সাক্ষাৎকার

আইন আমাদের সবই আছে, প্রয়োগ নেই; প্রয়োগ করতে হবে—মেহেদী আহমেদ আনসারী, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক তিনি। ভূমিকম্প ও ভূতত্ত্ব প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ। বুয়েট থেকে পুরকৌশলে অনার্স শেষ করেছেন, একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন ভূতত্ত্ব প্রকৌশলে। এরপর জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূকম্পন প্রকৌশলে পিএইচডি করে ফিরে এসেছেন দেশে। শিক্ষকতার পাশাপাশি ভবন আইন নিয়ে কাজ করছেন, ভূমিকম্পের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে রাখছেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি মেহেদী আহমেদ আনসারী। সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের নির্মমতা দেখেছে বিশ্ব। বাংলাদেশেও বেশ কিছু ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু বড় ধরনের ভূমিকম্পের জন্য রাজধানী ঢাকা বা দেশের অন্যান্য অঞ্চল কতটা প্রস্তুত? এ বিষয়ে করণীয় কী? এসব নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তার সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। বিজ্ঞানচিন্তার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ইফতেখার মাহমুদ ও বিজ্ঞানচিন্তার সহসম্পাদক উচ্ছ্বাস তৌসিফ

বিজ্ঞানচিন্তা :

কেমন আছেন?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: ভালো আছি। একটু ছোটাছুটির মধ্যে আছি আরকি। তবে কাউকে তো এই কথাগুলো বলতে হবে। এটা আমারও দায়িত্ব। সেটাই করার চেষ্টা করছি যথাসম্ভব।

আমি ভূমিকম্প নিয়ে ৩০ বছর ধরে কাজ করছি। আমার একটা ভালো সুবিধা আছে। আমি প্রকৌশলী, তবে সাইসমোলজি নিয়েও কাজ করেছি। আমার পিএইচডি গবেষণাও এ (ভূমিকম্প) নিয়ে। এ ছাড়া আমি দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল সদস্য হিসেবেও ২০ বছর কাজ করেছি। এই মন্ত্রণালয়ের অনেক যন্ত্রপাতিই আমার হাত দিয়ে কেনা। কাজেই দায়িত্ব হিসেবে আমি চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব করতে।

ইউনিয়ন অব চেম্বারস অব টার্কিশ ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টসের অফিস রয়েছে এই ভবনে (গোলচিহ্নিত ভবনটি)। নিয়ম মেনে বানানো এ ভবন সামলে নিতে পেরেছে ভূমিকম্পের প্রচণ্ড কম্পন
ছবি: সংগৃহীত

বিজ্ঞানচিন্তা :

তাহলে ঢাকা থেকেই শুরু করি।

মেহেদী আহমেদ আনসারী: হ্যাঁ, ঢাকা থেকেই শুরু করতে পারেন। কারণ, অন্যান্য অঞ্চলের জনসংখ্যা তো অনেক কম। তুরস্কের মতো ভূমিকম্প হলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ঢাকা। শুধু ঢাকা শহরের অধিবাসীই ধরুন দুই কোটি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি হলে ১০ শতাংশের বেশি। আর পুরো ঢাকা বিভাগের জনসংখ্যা তো প্রায় চার কোটির মতো। কাজেই হ্যাঁ, এ নিয়ে আমাদের কথা বলতে হবে গুরুত্ব দিয়ে।

ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালের কাঠমাণ্ডুতে উদ্ধারকাজ চলছে। নিহত বা আহতদের নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রাখা আছে স্ট্রেচার।
ছবি: রয়টার্স

বিজ্ঞানচিন্তা :

প্রথমে জানতে চাই, তুরস্কের মতো ভূমিকম্পের জন্য ঢাকা শহর কতটা প্রস্তুত? এর ভবনগুলো কতটা প্রস্তুত?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: এখানে প্রস্তুতির দুটি দিক আছে। ধরুন, কোনো এক জায়গায় বিল্ডিং ভেঙে গেছে। যদি তুরস্কের কথা বলি, তুরস্কে ধরা যাক ১৫টি বিল্ডিং আছে এক জায়গায়, এর মধ্যে ৫টা ভেঙে গেছে। এর কারণ, হয় বিল্ডিংগুলো বিল্ডিং কোড অনুযায়ী তৈরি হয়নি অথবা বিল্ডিংয়ের নিচের মাটি খারাপ অথবা বিল্ডিংটা বিল্ডিং কোড তৈরির আগেই তৈরি হয়েছে। এই তিনটা কারণেই কেবল একটা বিল্ডিং ভাঙতে পারে।

