সাক্ষাৎকার
'পঞ্চব্রীহি এক রোপনে পাঁচবার ফলন দেয়'—বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী, দীর্ঘদিন দেশি ধান নিয়ে গবেষণা করছেন। আমাদের এতিহ্যবাহী অনেক ধান যেমন ফিরিয়ে এনেছেন, তেমনি নতুন নতুন ধানের অনেক জাত উদ্ভাবন করেছেন। পঞ্চব্রীহি নামে একট নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন তিনি। এক রোপনে পাঁচবার ধান ফলবে এই জাতে। সেটা নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তাকে অনলাইনে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, নতুন এই ধানের গবেষণা, ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনার কথা। পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: সম্প্রতি নতুন একটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। যেটা একবার রোপন করলে পাঁচবার ধান পাওয়া যায়। এই ধান আবিষ্কারের প্রক্রিয়াটা যদি একটু জানান। এর পেছনের বিজ্ঞান কী?
আবেদ চৌধুরী: প্রায় ১৪ বছর আগে আমার মাথায় একটা ধারণা এসেছিল যে, ধান কেন চিরজীবী হবে না। ২০১০ সালের দিকে আমি কিছুটা এগিয়েছিলাম এ ব্যাপারে। বিজ্ঞানের দুইটা ধারা আছে। একটা সনাতন পদ্ধতিতে করা গৎবাঁধা কাজ। আরেকটা হলো বিপ্লবী ধারা। চিরায়ত পদ্ধতির আবিষ্কারগুলো সাদামাটা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বিপ্লবী ধারার আবিষ্কারগুলো হয় বড় ধরনের। আমি বিপ্লবী ধারায় বিশ্বাস করি। আমার চিন্তা ছিল, ধান কেন আম-কাঁঠালের মতো চিরজীবী হবে না? পাঁচ নিয়ে মানুষের মাঝে একটা আবেগ কাজ করে। পঞ্চব্রীহি এক রোপনে পাঁচবার ফলন দেয়। তবে এই জাত থেকে শুধু পাঁচ বার নয় বরং পনেরো বা বিশ বার ধান পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে। এটা তার সূচনা মাত্র। সেই রাস্তা আমি তৈরি করে দিলাম।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: এর আগেও এরকম ধান উদ্ভাবন হয়েছিল, যেখানে দুইবার ধান পাওয়া যায়। কোন অজ্ঞাত কারণে সেগুলো কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায়নি। এটার কারণ কী?
আবেদ চৌধুরী: এটা কোনো সমস্যা নয়। একজন কৃষক সাধারণ একবার ধান রোপন করে আবার রোপন করার জন্য জমি তৈরি করে। এই পদ্ধতি তো সেরকম নয়। সুতারং শুরুতেই একজন কৃষকের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কাজ করার সাহসটা হয়ত পাচ্ছেন না। আবার আমাপদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি কৃষক পর্যায়ে পৌঁছুনোর জন্য কৃষি অধিদপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, কিন্তু তাঁদের সহযোগিতা এখনো পাইনি। তবে দেশের বাইরের বিজ্ঞানীরা আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে এই আবিষ্কারের জন্য। আমি বাংলাদেশের ৮৭ হাজার গ্রামে এই বীজ দিতে পারতাম। কিন্তু আইন-কানুনের কিছু জটিলতার কারণে সেটা এখন সম্ভব হচ্ছে না। অথচ আমার এই ধান হেক্টর প্রতি ২০ টন উৎপাদন করা সম্ভব। সকল কৃষকের কাছে এই বীজ পৌঁছে গেলে, হাইব্রিড বীজের আর কোনো দরকার হবে না।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: আমাদের দেশে ধানের সাধারণত তিনটা মৌসুম। সেখানে এক চাষে পাঁচবার ধান কীভাবে মিলবে? এর পেছনের বিজ্ঞান আমাদের বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য একটু সহজভাবে বুঝিয়ে বলবেন?
আবেদ চৌধুরী: ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বছর আগে ধান চিরজীবী ছিল। তখন ধান মারা যেত না। ঘাস যেমন মারা যায় না, তেমনি ধানও মারা যেত না। ধান তো এক ধরনের ঘাষ। কিন্তু সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধান বিভিন্ন মৌসুমে ভাগ করে চাষ শুরু করে মানুষ। ফলে ধানও সেভাবে অভিযোজিত হতে শুরু করে। এক বোপনে বোরো, আউশ ও আমন তিনটা ধান হয় না। আমি প্রথমে ধানটাকে বোরোর উপযোগী করেছি এবং উৎপাদনের সময়টা কমিয়েছি। এক ধরনের ইল্টিলিজেন্ট গ্রেডিংয়ের মাধ্যমে। ধানের জীবনকাল দীর্ঘ করা হয়েছে। এরকম ধান দেশে নেই। এগুলোর এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, পাঁচ বার ফসল দেবে—একবার বোরো এবং দুবার দুইটা আউশ ও দুবার আমন দেবে। এই কাজটা করেছি চৌদ্দ বছর ধরে। হঠাৎ করে তো এগুলো হয় না। অর্থাৎ একই ধানের মধ্যে আমি বোরো, আউশ এবং আমন এই তিনটা চরিত্র নিয়ে এসেছি।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: প্রথম রোপণে যে পরিমাণ ধান পাওয়া যায়, দ্বিতীয় রোপণেও কি সে পরিমাণ ধান পাওয়া যাবে? নাকি কম বেশি হবে? এটা কৃষকদের জন্য কীভাবে লাভজনক হবে?
