ডাইনোসর থেকে আজকের পাখি

খুব আয়েশ করে হাঁসের মাংস, কবুতরের মাংস কিংবা চিকেন ফ্রাই খাই আমরা। কখনো কি ভাবি, এই সুস্বাদু চিকেন ফ্রাইয়ের মুরগির উত্পত্তি কোথায়? বিজ্ঞানীরা কিন্তু ভেবেছেন।

১৮৬১ সালে জার্মানিতে পালকের ফসিল খুঁজে পান কিছু জীবাশ্মবিদ। ধারণা করা হয়, এটি আর্কিওপটেরিক্স নামের প্রাচীন একটি পালকওয়ালা ডাইনোসরের। পরবর্তী সময়ে ১৮৬৩ সালে জীবাশ্মবিদ রিচার্ড ওয়েন পাখির কঙ্কালসদৃশ একটি পূর্ণ ফসিল খুঁজে পান। কিন্তু অবাক বিষয় হলো, কঙ্কালটি সরীসৃপেরও অনেক বৈশিষ্ট্য বহন করে! এর কিছু পরে জীববিজ্ঞানী থমাস হেনলি হাক্সলি এই আর্কিওপটেরিক্সকে পাখি ও সরীসৃপের মধ্যবর্তী পরিবর্তনীয় ফসিল হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

প্রায় কয়েক শতাব্দী ধরে এই আর্কিওপটেরিক্সের ফসিলই ছিল একমাত্র ফসিল, যা ডাইনোসর থেকে পাখির উত্পত্তি ব্যাখ্যা করে। পরে ১৮৭০ সালে আর্কিওপটেরিক্সের একটি কঙ্কালে সরীসৃপের দাঁতের সম্পূর্ণ একটি সেট পাওয়া যায়। এটিই পাখির সঙ্গে সরীসৃপ ও ডাইনোসরের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করে। হাক্সলি তাই পাখিদের ‘মহিমান্বিত সরীসৃপ’ নামে আখ্যা দেন এবং অভিযোজনের দিক থেকে সর্বপ্রথম উত্পত্তিগতভাবে পাখি ও ডাইনোসরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন।

এর পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যে যখন আরও অনেক ডাইনোসরের ফসিল আবিষ্কৃত হলো, তখন বিভিন্ন বিজ্ঞানীর বিভিন্ন মতবাদের কারণে আর্কিওপটেরিক্স যে পাখিদের পূর্বপুরুষ, সেই ধারণা ক্রমেই ক্ষীণ হতে লাগল। কিন্তু অ্যালিক ওয়াকার ও জাক গথিয়েদের মতো বিজ্ঞানীদের গবেষণায় হাক্সলির মতবাদই আবার উঠে আসে-থেরোপড ডাইনোসররাই সুনির্দিষ্টভাবে পাখিদের সাথে কাছাকাছি সম্পর্কযুক্ত।

কিন্তু পাখিদের উত্পত্তি যে ডাইনোসর থেকে, এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ কী? আসলে আমাদের কাছে তো টাইম মেশিন নেই, তাই ডিএসএলআর দিয়ে ছবি তুলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়ে তো দেখানো সম্ভব নয়। প্রমাণ হিসেবে ফসিলই ভরসা। ১৯৯০ সালে অনেকগুলো পাখির ফসিল আবিষ্কার হয় চীনে। এগুলো ক্রিটেশাস যুগের শুরুর দিকের ফসিল ছিল। ১২.৪৬ থেকে ১২.২ কোটি বছর আগে এরা বসবাস করত। ১৯৯৬ সালে সাইনোসরোপটেরিক্স নামের ডাইনোসরদের ফসিলের সঙ্গে পাখিদের মিল পাওয়া যায়। পরে জানা যায়, এটি থেরোপড ডাইনোসর এবং বিস্ময়করভাবে জানা যায় যে এর শরীর দীর্ঘ সুতার মতো উপাদান দিয়ে আবৃত ছিল। এগুলোকে পালকের আদি রূপ বলা চলে। এই পালকগুলোর সঙ্গে বর্তমান পাখিদের আধুনিক পালকের বেশ মিল পাওয়া গিয়েছিল।

পরে অসংখ্য পাখিসদৃশ ডাইনোসর, যাদের পাখির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিল আছে এবং ডাইনোসরসদৃশ আদি পাখিদের ফসিলে এ রকম পালকের সন্ধান পাওয়া যায়। ফলে ডাইনোসর থেকে পাখির উত্পত্তির মতবাদটি আরও সুদৃঢ় হয়। খুব কম বিজ্ঞানী অবশ্য মনে করেন, এই আদি পালক আসলে ত্বকের নিচে কোলাজেন তন্তুর পচনের ফলে তৈরি। এটির সঙ্গে পালকের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু পরে বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তির মাধ্যমে এটিকে নাকচ করে দেন। তাঁরা সুতার মতো উপাদানে রঙিন মেলানিন খুঁজে পান, যেটা কেবল পালকেই থাকা সম্ভব, কোলাজেনে নয়।

