প্রাণিজগৎ
ছোট্ট পাখি মোচাটুনি
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
এক ঝাড় কলাগাছ। পাশেই একটি টলটলে জলের ডোবা। একটি কলাগাছ ঝুঁকে আছে ডোবার দিকে, ডোবার জলে চমৎকার ছায়া পড়েছে। জলে ছোট ছোট ঢেউ। ফাল্গুন মাসের বাতাস বইছে বেশ জোরে। কলার পাতাগুলোও দুলছে তালে তালে। ঝিঁঝির ডাকে ঝালাপালা কান। আমের বোলের মিষ্টি গন্ধ ভাসছে বাতাসে। বড়সড় একটি আমগাছ ডালপালার তলায় ঢেকে রেখেছে কলাঝাড়টিকে।
ডোবার দিকে ঝুঁকে থাকা একটি কলাগাছে সুন্দর একটি মোচা ঝুলছে। ওই মোচাটায় তিন সারি ফুল ফুটে আছে দারুণ! মোচার তিনটি খোলা ওই ফুলকে যেন পরম যতনে আগলে রেখেছে ঢাকনা দিয়ে। খোলাগুলো দেখতে অনেকটা ডিঙি নৌকার মতো।
বেশ দূরে শোনা গেল জোরালো ‘ট্রিক ট্রিক’ আওয়াজ। ওটা একটি পাখির ডাক। ডাকতে ডাকতে পাখিটি এগিয়ে আসছে বন-বাগানের তলা দিয়ে, ডালপালার ফাঁক গলে, ঘন সুপারি বাগানটার ভেতর দিয়ে। তীরবেগে এসেই ছোট পাখিটি বসে গেল কলার মোচাটায়। বসল ঝুলে, একটুও দেরি না করে মাথাটা একটু উঁচু করেই সুঁইয়ের মতো সরু লম্বা ঠোঁটটি ঢুকিয়ে দিল একটি ফুলের ভেতর। কলাফুল তো অনেকটা নলের মতো। ওই নলের ভেতরের মধু সে জিভে টেনে খেতে শুরু করল। ঠোঁটটি লম্বায় ৫ সেন্টিমিটার। আগার দিকে একটু বাঁকানো। সরু জিভটাও চেরা ধরনের।
ফুলের মধু টেনে খেতে তাই খুব সুবিধে। সেই সুবিধা নিয়েই পিচ্চি পাখিটি প্রথম ফুলটির মধু খেল। ঠোঁট বের করে ডাকল দুই বার। তারপর একে একে সবগুলো ফুলে ঠোঁট ঢুকাল। সব ফুলে মধু পেল না। হয়তো খেয়ে গেছে মোটুসী পাখিরা। ওরা তো এই পাখিটির জাতভাই। ওদের ঠোঁটও সুঁচালো। ভালোবাসে মধু খেতে।
যতবার পাখিটি ফুল থেকে ঠোঁট বের করল, ততবারই ডাকল। সবগুলো ফুল পরখ করা হয়ে গেলে ও উড়ল ঝট করে। মিলিয়ে গেল বন-বাগানের ভেতর দিয়ে, আর থেমে থেমে ডাকতেই লাগল।
প্রায় আধা কিলোমিটার পথ পাড়ি দিল ও একই গতিতে। বসল এসে আরেকটি কলাগাছের পাতার ওপরে। পাতাটি ঝুঁকে আছে পুকুরের জলের ওপর। বড়সড় পাতা। ওই পাতার ওপরে বসে একটুক্ষণ চুপ রইল পাতাটির দিকে তাকিয়ে। তারপর দুই পাখা ঝাঁকিয়ে, শরীরটা কাঁপিয়ে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করল, ‘ট্রিট্রিট্রিট্রি, ট্রিট্ ট্রিট, টিট্ টিট্।’ ধাতব আওয়াজ। একটু কর্কশ ধরনের। অমনি কলাপাতার তলার বাসা থেকে ফুড়ৎ করে বেরিয়ে পড়ল ওর সঙ্গী। পুকুরের টলটলে জলে সুন্দর ছবি এঁকে উড়ে এসে বসল কলাপাতার ওপরে। সরে এসে প্রথম পাখিটির গা ঘেঁষে বসল এবার। পাখি দুটির ঠিক পায়ের নিচে বাসাটি। দুজনে কী যেন একটু পরামর্শ করল। তারপর প্রথম পাখিটি উড়েই ঘুরে এলো পাতার তলায়, ঢুকে পড়ল মাচানের মতো তুলতুলে বাসাটির ভেতরে। বসে গেল ডিম বুকে নিয়ে। ডিমে তা দেওয়ার পালা এবার তার। সুঁচালো ঠোঁটটির প্রায় অর্ধেকটাই বেরিয়ে আছে বাসার ফোকরের বাইরে। পাতার ওপরের পাখিটি এবার উড়ে চলে গেল দূরে। এখন সে খাবার খাবে। সময় হলে আবারো ফিরে আসবে ডিমে তা দিতে।