সাধারণত ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বলা হয়, ৯০ শতাংশ মানুষ বিল্ডিংয়ের মাধ্যমেই নিরাপদ থাকবে। বাকি ১০ শতাংশ ভবনধসের কারণে বিপদে পড়তে পারে। তাদের উদ্ধারের জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি লাগবে। বিবিসি সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলেছে, একটা মানুষকে বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে উদ্ধার করতে এক থেকে দুই কোটি টাকা খরচ হয়। ওরা এক জায়গায় চার কোটিও বলেছে, আমি একটু কমিয়েই ধরছি। এটা ধরছি অভিজ্ঞতা থেকে। র৵াংগসের অবৈধ ভবন উচ্ছেদ কমিটিতে আমি কাজ করেছি। ওয়াহিদ ম্যানশন তদন্ত ও রানা প্লাজার কমিটিতেও কাজ করেছি। এফ আর টাওয়ারেও কাজ করেছি। মানে বিষয়টা আমি জানি, বুঝি।

এখানে বিষয়টা হলো, বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে একজন মানুষকে উদ্ধার করতে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ লোক লাগে। গাড়ি লাগে। তেল লাগে। কারণ, যে যন্ত্র দিয়ে বিল্ডিং কেটে মানুষকে উদ্ধার করতে হবে, সেটার জন্য তেল প্রয়োজন। একজন মানুষকে উদ্ধার করতে অনেক সময় দেখা যায়, দু-তিন দিন লেগে যায়। কমপক্ষে এক দিন তো লাগেই। এর পেছনে সোর্স, কংক্রিটগুলো কাটতে যে তেল খরচ, এগুলোর পেছনে খরচ কিন্তু অনেক।

আর একটা নতুন, সদ্য নির্মিত বিল্ডিংকে ভূমিকম্প সহনীয় করতে প্রতি বর্গফুটে ২০০ টাকার মতো খরচ হয়। আর নতুন একটা বিল্ডিং করার সময় প্রতি বর্গফুটে খরচ হয় ৩০০০ টাকা। সে তুলনায় ২০০ টাকা কত শতাংশ হয়? অনেক কম। সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। পাঁচ কাঠার মধ্যে নির্মিত একটা ছয়তলা বিল্ডিং ঠিকঠাক করার জন্য রেট্রোফিটিং কস্ট (নির্মাণের সময় ছিল না, এমন প্রয়োজনীয় জিনিস যোগ করার খরচ) ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার মধ্যে হয়ে যায়, মানে মজবুতকরণ। সে তুলনায় ভূমিকম্পে ভবনধস বা সেখান থেকে একজন মানুষকে বের করে আনার খরচ কিন্তু অনেক বেশি।

এ কথা বলার কারণ হলো, যেকোনো ভূমিকম্পের সময় আমরা দুই ধরনের ব্যবস্থা নিই। এক, স্ট্রাকচারাল বা গঠনগত ব্যবস্থা। দুই, নন-স্ট্রাকচারাল ব্যবস্থা।

নন-স্ট্রাকচারাল হলো এসব যন্ত্রপাতি কেনা বা সংগ্রহ করা, ফায়ার সার্ভিসকে ট্রেনিং দেওয়া ইত্যাদি। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আবার স্বেচ্ছাসেবী, আমরা বলি ‘কমিউনিটি ভলান্টিয়ার’—মানে সমাজের নানা স্তরের মানুষকে যুক্ত করা। এটার সুবিধা হলো, রানা প্লাজা বা এ রকম যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে এই স্বেচ্ছাসেবীরাই কিন্তু প্রথম প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষকে উদ্ধার করেছে। এরপর ফায়ার সার্ভিস বাকি যে ২০ শতাংশ মানুষকে যন্ত্রপাতি দিয়ে কংক্রিট কেটে উদ্ধার করা প্রয়োজন ছিল, সেটা করেছে। তবে এটা খুব খরচের।