এ ছাড়া পাখি ও ডাইনোসরের কঙ্কালেও বেশ মিল রয়েছে-ঘাড়, পিউবিস, কবজি, বাহু, বক্ষীয় খাঁচা—এসব হাড়ের মিল ডাইনোসর থেকে পাখির উত্পত্তির দিকেই ইঙ্গিত করে। পাখি ও ডাইনোসরের শ্বসনতন্ত্র ও হৃৎপিণ্ডের মধ্যেও মিল পাওয়া গিয়েছে। বিশালাকৃতির মাংসাশী ডাইনোসরদের এবং আধুনিক পাখিদের বায়ুথলির মধ্যে মিল রয়েছে। ২০০০ সালের দিকে থেসিল্যাসরাসের একটি নমুনা থেকে কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যানের মাধ্যমে এদের হৃৎপিণ্ডের গঠন দেখার পর আধুনিক পাখি ও স্তন্যপায়ীদের সঙ্গে মিল খুঁজে পেলেও পরে আরও আধুনিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই মিলগুলো ঠিক সংগতিপূর্ণ নয়। তাই প্রমাণ হিসেবে আদতেই এটি অনেক দুর্বল।

পরবর্তী সময়ে আণবিক পর্যায়ে ডাইনোসর থেকে পাখির উত্পত্তির প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ইতালিতে ১৯৯৮ সালে পাওয়া শিপিওনিক্স স্যামনিটিকাস প্রজাতির ডাইনোসরের ফসিল থেকে যকৃত, পেশি ও অন্ত্র থেকে সফট টিস্যু পাওয়া গেলে গবেষণা শুরু হয়। ২০০৫ সালে ৬৮ মিলিয়ন পুরোনো টি-রেক্সের পায়ের হাড়ের সফট টিস্যু পাওয়া যায়। এর থেকে কোলাজেন তন্তু নিয়ে গবেষণা করে একেবারে কোষীয় পর্যায়ে থেরোপড ও আধুনিক পাখিদের মধ্যে ব্যাপক মিল পাওয়া যায়।

এ তো গেল মিলের কথা। এবার আসা যাক কী কী পরিবর্তন হয়েছে সেই কথায়। যেহেতু ডাইনোসর থেকে পাখির উত্পত্তি হয়েছে, তাই মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে সব হাড়, মূলত সবকিছুই নাটকীয়ভাবে সংকুচিত ও খাটো হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পালক ও ডানা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এবং ওড়ার প্রচেষ্টায় পাখির পূর্বপুরুষেরা আকারে খাটো হতে থাকে। বাচ্চা পাখির মস্তিষ্কের সঙ্গে ফসিল থেকে পাওয়া শিশু ডাইনোসরের মস্তিষ্কের ব্যাপক মিল পাওয়া যায়। তাহলে দুটো প্রাণীর মস্তিষ্কের এরূপ ভিন্ন গঠন কী করে হলো? এর উত্তরের খোঁজে একদল বিজ্ঞানী পুরো পৃথিবী ঘুরে অসংখ্য ফসিল ও নষ্ট হয়ে যাওয়া ডাইনোসরের ডিম খুঁজে বের করেন এবং এদের ভ্রূণীয় বিকাশ লক্ষ করেন। তাঁরা দেখেন, ভ্রূণীয় বিকাশের শুরুর দিকে মস্তিষ্কের গঠন একই থাকলেও একটা পর্যায়ে পাখিদের মস্তিষ্ক হঠাৎ করেই ছোট হতে শুরু করে ও ভিন্ন আকার লাভ করে। একেবারে সুস্পষ্ট প্রমাণ!

এ ছাড়া ঠোঁটের উত্পত্তিও অভিযোজনকেই নির্দেশ করে। কারণ, ঠোঁটের উত্পত্তি খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এর পেছনে দুটি জিনের উপস্থিতি খুঁজে বের করেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ডাইনোসরদেরও এই দুটি জিন ছিল, কিন্তু জিনগুলো সুপ্ত ছিল, বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেনি। পাখিদের শরীরে এই জিন দুটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ প্রত্যক্ষভাবে মাইক্রোবিবর্তনকে নির্দেশ করছে।

যাহোক, ডাইনোসর পাখির উত্পত্তির পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি ছিল, পাখির ডানা ও ডাইনোসরের হাতের গঠনের ভিন্নতা। এ ছাড়া তাঁদের মতে, আর্কিওপটেরিক্সের মস্তিষ্কের গঠন ও অন্তঃকর্ণের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা, ডানার পালকের বিন্যাস পাখিদের মতো হলেও ওড়ার জন্য কাঁধের গঠন উপযুক্ত ছিল না। তাই সত্যিকার অর্থে হয়তো উড়তে পারত না তারা। অল্প দূরত্ব উড়ে পাড়ি দিতে পারত।

সে যা-ই হোক, ডাইনোসর থেকে আধুনিক পাখির উত্পত্তি নিয়ে আরও নতুন সব তথ্য আবিষ্কৃত হতে থাকবে ভবিষ্যতে। তবে একটা জিনিস ভাবতে পারেন, খাবার টেবিলে বসে আপনি ডাইনোসরের বংশধরদের চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছেন, তা জানতে পারলে ডাইনোসর মহাশয়েরা কী করতেন!

লেখক: শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার, বিবিসি