আম গবেষণার পীঠস্থান

এই পর্যায়ে এসে আমের প্রথম আঁতুড়ঘর কোথায় ছিল, সে প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না পাওয়া গেলেও ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের mango শব্দটির উৎপত্তি কিন্তু ভারতের তামিল man-key অথবা man-gay শব্দ থেকে

‘আয় ছেলেরা, আয় মেয়েরা/ ফুল তুলিতে যাই,/ ফুলের মালা গলায় দিয়ে/ মামার বাড়ি যাই।/ ঝড়ের দিনে মামার দেশে/ আম কুড়াতে সুখ...।’ জসীমউদ্‌দীনের এই কবিতার মামার দেশ কোথায়, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমের দেশ যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আম প্রাচীনতম ফলের মধ্যে অন্যতম, যা প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে এই উপমহাদেশে চাষ হয়ে আসছে। এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল আম। এখন পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। এই পর্যায়ে এসে আমের প্রথম আঁতুড়ঘর কোথায় ছিল, সে প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না পাওয়া গেলেও ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের mango শব্দটির উৎপত্তি কিন্তু ভারতের তামিল man-key অথবা man-gay শব্দ থেকে।

খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ থেকে পঞ্চম শতাব্দীতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ভারতের মালয় থেকে পূর্ব এশিয়া, তথা বিভিন্ন দেশে আমের চাষাবাদ ছড়িয়ে দেন। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং প্রথম পর্যটক হিসেবে ৬৩২ থেকে ৬৪৫ সালের মধ্যে চীন, তথা দূরপ্রাচ্যে আমের পরিচিত তুলে ধরেন। এ ছাড়া আরব বণিক ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা আমের চারা সেই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেন। ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে যখন ব্রাজিলে আম চাষ শুরু হয়, তখনো আম পশ্চিম গোলার্ধে পরিচিতি লাভ করেনি। ডাচ, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজদের অবদানে ধীরে ধীরে তা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আমেরিকা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সোমালিয়া, কেনিয়া, ফিলিপাইনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে।

বাংলাদেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে প্রায় ৮০০ প্রকারের আমের জাত, যার অধিকাংশই স্থানীয়। এর মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জেই প্রায় ৩৫০ ধরনের স্থানীয় জাতের আমের চাষ হয়। সুতরাং চাঁপাইনবাবগঞ্জ যে বাংলাদেশের আমের আঁতুড়ঘর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানেই ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আম গবেষণাকেন্দ্র। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিশ্বরোডের পাশেই প্রায় ৩০ একর জমির ওপরেই আম গবেষণার এই প্রতিষ্ঠান। পরে অবশ্য আম গবেষণাকেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাখা হয়েছে। এটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিষ্ঠান।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আমের ৩টি হাইব্রিড জাতসহ মোট ১৮টি সুমিষ্ট, উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ১৪টি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে হয়েছে, বাকি ৪টি রাজশাহীসহ অন্যান্য গবেষণাকেন্দ্র থেকে। বাংলাদেশে ১৯৯৩ সাল থেকে নতুন জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে ক্রসিং বা সংকরায়ণের কাজ শুরু করা হয়েছে।

নতুন আমের জাত কীভাবে উদ্ভাবন করা হয়

উপমহাদেশের প্রাচীনতম ফল হিসেবে বোঝাই যায় প্রকৃতিতেই প্রথম আমগাছ হয়েছিল। হয়তো সে আমের কোনোটি ছিল মিষ্টি, কোনোটি ছিল টক, কোনোটির সুঘ্রাণ ছিল, আবার কোনোটির ঘ্রাণ নাকে নেওয়ার মতো ছিল না, কোনোটির আঁটি বড়, কোনোটির ছোট, কোনোটির চ্যাপ্টা, কোনোটির শাঁস আঁশযুক্ত ছিল, কোনোটিতে আঁশ ছিল না। কিন্তু মানুষের পছন্দের আম হচ্ছে সুমিষ্ট আঁশহীন, রঙিন ও সুঘ্রাণবিশিষ্ট। বিজ্ঞানীরা আমের সব ভালো গুণ একটি আমের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য গবেষণা চালাতে থাকেন। এই গবেষণায় এসেছে আমের নতুন জাত। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের অন্য জায়গায় ফল গবেষণাগার থাকলেও আম গবেষণাগার কিন্তু একটিই—চাঁপাইনবাবগঞ্জে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটি নতুন জাতের আম উৎপাদন করা যায় না। এর পেছনে বিজ্ঞানীদের অনেক সময় ও শ্রম দিতে হয়।

