পাখির গল্প-গানে ভরপুর পল্লীকবির ফরিদপুর

কাটুয়া চিলছবি: লেখক

দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ। মাঝে জলাভূমি, সাদা শাপলা, লাল শাপলাসহ অসংখ্য জলজ ফুল। মাঝে মধ্যে দুই-একটি বাড়ি আর আকাশে ঝাঁক বাধা ধবল বক, কখনও শামুক খোল, আবার কখনও-বা ফসলের ক্ষেতের পাশে সাদা কাটুয়াচিল। রাখাল ছেলে তার গরুর পাল নিয়ে যাচ্ছে। সবকিছুর বুকচিরে রেললাইন। ছুটে চলছে মধুমতি এক্সপ্রেস। চারদিক থেকে ভেসে আসছে জলাভূমিতে ডুবন্ত সোনালী আঁশের গন্ধ। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকালে ছবির মতো এক সবুজ গ্রাম। বলুন তো, কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? যদি মনে না আসে, তাহলে মনে করুন, ‘তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়; গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;’ তবে কি মনে পড়ল? ঠিক ধরেছেন, আমরা যাচ্ছি পল্লীকবির ফরিদপুর, যার নিমন্ত্রণ তিনি অনেক আগেই তাঁর লেখায় দিয়েছেন। তবে আজ কিন্তু ওই এলাকার পাখিদের নিমন্ত্রণে।

গঙ্গার নিম্ন অববাহিকার প্লাবনভূমির সবুজের সমারোহে আর জলের নীলে উর্বর এক জেলার নাম ফরিদপুর। পদ্মার তীরের এই জেলা পদ্মা ছাড়াও ছোট-বড় অসংখ্য নদীতে সমৃদ্ধ। সমৃদ্ধ জলাভূমির প্রাচুর্যে আর বনের সবুজে। সবমিলিয়ে আদর্শ আবাসস্থলের জন্য জীববৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ ডালি সাজিয়ে বসেছে এই ফরিদপুর। আর পাখিদের বৈচিত্র্যময়তার প্রাচুর্যে, জীবনের বর্ণিল আবিরে, মোহনীয় কলকাকলীতে ফরিদপুর পরিপূর্ণ।

চর সংলগ্ন প্লাবন ভূমি
ছবি: লেখক

বিগত বছরে জীববৈচিত্র্য অনুসন্ধানে আমার অন্যতম স্থান ছিলো ফরিদপুর। শৈশবের বড় একটা অংশ এই এলাকার সবুজের ছায়া, পাখি আর জীববৈচিত্র্যের স্মৃতিতে ঘেরা। এখানকার পাখিদের, বিশেষ করে জলাশয়কেন্দ্রিক পাখিদের নিয়ে গবেষণার কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছে, আর কিছু অংশ প্রকাশিত হবে। তবে সব মিলে অনন্য এক পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থার এই জেলায় এখনও টিকে আছে ২২৫টির বেশি প্রজাতির পাখি, যা বাংলাদেশের মোট পাখি প্রজাতির ৩০ শতাংশ।

বাংলাদেশে মোট বুনোহাঁসের প্রজাতি ৩০টি। এর মধ্যে পরিযায়ী ২৩টি। আর ফরিদপুরে দেখা মেলে ১৫টি।

২০১৬ সাল থেকে গঙ্গা প্লাবনভূমির এই এলাকায় নিয়মিত গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে উঠে আসে পাখিদের এই তথ্য। পদ্মা ও যমুনার মিলিত প্রবাহ এখানে সৃষ্টি করেছে জলাভূমির এক বৈচিত্র্যতা। বিল, বাঁওড়,  ছোট-বড় নদী, নদীর চর, প্লাবণভূমি, ছনের বনসহ বিভিন্ন রকম জলাভূমির উপস্থিতির কারণে এই জেলায় ঠাঁই পেয়েছে অসংখ্য জলাশয়কেন্দ্রিক পাখি। 