নন-স্ট্রাকচারাল ব্যবস্থার মধ্যে কিন্তু আরও বিষয় আছে। যেমন ব্যাংক যদি বাসা মজবুত করার জন্য কম সুদে টাকা দেয়। আবার যদি, ইনস্যুরেন্স করা থাকে। বিল্ডিং হয়তো একদিন ভাঙবে। কিন্তু আমরা তো ২০ বছর ধরে ইনস্যুরেন্স দেব। যে টাকাটা এর মধ্যে জমা হয়, ইনস্যুরেন্স তো সেই টাকাটাই দেয়।

তুরস্কের কথা আমি পুরোপুরি জানি না। জাপান আর যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলি। জাপানে একটা ভূমিকম্প হলো ১৯৯৪ সালে, পরের বছর, মানে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটা ভূমিকম্প হলো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ ইনস্যুরেন্স করে রাখে। ফলে মোট ক্ষয়ক্ষতি কয়েক শ বিলিয়ন ডলারের হলেও কোম্পানিগুলো কিন্তু প্রায় অর্ধেকের মতো অর্থ দিয়েছে এ সময়। আর জাপানে ইন্স্যুরেন্সের হার ১৫ শতাংশ। তার মানে, কোম্পানিগুলো এ সময় মোট ক্ষয়ক্ষতির মাত্র ১৫ শতাংশের টাকা দিয়েছে।

ইনস্যুরেন্স করার সুবিধা হলো, বিল্ডিং ভেঙে পড়লে কোম্পানিগুলো এ সময় পে করতে বাধ্য হয়। ফলে সরকারের ওপর চাপ কমে যায়। এগুলো সবই নন-স্ট্রাকচারাল ব্যবস্থা। এ রকম আরেকটা বিষয় হলো, আমাদের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (ইওসি) করা দরকার বুঝেশুনে। অনেক সময় দেখা যায়, যেখানে বিল্ডিং ভাঙল, তার পাশেই ইওসি করা হয়েছে। তাহলে আবার যদি ভূমিকম্প হয়, তখন তো পাশের স্থাপনা সহজেই ভেঙে যাবে। ইওসি করার নিয়ম খানিকটা ভিন্ন। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং সিলেট সিটি করপোরেশনে ইওসি করা হয়েছে। এটা করলে মূলত মানবসম্পদ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয় করাও অনেক সহজ হয়ে যায়।

এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু ঘাটতি আছে। মোট ৬৭টা আইন আছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার। কিন্তু এগুলোর সে রকম প্রয়োগ নেই। যেমন অগ্নিনির্বাপণের আইন আছে, ২০০৩ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। ভবন নির্মাণের বিধিমালা আছে ১৯৯৩, ২০০৮ ও ২০২০ সালে প্রণীত বিধিমালা, কিন্তু সে রকম প্রয়োগ নেই। অর্থাৎ, আইন আমাদের সবই আছে, প্রয়োগ নেই; প্রয়োগ করতে হবে। এগুলো মেনে চলা শুরু করা মানে আমাদের নন-স্ট্রাকচারাল ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করা।

স্ট্রাকচারাল ব্যবস্থা নিয়ে যদি কথা বলি, একটু ইতিহাস বলতে হয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমরা ৩ হাজার ৫০০ ফ্যাক্টরির বিল্ডিংগুলো পরীক্ষা করেছি। সম্প্রতি আরবান রেজুলেন্সের ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রজেক্ট, যেটা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে রাজউক করল, সেখানে আমরা ৩ হাজার ২৫০টি স্কুল ও হাসপাতাল বিল্ডিং পরীক্ষা করে দেখেছি। প্রতিটি বিল্ডিং পরীক্ষা করতে প্রায় এক মাস সময় লেগেছে। আমরা প্রতিটি বিল্ডিংকে কালার কোড করে দিয়েছি। যে বিল্ডিংটি এখনই ভেঙে ফেলতে হবে বা সংস্কার করতে হবে, সেটা লাল। যেটা মাঝারি খারাপ সেটা হলুদ আর যেগুলো একদম ভালো, সেগুলো সবুজ। এভাবে আমরা বিল্ডিংয়ের গায়ে তিন রঙের প্লাস্টার সেঁটে দিয়েছিলাম। ফলে কোনটা খারাপ, কোনটা মধ্যম আর কোনটা ভালো বিল্ডিং, সেগুলো চিহ্নিত করা গেছে। আমরা দেখেছি, স্কুল ও গার্মেন্টস বিল্ডিয়ের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বিল্ডিং খুবই খারাপ বা বিপজ্জনক। খুব দ্রুত এগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন। ২৫ শতাংশ বিল্ডিং মধ্যম মানের। প্রায় ৫০ শতাংশ ভবন ভালো আছে।