আমের জাত উন্নয়ন সাধারণত চারটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা হয়: হাইব্রিডাইজেশন, ইনট্রোডিউচ, সিলেকশন ও মিউটেশন।

হাইব্রিডাইজেশন: এই পদ্ধতিতে একই প্রজাতিভুক্ত দুটি ভিন্ন গাছের উন্নত বৈশিষ্ট্যকে ক্রসিংয়ের মাধ্যমে একটি ফলে বা গাছে রূপান্তর করা হয়। এই ক্ষেত্রে একটি গাছকে মা এবং অন্য একটি গাছকে বাবা হিসেবে গণ্য করা হয়। বাবার ফুলের পরাগধানী থেকে পরাগরেণু মা ফুলের পরাগধানীর গর্ভমুণ্ডে স্থানান্তর করা হয়। এ জন্য এটিকে কৃত্রিম পরাগায়ন বলা হয়। এই পরাগায়নের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় আছে। দিনের ওই সময়ে মা ফুলের গর্ভমুণ্ড উন্মুক্ত হয়। সেই সময়ের জন্য বিজ্ঞানীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। মুহূর্তটি আসার সঙ্গে সঙ্গে বাবার পরাগরেণু মায়ের নির্দিষ্ট ফুলের গর্ভমুণ্ডে স্পর্শ করা হয়। এ জন্য অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। মা ফুলের ওই একটি ছাড়া অপর সব কটি পরাগধানী ভেঙে ফেলা হয়। যাতে অন্য কোনোভাবে সেগুলো থেকে প্রাকৃতিকভাবে পরাগায়ন ঘটে যেতে না পারে। যাহোক, এর মাধ্যমে নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পরবর্তী প্রজন্ম উৎপাদন করা হয়। সেই আমের আঁটি রোপণ করা হয়। সেখান থেকে গাছ হলে এবং সেই গাছের আম আমাদের চাহিদা অনুযায়ী উন্নত সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করলে কয়েক বছর পর্যবেক্ষণ করা হয়। তারপর জাত হিসেবে অবমুক্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে প্রথম বারি আম-৪ উদ্ভাবন করা হয়।

এই পদ্ধতিতে আশ্বিনা আমের মা ফুলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার রঙিন জাতের একটি আমগাছের বাবা ফুলের সংকরায়ণ ঘটানো হয়েছিল। এটি উচ্চ ফলনশীল নাবি জাতের একটি আম হয়েছে, যা সারা দেশে চাষযোগ্য আম। সংকরায়ণের ফলে আশ্বিনার চেয়ে এর গড় ওজন, মিষ্টতা, খাদ্যোপযোগী অংশ এবং আলো পেলে রংও উজ্জ্বল হচ্ছে। পরিবর্তিত এই আম গোলাকৃতির হয়েছে। আশ্বিনার গড় ওজন ৫৫৫ গ্রাম ছিল, এর হয়েছে ৬০০ গ্রাম। খাদ্যোপযোগী অংশ ৮০ শতাংশ। আগে খাদ্যোপযোগী ছিল ৭৭ শতাংশ। আগে আশ্বিনার মিষ্টতা ছিল ১৯ শতাংশ। এখন হয়েছে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এই আম জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়।

ইনট্রোডিউস: এই পদ্ধতিতে বিদেশি কোনো উন্নত জাতের গাছকে নিয়ে এসে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কয়েক বছর পর্যবেক্ষণ ও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করা হয়। বিদেশি ওই জাত আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারলে, ভালো ফলন দিলে এবং রোগবালাই কম থাকলে সেটি জাত হিসেবে অবমুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়। এভাবেই ভারত থেকে একটি আম আমাদের দেশে এসে হয়েছে বারি আম-৩ এবং সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে এসে একটি আম হয়েছে বারি আম-১৪।

সিলেকশন পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে দেশি বা বিদেশি কোনো জাতের বিভিন্ন জেনোটাইপ বা জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়। নিবিড় পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রোগবালাই কম, এ রকম জেনোটাইপ বা জার্মপ্লাজমকে নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ‘অ্যাডাপটিভ ট্রায়াল’–এর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতটির পারফরম্যান্স দেখা হয়। তারপর জাত হিসেবে অবমুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রকৃতিতে পাওয়া সাটিয়ারক্যাড়া জাতের একটি আমকে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করা হয়। এটিই এখন বারি আম-১ নামে পরিচিত। জাতটি বেশ সুস্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত এবং আকর্ষণীয় রঙের। প্রতিবছর ফল দেয়। বাণিজ্যিক জাত গোপালভোগের সঙ্গেই সংগ্রহ করা যায়।