জলাভূমিগুলোর সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় ও পরিযায়ী হাঁস। বাংলাদেশে মোট বুনোহাঁসের প্রজাতি ৩০টি। এর মধ্যে পরিযায়ী ২৩টি। আর ফরিদপুরে দেখা মেলে ১৫টি। বর্ষার কোনো এক সকালে হাঁটছিলাম ফরিদপুরের শহরের কেন্দ্রস্থলের এক পুকুর পাড়ে, নাম সুখ সাগর। হঠাৎ চোখে পড়ে, চারটি ছোট সরালি পাখি বিরাট ওই পুকুরের পানিতে বসল। এরপর একদিন শহরের কাছাকাছি এক জলাভূমিতে দেখা পেলাম অসংখ্য বালিহাঁসের। শীতে নদী ও বড় বিল-বাঁওড়গুলোতে দেখা মেলে মৌলভী হাঁস, সিথি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, দাগী রাজ হাঁস,  বুনো রাজ হাঁস,  খুন্তে হাঁস, পিয়াং হাসসহ অসংখ্য পরিযায়ী বুনোহাঁসের দল। পাশাপাশি নদী ও বিল-বাঁওড়ে দেখা মেলে বড় খোপা ও ছোট ডুবুরি পাখি। পাশাপাশি বিল, জলা, প্লাবনভূমি, ছনের ক্ষেতগুলোতে নিয়মিত দেখা মেলে কোড়া, কালেম, ঝিল্লী ও ডাহুকের।

তাম্বুলখানার বিস্তৃত বিল
ছবি: লেখক

পাখি নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধান করতে প্রায়ই যাওয়া হতো ফরিদপুরের পদ্মার বিভিন্ন চরগুলোতে। বিশেষ করে চরাঞ্চলগুলো জলচর পাখির জন্য খুব ভালো আবাসস্থল সরবারহ করে। আর যে চরগুলোতে মানুষের চলাচল নেই বা যাওয়া খুবই কঠিন, সেখানে দেখা মেলে বিভিন্ন প্রজাতির মানিকজোড়, কাস্তেচরা আর মদনটাকের। মানিক জোড়, বিশেষ করে রাঙা মানিকজোড়, ধলাগলা মানিকজোড়, কালো মানিকজোড়, কালা মাথা কাস্তেচরার আগমন হয় শীতে পদ্মানদী সংলগ্ন বিভিন্ন চরে। পুরো ফরিদপুরের জলাভূমিগুলো বিভিন্ন প্রজাতির বগা-বগলা, ধূসর বক, লালচে বক, হট টিটি, জলপিপি, বাটান, জিরিয়া, চ্যাগা, খঞ্জন, মাছরাঙায় পরিপূর্ণ। এ ছাড়া নদীকেন্দ্রিক চরগুলো উল্টোঠুটি, চ্যাগা, জিরিয়া, বাটান, জৌরালী, ডানলিন, চা-পাখিসহ শীতে অজস্র সৈকত পাখিতে ভরে যায়। জলাশয়গুলোকে কেন্দ্র করে এখানে বাস করছে শিকরা, মধুবাজ, পা-লম্বা তিসি বাজ, শাহীন, ঈগল, কাবাসিসহ বিভিন্ন প্রজাতির শিকারী পাখি। এ ছাড়া ফরিদপুর এলাকাটিকে কেন্দ্র করে রয়েছে শকুন পরিযানের পথ। এখানে আরও রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির দেশি গুটি ঈগল, বড় গুটি ঈগল, শাহী ঈগল পাখির বসবাস। জলাভূমি, জলজ প্রাণী—বিশেষ করে মাছ, ব্যাঙ, সরীসৃপের প্রাচুর্যতায় এই এলাকায় শিকারী পাখিদের আনাগোনা বেশি।

পেঁচা এই এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি। খুঁড়লে পেঁচা, খয়রা শিকরে পেঁচা, নীম পেঁচা, লক্ষ্মী পেঁচা, হুতুম পেঁচার দেখা মেলে নিয়মিত।

ফরিদপুরের শিকারী পাখিদের মধ্যে অন্যতম হলো কাটুয়া চিল। সাদা আর নীলচে কালো রং মিশ্রিত পালক এবং লাল চোখ পাখিটিকে দিয়েছে অনন্য এক সৌন্দর্য। এটি ফরিদপুর এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশক পাখি। জলাভূমির পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং বড় মাঠ প্রান্তর কিংবা ফসলের ক্ষেত এই পাখির প্রধান আবাস এবং একটু দৃষ্টি রাখলেই ফরিদপুরে দেখা মেলে এই পাখির।

এ ছাড়া ফরিদপুরের পদ্মা নদী দেশি গাঙচোষার পরিযানে ব্যবহৃত একটি পথ। বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙা, সুইচোরা, কোয়েলের দেখা মেলে জলাশয়ের আশপাশে এবং প্লাবনভূমি, জলা ও ঘাসভূমিতে। এ ছাড়া আছে কুবো, বাতাসি ও আবাবিলজাতীয় পাখিরা।