এখন ঢাকা শহরে তো প্রায় ছয় লাখ বিল্ডিং। মানে মোট ২১ লাখ স্থাপনার মধ্যে ৬ লাখ পাকা দালান। আমরা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজউকের সভায় আলোচনা করেছি, এগুলো খুব দ্রুত পরীক্ষা করতে হবে। এর খরচ বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিকদেরই হয়তো বহন করতে হবে।

একটা প্রচলিত কথা হলো, ঢাকায় ৭২ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিং আছে। কিন্তু এটার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। এই হিসাব অনেক আগের, আর এটা একটা ধরে নেওয়া হিসাব। বলতে হলে এখন আমাদের একদম নির্দিষ্ট করে বলতে হবে ঠিক কতগুলো ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে। এটা জরুরি।

তখন আমাদের রিসোর্স ছিল না। এখন আমাদের সেই রিসোর্স আছে। আর এটা তো মানুষকে ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকে, প্রাণহানি থেকে, ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্যই করা। এই ঝুঁকিগুলো তাই চিহ্নিত করা জরুরি। সে জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, মানুষের প্রাণের মূল্য সবচেয়ে বেশি।

ঢাকায় অন্তত ৫০টি সক্ষম বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম আছে, সারা বাংলাদেশে ১০টির মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। রাজউকের সক্ষমতা আছে। প্রায় ৬০টির মতো প্রতিষ্ঠান আছে, ধরা যায়। এগুলোকে কাজে লাগালে রাজউকের আটটি অঞ্চলের প্রতিটি বাড়িকে ধীরে ধীরে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব। এর মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে কোন বিল্ডিংয়ের কী অবস্থা, সেটা বের করা যাবে। তখন প্রয়োজন অনুযায়ী খারাপ বিল্ডিংগুলোকে সংস্কার করে ভূমিকম্প সহনীয় করে তোলা যাবে।

বিজ্ঞানচিন্তা :

সংশ্লিষ্ট একটা প্রশ্ন করি। এখানে আমরা ‘ভূমিকম্প সহনীয়’ করার কথা বলছি। এটা ঠিক কত মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় হবে?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: এখানে মাত্রা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে তুরস্কে যে ঘটনা ঘটেছে, যেসব বিল্ডিং ভেঙে গেছে, আমাদের এখানে এ রকম বিল্ডিং অনেক।

এই ছবিটা (আগের পৃষ্ঠার) দেখুন। চারপাশের সব বিল্ডিং ভেঙে গেছে। মাঝখানে একটা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। এই বিল্ডিংটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের বিল্ডিং। ইউনিয়ন অব চেম্বারস অব টার্কিশ ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টসের লোকাল অফিস এই বিল্ডিংয়ে। প্রকৌশলীরা এই বিল্ডিং একদম নিয়ম মেনে তৈরি করেছেন। তাই এটা টিকে গেছে। অথচ আশপাশের সব বাড়ি ভাঙা।

চিলিতে ২০১০ সালে একটা ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৫০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। একই সময়ে হাইতিতে ৭.৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে মারা গেছেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। এটার কারণ, এই বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট (ভবন নির্মাণ আইন মানা ও সবাইকে মানতে বাধ্য করা)। এটাই আমি রাজউকসহ সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, বিল্ডিং কোড এনফোর্সমেন্ট ছাড়া আমাদের গতি নেই।