মিউটেশন পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে কোনো একটি গতানুগতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জাতের বা জার্মপ্লাজমের প্রাকৃতিকভাবে বা কৃত্রিম পদ্ধতিতে (তেজস্ক্রিয় রশ্মির দ্বারা) কোনো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়ে নতুন জাতে পরিণত হয়। এটিও বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে কয়েক বছর দেখা হয়। পরে তা নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়।

আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

আম গবেষণার আঁতুড়ঘরে এক দিন

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত প্রায় ৩০ একর আয়তনের এই বাগানের গাছগুলোর সারিই বলে দেয় যে গবেষণার জন্যই তাদের জন্ম হয়েছে। ফটক পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই বাঁ পাশে চোখে পড়ে ক্ষীরশাপাতি আমের একটি ভাস্কর্য। জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে ক্ষীরশাপাতিকে এভাবে রাখা হয়েছে।

গত ২০ এপ্রিল দুপুরে গিয়ে সেখানে সাক্ষাৎ পাওয়া গেল প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমান, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকতা মো. কামরুল ইসলাম, রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আলীম উদ্দীন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. ইউসুফ আলীসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।

বিজ্ঞানীরা বলেন, জায়গাটি আগে লাক্ষা গবেষণাকেন্দ্র ছিল। ১৯৮৫ সালে এটিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণাকেন্দ্র করা হয়। লাক্ষা গবেষণাকেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু স্মৃতি হিসেবে এখনো লাক্ষা গবেষণাকেন্দ্রের কার্যালয়টি রয়েই গেছে। আম গবেষণাকেন্দ্রের বর্তমান নাম রাখা হয়েছে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এখন এখানে আম ছাড়াও অন্যান্য ফল নিয়েও গবেষণা শুরু হয়েছে। এ জন্যই প্রতিষ্ঠানের নামে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।

আম্রপালি আমের সঙ্গে ল্যাংড়া আমের সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন জাত তৈরি করা হয়েছে

ভেতরে ঢুকেই মনের মধ্যে কেবল উসখুস করতে লাগল, ঠিক এই মুহূর্তে কতগুলো আম আঁতুড়ঘরে রয়েছে। জানা গেল, এ বছর তিন হাজার ফুলের রেণু সংকরায়ণ করা হয়েছে। তবে এই সংকরায়ণের প্রক্রিয়াটি খুবই অনিশ্চিত। টেকে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ। এবার বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন আম্রপালি আমের সঙ্গে ল্যাংড়া আমের সংকরায়ণের মাধ্যমে নতুন একটা জাত তৈরির। আম্রপালির মিষ্টি স্বাদ যেমন পাওয়া যাবে। তার সঙ্গে ল্যাংড়ার ঘ্রাণ ও স্বাদ। একটি আম্রপালির গাছে এই আমের গুটি বড় হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখালেন সেই আম। তার সঙ্গে একটি ট্যাগ ঝুলিয়ে দেওয়া রয়েছে। নিজ হাতে আগামী দিনের আমটি ছুঁতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বিজ্ঞানীরা বললেন, ‘আমটি যদি আমাদের প্রত্যাশিত গুণসম্পন্ন হয়, তাহলে এর আঁটি বীজ হিসেবে রোপণ করা হবে। তা থেকে গাছ হলে সেই গাছের আম কয়েক বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি দেখা যায় সেই আম প্রত্যাশিত গুণসমৃদ্ধ হয়েছে, তাহলে তখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এটিকে নতুন জাত হিসেবে অবমুক্ত করবে। দেশ একটি নতুন আম পাবে।’

আম্রপালি আম বাংলাদেশে এল কী করে

আম্রপালি নাবি জাতের একটি আম। উৎকৃষ্ট এবং উচ্চ মানসম্পন্ন আমটি সংকর জাতের। উত্তর ভারতের (লক্ষ্ণৌ অঞ্চল) বিখ্যাত আম দুসেহরি ও দক্ষিণ ভারতের অন্য একটি বিখ্যাত জাত নীলম—এই দুটির মধ্যে সংকরায়ণ ঘটিয়ে আম্রপালির জন্ম। বিজ্ঞানীরা নীলম জাতের পুরুষ মুকুল (ফুল) ও দুসেহরি জাতের স্ত্রী মুকুল (ফুল) একত্র করে পরাগায়ন ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছেন মনোলোভা অভিজাত শ্রেণির আম আম্রপালি। ১৯৭৮ সালে আমটির নামকরণ করে ভারতে প্রথম ছাড় করা হয়। ফলটির নামকরণের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক এক প্রেক্ষাপট।