এই সুঁচালো ঠোঁটের ছোট পাখিটির নাম মোচাটুনি। কলাগাছে ফুল ফুটলে এরা আসবেই, কলাবাগান থেকে কলাবাগানে ঘুরে বেড়াবে কলাফুলের মধুর লোভে। বাসাও করে কলাপাতার তলায়। বসতেও ভালোবাসে কলাপাতার ওপরে। কলার মোচায় এরা চমৎকার ভঙ্গিতে বসে। কলাফুলের কাছে হোভারিং (শূন্যে স্থির থেকে ওড়া) করেও এরা সুন্দর ভঙ্গিতে। সুঁচালো ঠোঁট ফুলের ভেতরে ঢুকিয়ে মধু পান করে অবাক কৌশলে। এদের নাম তাই মোচাটুনি। কলাটুনিও বলা যায়।
মোচাটুনির ইংরেজি নাম Little Spider Hunter বা ছোট মাকড়সাভুক। সব ধরনের মাকড়সাই এদের প্রিয় খাদ্য, তাই এই নাম।
মাকড়সার জালের কাছে হোভারিং করে মাকড়সা ধরে মোহনীয় ভঙ্গিতে। আঁঠালো জালে জড়ায় না কখনো। এরা অত্যন্ত চঞ্চল, ভীতু স্বভাবের। বাংলাদেশের সব জেলাতেই আছে। বড় শহরে দেখা যায় না।
মোচাটুনি দেখতে মৌটুসী-নীলটুনির মতো। আকারে একটু বড়। শরীরের মাপ ঠোঁটসহ ১৫ সেন্টিমিটার। শুধু ঠোঁটটিই ৫ সেন্টিমিটার অর্থাৎ গোটা শরীরের মাপের তিনভাগের একভাগ। ঠোঁটের গড়ন চমৎকার। আগার দিকটা বুকের দিকে কিছুটা বাঁকানো, রং কালচে-সবুজ। এদের বুক-পেট-লেজের তলার রং জলপাই-সবুজ, তাতে হাল্কা হলুদের আভা। বুক ও পেটের দুপাশসহ লেজের গোড়াটায় হলুদ রং বেশি। মাথা-গলা-পিঠ জলপাই-সবুজ। লেজের আগায় সাদাটে ভাব। পা কালচে। সূর্যের আলোয় মৌটুসী-নীলটুনির মতো এদের শরীর তেমন ঝলকায় না, তবে চোখ দুটি চকচকে।
ফুলের মধু, মৌমাছি, মাকড়সা ও মাকড়সার ডিমসহ নানা রকমের পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ খায়। নারকেল ফুলে যখন মৌমাছি আসে, তখন এরা ওই মৌমাছিও ধরে। নারকেল ফুলের রেণু ও মধু এদের খুব পছন্দ। বাসা বাঁধে পৌষের শেষ থেকে আষাঢ়ের প্রথম দিক পর্যন্ত। কলাপাতার মাঝখানটির তলায় চমৎকার মাচানের কায়দায় বাসা বানায়। বাসার মুখটা থাকে পাতার আগার দিক বরাবর।
সরু ঠোঁটে পাতা ফুটো করে ওরা সরু সরু সুতার মতো উপকরণ পাতার ওপর দিকে ওঠায়। তারপর পাতার ওপরে বসে ওই সুতার মাথায় ঠোঁট দিয়ে ছোট ছোট গোল বল তৈরি করে। ওই গিঁটের জন্য সুতার মাথা আর নামতে পারে না পাতার তলায়। পাতার মাঝখানের ডগায়ও সুতা গুঁজে দেয়। ডগাটিকে মাঝখানে রেখে পাতায় আড়াআড়িভাবে বাসা বানায়। বাসা ১৬-২২ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার চওড়া। বাসার উপকরণ হচ্ছে পাটের আঁশ, মাকড়সার জাল, কলাগাছের শুকনো আঁশ, শুকনো সরু ঘাস ও অন্যান্য। বাসা বাঁধার জায়গা পছন্দে দুজনে লাগায় ২-৬ দিন। আর বাসা বানাতে সময় লাগে ৪-৭ দিন। মানকচুর পাতা, কাঠবাদামের চারার পাতার তলায়ও বাসা করে। চমৎকার বাসাটি পাতার তলায় যেন সেঁটে থাকে।
ডিম পাড়ে প্রায়ই ২টি, দৈবাৎ ৩টি। দুটি পাখিতে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফোটে ১৫-১৭ দিনে। ছানারা উড়তে শেখে ১৯-২৩ দিনে। দর্জিরা যে কৌশলে হাতের দুই আঙুলে সুতোর মাথায় গিঁট দেয়, এরাও ঠোঁট ও জিভ ব্যবহার করে সুতোর মতো উপকরণের মাথায় গিঁট দিতে পারে।