যে বিল্ডিংয়ে বিম নেই, সেটিকে আমরা বলি ফ্ল্যাট স্ল্যাব। তুরস্কের অনেক ভাঙা বিল্ডিয়ে দেখা গেছে, ছাদের নিচেই কলাম, কোনো বিম নেই। আবার অনেক বিমে যথেষ্ট রড নেই। বিল্ডিং কোডে কলামে অনেক ঘন ঘন রড দেওয়ার কথা বলা আছে। এটা না মানাতেই বেশির ভাগ বিল্ডিং ভেঙে গেছে। আমাদের দেশেও অনেক আর্কিটেক্ট বা স্থপতি এ ধরনের ফ্ল্যাট স্ল্যাব বিল্ডিং পছন্দ করেন। এ জন্য আমরা তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে চাচ্ছি। এটার প্রয়োজনীয়তা তাঁদের বোঝাতে হবে। আর এ রকম বিল্ডিং ইতিমধ্যে আমাদের অনেক তৈরি করা আছে। বড় বড় বিল্ডিংও আছে অনেক এ রকম। এ ধরনের বিল্ডিং হলে ভূমিকম্পের সময় বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তুরস্কে যেসব বিল্ডিং ভেঙে গেছে, সব এমন ফ্ল্যাট স্ল্যাব। অর্থাৎ ঘন রড দেওয়া নেই। আর কলামটা ঠিক স্ল্যাবের নিচে। বিম নেই। কলাম ও বিম চিকন হলেও সমস্যা।

মোটা কলাম ও বিম এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়। তাই ভূমিকম্প সহনীয় মানে মোটা বিম ও মোটা কলাম যুক্ত বিল্ডিং। আর মাটির বিষয়ও আছে। নরম মাটির কারণে তুরস্কে বিল্ডিং পুরো উল্টে গেছে। নরম মাটির রেললাইন পুরো বেঁকে গেছে। নরম মাটি থাকলে সমস্যা, তবে যথাযথভাবে ব্যবস্থা নিয়ে, মাটিকে উন্নত ও উপযুক্ত করে নিয়ে তার ওপর বাড়ি বানালে কোনো সমস্যা নেই।

বিজ্ঞানচিন্তা :

এবারে তাহলে নরম মাটি ও শক্ত মাটিতে ভূমিকম্প ছড়ানোর বিষয়টি একটু সহজভাবে বলুন।

মেহেদী আহমেদ আনসারী: নরম মাটিতে ভূমিকম্পের মাত্রাটা বেড়ে যায়। মেক্সিকোতে এর একটা ক্ল্যাসিক উদাহরণ আছে। মেক্সিকো শহর একটা বাটি বা গামলার মতো। চারদিকে পাড় (পাহাড়), মাঝখানে নরম মাটির স্তর। ১৯৮৫ সালে মেক্সিকোর মূল শহর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে একটা ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পে সব উঁচু দালানগুলো ভেঙে পড়ে, প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মারা যায়। শুধু নরম মাটির কারণে। উঁচু বিল্ডিং নরম মাটিতে বানালে বেশি ক্ষতি হয়। এক-দুতলা দালানে সে তুলনায় ক্ষতি কম হয়।

এগুলো টেকনিক্যাল বিষয়, তবে বিল্ডিং কোডে এগুলো আছে। তবে সে অনুযায়ী প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সদ্য পাশ করে কাজ করতে আশা অনেক প্রকৌশলী এসব খুঁটিনাটি হয়তো জানে না। এটা তাদের দোষ না, তাদেরকে সেজন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে, শেখাতে হবে। ছয়-সাত মাস প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন সেজন্য। আবার কর্মরত অনেক প্রকৌশলীও একদম নতুন বিল্ডিং কোড জানেন না। তাঁদেরও ২০২০ সালে প্রণীত কোড জেনে নিতে হবে, সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে তুরস্কে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে
ফাইল ছবি: এএফপি

বিজ্ঞানচিন্তা :

আমাদের অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব এই আলোচনা থেকেই পেয়ে গেছি। তাই এবারে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। ভূমিকম্পের তো পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। কিন্তু অনেকে বলেন, কয়েক সেকেন্ড আগে অনুমান করা যায়। এ বিষয়ে একটু বলুন।

মেহেদী আহমেদ আনসারী: আমি পিএইচডি করেছি জাপানে। টোকিও গ্যাস কোম্পানির জন্য আমার অধ্যাপক এই সিস্টেমটা গড়ে তুলেছিলেন সে সময়। আমি এটা ক্লাসে পড়াইও।

২০১৫ সালে নেপালে একটা ভূমিকম্প হয়। তখন সরকার থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয় তিতাস গ্যাস কোম্পানির জন্য এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নের। তখন আমি জাপানে আমার অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র যোগাড় করে দিই।