ভারতের বিহার রাজ্যের প্রাচীনকালে (খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দ) বৃজি নামের একটি গণযুক্ত রাষ্ট্র ছিল। এই রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল বৈশালী (মুজফ্ফরপুর রেলস্টেশন থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে)। বৈশালীর রাজোদ্যানে আম্রবৃক্ষের পাদমূলে অম্বপালির (পালি ভাষায় আম্রকে অম্ব বলা হয়) জন্ম হয়। নগরের উদ্যানপালক অম্বপালের ভরণপোষণের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। উদ্যানপালকের কন্যা বলে তাঁর নাম হয় অম্বপালি বা আম্রপালি। বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আম্রপালির সব অঙ্গ অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে গড়ে উঠতে থাকে। কোথাও এতটুকু খুঁত নেই। এরপর আম্রপালি হলেন রাজ্যের সভানর্তকী। কারণ, সে আমলে বৈশালীতে আইন ছিল, অনিন্দ্যসুন্দর নারী কখনো পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবেন না। জনসাধারণের আনন্দের জন্য তাঁকে উৎসর্গ করা হবে। আম্রপালি সুন্দরী, মহিমাময়ী, মনোহারিণী ও সর্বোৎকৃষ্ট বর্ণসুষমার অধিকারী ছিলেন। নাচগান ও বীণাবাদনে সেকালে তাঁর তুলনা ছিল না। তিনি পালি ভাষায় কবিতাও রচনা করতেন। সেকালের বহু পদমর্যাদাশীল গুণীজন তাঁর ভক্ত ছিলেন। মগধের রাজা বিম্বিসার নিজেও আম্রপালির গুণমুগ্ধ ছিলেন। আম্রপালি গৌতম বুদ্ধের বাণী শুনে ভিক্ষু সংঘে যোগ দিয়ে নিজের আম্রকানন সংঘকে দান করেছিলেন। শেষজীবনে তিনি দিব্যজ্ঞান অর্জনে চেষ্টা করেছিলেন। স্বীয় দেহের ক্রমবর্ধনশীল প্রকৃতি তাঁর দৃষ্টিগোচরে আসে। পৃথিবীর সব বস্তুর নশ্বরত্ব তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিজ্ঞানীরা আমটির নামকরণ করে আম্রপালিকে অমরত্ব দান করেছেন সন্দেহ নেই। আম্রপালি তার পিতৃ ও মাতৃগুণের (দুসেহরি ও নীলম) চেয়ে অনেক উন্নত। ফলটি দেখতে লম্বাটে, নিম্নাংশ অনেকটা বাঁকানো। গড় ওজন ১৭০ থেকে ২৫০ গ্রাম। পোক্ত অবস্থায় ত্বকের রং সবুজ, পাকলে ঈষৎ হলুদ রং ধারণ করে। ত্বক মসৃণ, খোসা পাতলা। খোসার রং কমলা, অত্যন্ত রসাল, সুস্বাদু ও সুগন্ধযুক্ত। আমটিতে কোনো আঁশ নেই। অত্যন্ত কড়া মিষ্টির এই আমের খাদ্যাংশ রয়েছে ৭৫ শতাংশ। মিষ্টতার পরিমাণ ২৪ শতাংশ। আমটি কেটে খাওয়ার উপযোগী। আমগাছ বামনাকৃতির। কম দূরত্বে; অর্থাৎ ২ দশমিক ৫ মিটার পরপর রোপণ করা সম্ভব। এভাবে প্রতি হেক্টরে ১ হাজার ৬০০ গাছ রোপণ করা যাবে। গাছে প্রচুর ফল ধরে। প্রতিবছর ফল আসবে। ফলন হেক্টরপ্রতি ১৬ টন। আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহে ফল পাকা শুরু হয়। ফুল আসা থেকে পরিপক্ব হতে পাঁচ মাস সময় লাগে। ফল সংগ্রহের পর পাকতে পাঁচ থেকে ছয় দিন সময় লাগে। সংরক্ষণশীলতা ভালো। ইনট্রোডিউস পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আমটিকে বারি আম-৩ হিসেবে অবমুক্ত করে। এর পর থেকে বাংলাদেশে প্রায় সব জেলাতেই এই জাতের আম চাষ করা হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল এবং বর্তমানে বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় আম হচ্ছে আম্রপালি বা বারি আম-৩।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, বারি আম-৩ ও বারি আম-৪ নওগাঁয় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বাণিজ্যিকভাবে সফল এই জাতের কারণে ধানের দেশ নওগাঁয় অচিরেই আমের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখক: সাংবাদিক, প্রথম আলো