে ভিন্ন। ঠিক একই ভাবে অনেক নিশাচর প্রাণীর রাতে চলাচল করতে তেমন সমস্যা হয় না। এর মানে হলো, আমরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখি, অন্য সবাই ঠিক একই রকম করে দেখে না। সবাই ভিন্ন ভিন্নভাবে পৃথিবীকে দেখে বা অনুভব করে। এর কারণ, অনুভূতি—যেমন তাপ, চাপ, শব্দ, স্বাদ বা দেখার জন্য প্রাণীদের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অঙ্গ থাকে, তারা ভিন্নভাবে কাজ করে। এই অনুভূতিগুলো পরিবেশ থেকে গ্রহণ করার পর আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়। মস্তিষ্ক আমাদের জানিয়ে দেয়, আমরা কেমন অনুভব করছি। অনুভূতির তথ্য গ্রহণের এই পুরো প্রক্রিয়া বেশ জটিল। বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরে এ প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি বোঝার চেষ্টা করছেন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড জুলিয়াস তাঁদের একজন। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা ১৯৯৭ সালে পেইন বা ব্যথা অনুভবের বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার কাজে তারা ব্যবহার করেন মরিচ! মরিচের ঝাল স্বাদের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এই ঝাল স্বাদ আমাদের জিহ্বায় অনেকটা পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি সৃষ্টি করে। জুলিয়াসের গবেষণার আগেই এই ঝাল স্বাদের উৎস সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানা ছিল। মরিচে যে ক্যাপসাইসিন নামের উপাদান থাকে, তা এই ঝাল বা পুড়ে যাওয়ার মতো স্বাদের জন্য দায়ী। ক্যাপসাইসিন আমাদের মুখের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ত্বকের নিচে থাকা বিশেষ স্নায়ু ফাইবার সক্রিয় হয়ে উঠে। এই স্নায়ু ফাইবার ঝাল স্বাদের তথ্য মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু জুলিয়াস চিন্তা করলেন, এই ক্যাপসাইসিন আর স্নায়ু ফাইবারের মাঝে অবশ্যই কিছু আছে। যেটা হয়তো ক্যাপসাইসিনের সঙ্গে স্নায়ুর যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এই ‘মাঝামাঝি কিছু একটা’ আসলেই আছে কি না, তা কেউ জানত না। যদি থাকে, তাহলে সেই কিছু একটা দেখতে কেমন?

কীভাবেই-বা সে কাজ করে? বেশ ঝুঁকি নিয়েই জুলিয়াস তাঁর প্রজেক্ট শুরু করলেন! তিনি স্নায়ু কোষ থেকে জিন সংগ্রহ করে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ছোট ছোট জিন পুল বা জিনের আধার বানালেন। প্রায় ১৬ হাজার জিন পুল তৈরি করলেন! প্রতিটি জিন পুলকে আলাদা আলাদাভাবে তিনি প্রয়োগ করলেন কিডনি কোষে। কিডনি কোষ সেই জিনগুলোকে প্রোটিন আকারে প্রকাশ করতে লাগল। এরপর কিডনি কোষে তিনি ক্যাপসাইসিন প্রয়োগ করলেন। যদি ক্যাপসাইসিন কিডনি কোষকে উত্তেজিত বা সক্রিয় করতে পারে, তাহলে কোষের বাইরে থেকে ক্যালসিয়াম আয়ন কোষের ভেতরে প্রবেশ করবে, আর বিশেষ রঙের সাহায্যে সেই ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি বোঝা যাবে। জুলিয়াস ভাগ্যবানই বটে! ১৬ হাজার জিন পুল থেকে একটি জিন পুল কাজ করল। ১১ নম্বর পুলটি যে কোষে প্রকাশ পেয়েছিল, সেটি কোষের ভেতর ক্যালসিয়ামের উপস্থিতি অনেক বাড়িয়ে দিল। তার মানে এই জিনটি থাকার কারণে ক্যাপসাইসিন কিডনি কোষকে উত্তেজিত করতে পেরেছে। এই জিনটি আসলে একটি রিসেপ্টর প্রোটিনের প্রকাশ ঘটায়, তার নাম জুলিয়াস দিলেন VR1(V আদ্যক্ষরটি এসেছে ভ্যালিনাইল থেকে, ক্যাপসাইসিনে এই রাসায়নিক গ্রুপটি আছে, তাই ক্যাপসাইসিনকে ভ্যালিনয়েড পদার্থও বলা হয়)। পরবর্তীতে এই রিসেপ্টরের নাম বদলে দেওয়া হলো TRPV1। নামটি কি চেনা চেনা লাগছে? জি, ঠিকই ধরেছেন, এটি সেই রিসেপ্টর, যা আবিষ্কার করে জুলিয়াস ঘরে তুলেছেন নোবেল পুরস্কার! জুলিয়াসের কাজ অবশ্য ক্যাপসাইসিনের এই রিসেপ্টর আবিষ্কারের মধ্যেই থেমে ছিল না। তিনি আরো প্রমাণ করেন, ক্যাপসাইসিনের এই রিসেপ্টরই তাপে পুড়ে যাওয়ার অনুভূতির জন্য দায়ী! পরবর্তীতে জুলিয়াস আগ্রহী হন শরীরের তাপ বোঝার এ ক্ষমতা নিয়ে। তিনি ভাবলেন, যদি তাপের জন্য রিসেপ্টর থাকতে পারে, তাহলে ঠাণ্ডা অনুভূতির জন্য অবশ্যই আলাদা রিসেপ্টর থাকার কথা। তিনি আবার শুরু করলেন সেই প্রথম থেকে, ঠিক যেমন মরিচ দিয়ে শুরু করছিলেন তাপের বেলায়। তিনি এবার সাহায্য নিলেন মিন্ট বা মেনথলের। এটা আমাদের ঠাণ্ডা অনুভূতি জাগায়। ভাগ্য এবারো নিরাশ করল না জুলিয়াসকে। মরিচের মতো একই ধরনের পরীক্ষার সাহায্যে তিনি আবিষ্কার করলেন, ঠাণ্ডার অনুভূতি গ্রহণের জন্য আমাদের আছে আলাদা রিসেপ্টর, এর নাম TRPM8। জুলিয়াস আরও বেশ কিছু রিসেপ্টর নিয়ে কাজ করেছেন, যেমন জাপানী রান্নায় ঝাল স্বাদের জন্য ব্যবহৃত ওয়াসাবি TRPA1 নামের ভিন্ন রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়। তাই মরিচের ঝাল স্বাদের সঙ্গে ওয়াসাবির ঝাল স্বাদের পার্থক্য ধরা যায়।

TRPV1 রিসেপ্টর আবিষ্কার করে জুলিয়াস ঘরে তুলেছেন নোবেল পুরস্কার

প্রশ্ন হলো, এসব রিসেপ্টর সম্পর্কে গবেষণা আমাদের কি কাজে আসবে? এই যে প্রচণ্ড তাপ বা ঠান্ডার অনুভূতি, এগুলো মূলত ব্যথা বা পেইন। তাই ভবিষ্যতে পেইনকিলার বা ব্যথানাশক ওষুধ বানানোর সময় এ রিসেপ্টরকে টার্গেট করা যাবে সহজেই। জুলিয়াস মরিচ থেকে যে গবেষণা শুরু করেছিলেন, তা এখন অবদান রাখছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, দ্য গ্রাজুয়েট ইউনিভার্সিটি ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ, জাপান

সূত্র: নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ, উইকিপিডিয়া