সিসমোমিটার নামে একটা যন্ত্র আছে, ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র। মূলত শহরের বাইরে মাটির ৩০ বা ৫০ মিটার নিচে এটা বসাতে হয়। টোকিও শহরের বাইরে পাঁচটা জায়গায় এ রকম যন্ত্র বসানো আছে। ভূমিকম্প আসার সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো সেটা রেকর্ড করে। আর শহরের মাঝখানে টোকিও গ্যাস কোম্পানির ছাদে বসানো হয় রেডিও মডেম, এটা সে সময়েরই কথা। ১৯৯৩ সালে আমি যখন পিএইচডি করি, তখনকার। তো, ভূমিকম্প আসার সঙ্গে সঙ্গে ওই ডেটা সিসমোমিটার থেকে রেডিও তরঙ্গে এই মডেমে চলে আসে।

সে সময় একবার ভূমিকম্প হয়। তখন ওই সিগন্যাল সঙ্গে সঙ্গে মূল কার্যালয়ে পৌঁছে যায়। এভাবে সর্বোচ্চ ১৫ সেকেন্ড সময় পাওয়া যায়। জানা যায়, ভূমিকম্পের প্রথম ওয়েভটা আসছে। তখন ওরা সেটা সবাইকে জানিয়ে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস সিস্টেমটাকে বন্ধ করে দেয়। একইভাবে ওদের বুলেট ট্রেনকেও বন্ধ করে দেয়। যেখানে আছে, সেখানেই ওটা দাঁড়িয়ে যায়। চলমান থাকলে লাইন থেকে ট্রেনের ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গ্যাস চালু থাকলে আগুন লাগার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

এটা মানুষকে হয়তো প্রত্যক্ষভাবে অনেক সুবিধা দেবে না। তবে এটুকু সময়ে তারা হয়তো দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াতে পারবে। মাথাটাকে সুরক্ষা দেবে। আর গ্যাস কোম্পানি গ্যাস বন্ধ করে দিতে পারবে। ট্রেন থামাতে পারবে। কারণ, এগুলো সব বিদ্যুতের দ্বারা চলে।

এখন বিষয়টা হলো, একটা ঘটনা ঘটার পরে আমরা সচেতন হই। বড় দুর্যোগ না ঘটলে আমরা অতটা সচেতন হতে চাই না। তবে এটা আমাদের করতে হবে। এটা হয়তো প্রত্যক্ষভাবে সাধারণ মানুষের অনেক কাজে লাগবে না। তবে পরোক্ষভাবে অনেক প্রাণ বাঁচবে।

তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প
ছবি: রয়টার্স

বিজ্ঞানচিন্তা :

এবারে একটু ঢাকার বাইরের অঞ্চলগুলো নিয়ে কথা বলি। আমরা জানি, চট্টগ্রাম ও সিলেটে বেশ কিছু ফল্টলাইন আছে। সে ক্ষেত্রে এসব অঞ্চলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কতটা?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: এখানে পাঁচটা মেজর ফল্টলাইন আছে। ডাউকি ফল্ট লাইনে ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, মধুপুরে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৮৮৫ সালে। প্লেট বাউন্ডারি ১-এ ১৭৬২ সালে ৮ দশমিক ৫ মাত্রার, প্লেট বাউন্ডারি ২-এ ১৯৮০ সালে শ্রীমঙ্গলে ভূমিকম্প, প্লেট বাউন্ডারি ৩-এ ১৮৬৯ সালে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার কাছাকাছি ভূমিকম্প হয়।

এখানে বিষয়টা হলো, ভূমিকম্প ঢাকার বাইরে হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তবে ভূমিকম্পে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেশি ঢাকায়। কারণ, ঢাকায় বসতি বেশি, মানুষ বেশি। তাই ঝুঁকি বেশি। তবে ঢাকায় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু বিষয়টা হলো, ঝুঁকি না কমালে সমস্যা আছে। এ ধরনের একটা বড় ভূমিকম্প হয়ে গেলে, প্রাণহানি হলে তখন কিছু করা কঠিন। সেজন্য আমাদের এই কাজগুলো এক্ষুনি করতে হবে।

বিজ্ঞানচিন্তা :

তাহলে, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি মানুষ সচেতন হতে পারে। সাবধানতাগুলো মেনে চলতে পারে। এ ছাড়া আর কী কী উদ্যোগ নেওয়া যায়?