আবেদ চৌধুরী: প্রথমবার বোরো সিজনে এটা লাগাতে হবে। প্রায় ১১০ দিন পরে এটা কাটা যাবে। সাধারণভাবে একবার ধান কাটার পরে জমিকে প্রস্তুত করতে হয় আবার প্রথম থেকে। জমি কয়েক সপ্তাহ এমনকী মাস খালি রাখতে হয়। এরপর আউশ বা আমন লাগানো হয়। কিন্তু আমার এই পদ্ধতিতে আপনি বোরো ধান কাটার পরে ৪৫ দিন পরে আরেকটি ধান কাটতে পারবেন। এরপর ৫০ দিন পরে আবার কাটতে পারবেন। সেখান থেকে আবার ৫০/৬০ দিন পরে আরেকবার কাটতে পারবেন।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: আমরা বোরো মৌসুমে বোরো ধানের সমান ধান পাব, কিন্তু দ্বিতীয় ফলনে কি আমরা আউশ বা আমনের সমপরিমাণ ফলন পাব?
আবেদ চৌধুরী: নিশ্চই পাবেন।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে কৃষক পর্যায়ে ধান পৌছে দেওয়া যায় কীভাবে?
আবেদ চৌধুরী: আমি এই ধান নিয়ে কোন ব্যবসা করতে চাই না। দেশের ৮৭ হাজার গ্রামে এটা পৌঁছে দেব। সরকারের একটা নিয়ম আছে, সার্টিফাইড বীজ বিক্রি করতে হবে। তখন পারমিশন দিলে আমরা এই বীজ বিক্রি করব। আমার পরিবার কৃষক পরিবার। আমাদের বাসায় অনেক বীজ আছে যেগুলো সার্টিফাইড নয়। সেগুলো নিয়ে গবেষণা করেছি, আমি খামারে মাঠে রোপন করেছি। কিন্তু এর বীজ বিক্রি করব না। উপহার হিসেবে বীজ পৌঁছে দেব বাংলাদেশের ৮৭ হাজার গ্রামে। উপহারের বীজ থেকে চাষ করতে কোনো বাধ্য-বাধকতা থাকার কথা নয়।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: শুনেছি এই ধান পরিবেশবান্ধব। কীভাবে পরিবেশ বান্ধব, এটা আমাদের পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি বলেন।
আবেদ চৌধুরী: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষ বোরো ধান কাঁটার পরে আউশ রোপন করে। আউশ কেটে আবার অন্য একটি ধান রোপন করে। প্রতিবার জমি চাষ করতে হয়। জমিকে বারবার চাষ দিলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন নিঃসরণ হয়। যদি আপনি একবার চাষ করেন এবং চাষবাষ ছাড়াই পাঁচবার ফলন পান, তাহলে আপনাকে আর চাষ দিতে হবে না। সুতরাং আপনি কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও মিথেন নিঃসরণ কমবে। এতে চাষজনিত কারণে হওয়া আশি ভাগ দূষণ কমবে।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: অনেকেই বলছেন, প্রথমবার ফলন আসার পরে ধীরে ধীরে ফলন কমতে থাকে। ফলে এটা লাভজনক নয়। বরং এই সময়ে অন্য ধান রোপন করলে বেশি লাভজনক। এই ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
আবেদ চৌধুরী: এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। এটা কমে যাওয়ার কোন কারণ নাই। আমি ১৪ বছর এটা নিয়ে কাজ করছি। প্রথমবার কাঁটার পরে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আরো বেশি ধান পাওয়া যায়। আমি নিজে এটা পরীক্ষা করে দেখেছি।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: আমাদের কোনো পাঠক যদি আপনার সাথে ধান গবেষণায় যুক্ত হতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে কী করতে হবে? বা কীভাবে সম্ভব হবে?
আবেদ চৌধুরী: আমার এখানে মানুষ আসবে। তাঁরা দেখবে, শিখবে। এতে আমার কোনো বাঁধা নেই। কেউ যদি আমার এলাকায় এসে ধান চাষ শিখতে চায় শিখবে। আমি তাকে সাহায্য করব। ধান, পাট, শাক-সবজীসহ অসংখ্য শস্য আমার এলাকায় হয়। সব কিছু আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। মানুষকে এগুলো আমি শেখাবো, এর বিজ্ঞান শেখাব। কীভাবে উৎপাদন বাড়াতে হয় সব শেখাবো। কেউ যদি বিজ্ঞানীর ছত্রছায়ায় এসে এটা করতে চায়, আমার কাছে করতে পারবে। মোট কথা আমি তরুণ গবেষকদের বলব, আমার সাথে যোগাযোগ কর, বিশাল প্রান্তরে বা শস্যতেও যে বিজ্ঞান আছে, এটার দরজা আমি তাঁদের জন্য খুলে দেব।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: বিজ্ঞানচিন্তার অধিকাংশ পাঠক কিশোর ও তরুণ। তাঁদের উদ্দেশে যদি কিছু বলেন।
আবেদ চৌধুরী: কিশোরদের প্রকৃতিকে বেশি করে জানতে হবে। প্রকৃতিকে জানার জন্য এই বয়সটাই পারফেক্ট।
প্রশ্ন :
বিজ্ঞানচিন্তা: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আবেদ চৌধুরী: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
*সাক্ষাৎকারটি ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিজ্ঞানচিন্তার অনলাইনে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে।
অনুলিখন: কাজী আকাশ