পেঁচা এই এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পাখি। খুঁড়লে পেঁচা, খয়রা শিকরে পেঁচা, নীম পেঁচা, লক্ষ্মী পেঁচা, হুতুম পেঁচার দেখা মেলে নিয়মিত। এ ছাড়া শীতে চর এলাকায় দেখা মেলে পরিযায়ী ছোটকান পেঁচার। কৃষিপ্রধান এলাকা হওয়ায় এই পেঁচারা ফসলের ক্ষেতের ইঁদুর খেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কৃষি অর্থনীতিতে।

মাঝলা বক
ছবি: লেখক

তৃণভূমি, ঘাসভূমি, ফসলের ক্ষেত, চরাঞ্চল, বাগিচায় ঘুঘু জাতীয় পাখিদের বৈচিত্র্যময়তা দেখা যায়। এর মধ্যে তিলা ঘুঘু এবং গোলা পায়রা সর্বত্রই দেখা যায়। চর ও ফসলের ক্ষেতে সবচেয়ে বেশি ইউরেশীয় কন্ঠি ঘুঘু ও লাল রাজঘুঘুর দেখা মেলে। বাগানে পাতি শ্যামাঘুঘু, হলদে পা হরিয়াল এবং কমলাবুক হরিয়ালের দেখা মেলে।

কোকিলজাতীয় পাখিরা গায়ক পাখি না হলেও তাদের মোহনীয় সুরলহরি আমাদের সবসময় আকৃষ্ট করে রাখে। বিশেষ করে করুণ পাপিয়া, পাতি চোখ গেলো বা গ্রীষ্মের বউ কথা কও কিংবা চাতক পাখি। ফরিদপুরে সব মিলিয়ে ৮ প্রজাতির কোকিল জাতীয় পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে বেশির ভাগ বাগান, ঝোপঝাড় পছন্দ করে।

শীতে ৯০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আর গ্রীষ্মে চার প্রজাতির গ্রীষ্ম পরিযায়ী পাখি দেখা যায়।

ফরিদপুর এলাকায় সংরক্ষিত কোনো বনাঞ্চল নেই। মানুষের রোপিত বন-ই এই এলাকার প্রধান বন। মানুষের বসতির আশপাশে, বিশেষ করে বাগান, ফলের বাগান, রাস্তার চারপাশ, বিভিন্ন ক্যাম্পাস এলাকা এখানকার প্রধান গাছপালা সমৃদ্ধ এলাকা। আর আশার কথা হলো, ফরিদপুরে দেশি প্রজাতির উদ্ভিদ বা আমাদের স্থানীয় বন্যপ্রাণী-বান্ধব আবাসিক গাছের সংখ্যা বেশি। এই গাছগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির কাঠঠোকরা, টিয়া, ছাতারে, চুককি, ফুটকি, বেনে বউ, দোয়েল, কোকিল, ফুলঝুরি, ময়না, সাহেলী, বুলবুলি বসবাস করে।

এখানে খোলা প্রান্তর বা ফসলের ক্ষেত ধরে হাঁটলে দেখা মিলবে নীলকন্ঠ, দাগী ছাতারে, বাবুই, সুইচোরা, মুনিয়া, হুদহুদজাতীয় পাখির। শীতে ৯০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আর গ্রীষ্মে চার প্রজাতির গ্রীষ্ম পরিযায়ী পাখি দেখা যায়। তাই এই এলাকা পরিযায়ী পাখিদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ছায়া সবুজে ঘেরা, জলাভূমিতে পরিপূর্ণ ফরিদপুর এই জেলা, পল্লীকবির ছবির মতো সবুজের এই জেলা পাখ-পাখালির সম্পদে পরিপূর্ণ। গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্র রয়েছে পাখিদের এক অপূর্ব ভান্ডার। এই পরিবেশ ফরিদপুরের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে অনেক গুণ। এখন প্রয়োজন বিস্তৃত গবেষণা, আর এই পাখিদের সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ। বর্তমানে পাখি শিকার এই জেলার পাখিদের অনেক বড় সমস্যা। পাশাপাশি জলজ পরিবেশ ক্রমাগত নষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। নগরায়ণের আগ্রাসনে বিপন্ন হচ্ছে পাখির আবাস। এখনই পদক্ষেপ না নিলে আমরা এই জেলা থেকে হারাব সমৃদ্ধ এক পাখির রাজ্য। তাই পাখি সংরক্ষণে দরকার সর্বস্তরের সচেতনতা আর যথাযথ উদ্যোগ।

লেখক: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস), বাংলাদেশ