মেহেদী আহমেদ আনসারী: প্রশিক্ষণ। আমাদের এখনই প্রকৌশলী ও প্ল্যানারদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নতুন গ্র্যাজুয়েশন করে যারা কাজে নামছে, তাদের অন্তত তিন মাসব্যাপী ভবন নির্মাণ আইন নিয়ে ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর কর্মরত, প্রফেশনাল প্রকৌশলীদেরও কমবেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কারণ, তারা পুরোনো বিল্ডিং কোডগুলো জানে। নতুনগুলো সেভাবে হয়তো জানে না। এগুলো আগেও বলেছি, তবে এগুলোই মূল কাজ। আমাদের করতে হবে।

পুরোনো বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি নতুন বিল্ডিংগুলোকেও চেকিংয়ের আওতায় আনতে হবে। না হলে এগুলো ভূমিকম্প সহনীয় হবে না। রাজউকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কাজ করতে হবে। এগুলো হলো প্রকৌশলগত কাজ।

এর বাইরে ইনস্যুরেন্স, ব্যাংকের সফট লোন (কম সুদে লোন দেওয়া), হয়তো সরকারের একজন কো–অর্ডিনেটর ঠিক করে দেওয়া।

শহরের যে চালিকা শক্তি, গ্যাস-বিদ্যুৎ যা কিছু আছে, এগুলো পরিপূর্ণ কো–অর্ডিশনে আনতে হবে। একজন কো–অর্ডিনেটর থাকবেন, যিনি এ ধরনের দুর্যোগে সবকিছুর সমন্বয় করবেন।

দুর্যোগের একটা দিক দালান ভেঙে পড়া। আরেকটা দিক হলো মানুষকে ম্যানেজ করা, সাহায্য করা। এর জন্য ফান্ড ম্যানেজ করা, মোবিলাইজ করা, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সঙ্গে সমন্বয় করা, তাঁদের সব বিষয়ে নিয়মিত তথ্য দেওয়া এবং নির্দেশানুযায়ী বাকিদের পরিচালনা করা।

এগুলো করা অসম্ভব নয়। এর একটা উদাহরণ হলো, ২০০৭ সালে সিডরের সময় সরকার এমনটা করেছে। এ সময় মন্ত্রী পর্যায়ের মানুষদেরও বরিশালে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা কাজ করেছেন। কারণ, সিডর বরিশাল, ভোলা ও ঝালকাঠির দিকে বড়সড় আঘাত হানে। ঢাকায় বসে তাঁরা তখন যথাযথ সমন্বয় করতে পারছিলেন না। এ রকমটা সরকার আরও অনেক দুর্যোগের সময় করেছে। দুর্ঘটনাস্থলে গেছে, কাজ করেছে। বিদেশি সাহায্যগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। সেটা করা গেছে, কারণ সিডরের মতো ঘূর্ণিঝড় সামলানোর জন্য সরকারের আগে থেকে অনেকটা প্রস্তুতি ছিল। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ সাহায্য করেছে।

ভূমিকম্পের জন্য আমাদের প্রথমে এই প্রস্তুতিটা নিতে হবে। তারপর সরকারের একজন সমন্বয়ক থাকলে তিনি বাকিটা করতে পারবেন। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বয় করা, ইওসি পরিচালনা, সেনাবাহিনীকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সিভিল রিসোর্স বা সাধারণ স্বেচ্ছাসেবীদের যথাযথ ও দক্ষভাবে নির্দেশনা দেওয়া ও পরিচালনা করা মানে সবার সঙ্গে একটা সমন্বয় করা। এটুকু করলেই অনেক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।

বিজ্ঞানচিন্তা :

আশা করি, আমরা এগুলো যথাযথভাবে করতে পারব এবং ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি যেন না হয়, তা যথাসম্ভব নিশ্চিত করতে পারব। আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

মেহেদী আহমেদ আনসারী: বিজ্ঞানচিন্তাকেও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ।

অনুলিখন: আহমাদ মুদ্দাসসের ও উচ্ছ্বাস তৌসিফ

*লেখাটি ২০২৩ সালে বিজ্ঞানচিন্তার মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত