পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে এক নতুন মহামারী। নাম হ্রস্বদৃষ্টি বা মায়োপিয়া। কাছের জিনিস ভালো দেখে কিন্তু দূরের জিনিস ঝাপসা দেখার রোগের নাম মায়োপিয়া। এই রোগের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। আমেরিকান অপ্টোমেট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের হিসেব মতে, গত চল্লিশ বছরের এই সংখ্যা বেড়েছে ২৫ শতাংশ। শুধু তাই নয়, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় চক্ষু সংস্থা। বিশেষজ্ঞরা একে মায়োপিয়া মহামারী বলছেন।
শিশুরা বেশি মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ, সূর্যের আলোয় কম সময় কাটানো। ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২৭ ভাগ শিশু এখন বাইরে খেলাধুলা করে। অথচ দুই প্রজন্ম আগেও এই হার ছিল ৮০ শতাংশ।
সূর্যের আলো কেন দৃষ্টিশক্তির জন্য ভালো, তা বুঝতে হলে জানতে হবে মায়োপিয়া কেন হয়। কোনো বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়লে চোখের কর্নিয়া ও লেন্স সেই আলোকে একটি বিন্দুতে নিয়ে আসে। এর নাম ফোকাস বিন্দু। ফোকাস বিন্দু রেটিনাতে পড়লে সেই বস্তু স্পষ্ট দেখা যায়। কোনো কারণে ফোকাস বিন্দু যদি রেটিনার সামনে বা পেছনে চলে যায়, তাহলে দেখতে সমস্যা হয়।
শুধু সূর্যের আলোই যে চোখ সুস্থ রাখবে, ব্যাপারটা এমন নয়। চোখের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু থেকে দূরে থাকতে হবে। স্ক্রিনটাইম মায়োপিয়া বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। বিশেষত অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশ উদ্বেগজনক।
শিশু জন্মের পর দূরদৃষ্টি সমস্যায় আক্রান্ত থাকে। মানে শিশুর অক্ষিগোলক ছোট হওয়ায় ফোকাস বিন্দু রেটিনার পেছনে অবস্থান করে। ফলে শিশুটি কাছের জিনিস ঝাপসা দেখায়, কিন্তু দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখতে পায়। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর অক্ষিগোলকের আকার পরিবর্তিত হতে থাকে। একসময় অক্ষিগোলকের আকার বাড়তে বাড়তে ফোকাস বিন্দু রেটিনাতে আসে। সাধারণত এই পর্যায়ে এসে অক্ষিগোলকের আকার আর পরিবর্তন হয় না। তবে কোনো কারণে অক্ষিগোলকের আকার বাড়তেই থাকলে স্বাভাবিকের চেয়ে এটি বড় হয়ে যায়। তখন সেই শিশুটি মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হয়।
মায়োপিয়ার মূল কারণ অক্ষিগোলক বড় হয়ে যাওয়া। এছাড়া কর্নিয়া ও লেন্সের বিভিন্ন অবস্থার জন্য মায়োপিয়া হতে পারে। যেমন, লেন্সের অভিসারী ক্ষমতা বেড়ে গেলে ফোকাস বিন্দু সামনে চলে আসবে। তাতেও মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হবে। যদিও কর্নিয়া ও লেন্সের কারণে মায়োপিয়া হওয়ার সম্ভবনা খুব কম।
এবার আসি, সূর্যালোক কেন চোখের জন্য ভালো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাইরে খেলাধুলা করা এবং সময় কাটানো চোখের জন্য উপকারী। শিশুদের চোখ থাকে বিকাশমান পর্যায়ে, এ সময় সূর্যালোকে সময় কাটালে অক্ষিগোলক অত্যাধিক বড় হতে পারে না। কারণ, উজ্জ্বল সূর্যের আলো মস্তিষ্ক ও রেটিনা থেকে এক ধরনের রাসায়নিক হরমোন নিঃসৃত হয়। এর নাম ডোপামিন। এই হরমোন চোখের বৃদ্ধি ও রেটিনার সঠিক আকার বজায় রাখতে সহায়তা করে।
মায়োপিয়ার মূল কারণ অক্ষিগোলক বড় হয়ে যাওয়া। এছাড়া কর্নিয়া ও লেন্সের বিভিন্ন অবস্থার জন্য মায়োপিয়া হতে পারে। যেমন, লেন্সের অভিসারী ক্ষমতা বেড়ে গেলে ফোকাস বিন্দু সামনে চলে আসবে।
সূর্যের আলোয় সময় কাটানোর আরেকটি উপকারিতা হচ্ছে, ভিটামিন ডি উৎপাদন করতে সাহায্য করে। ভিটামিন ডি চোখের টিস্যুগুলোকে শক্তিশালী করে। তাছাড়া এই ভিটামিন আংশিকভাবে চোখের প্রদাহ কমায়, চোখের বাইরের স্তর শক্তিশালী করে, কর্নিয়ার কার্যকারিতা উন্নত করে এবং অশ্রু নিঃসরণে ভূমিকা রাখে। এতে চোখ অত্যাধিক প্রসারিত বা চোখের স্তর বেশি পাতলা হতে পারে না। এসব কারণে বাইরে খেলাধুলা করা বা সময় কাঠানো শিশুদের মায়োপিয়ার হার কম।
তবে শুধু সূর্যের আলোই যে চোখ সুস্থ রাখবে, ব্যাপারটা এমন নয়। চোখের জন্য ক্ষতিকর এমন কিছু থেকে দূরে থাকতে হবে। স্ক্রিনটাইম মায়োপিয়া বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। বিশেষত অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশ উদ্বেগজনক। কারণ, অনেক সময় স্ক্রিনের সামনে থাকলে চোখ শুধু কাছে জিনিস দেখার পেশি ব্যবহার করে। দূরের বস্তু দেখার পেশি ব্যবহৃত না হলে ক্রমশ এগুলো দুর্বল হতে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের স্ক্রিনটাইম একেবারেই থাকা উচিত নয়। দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের স্ক্রিনটাইম হতে পারে সর্বোচ্চ ১ ঘন্টা।
তাহলে মায়োপিয়া থেকে মুক্তির উপায় কী? বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েকটি পথ বাতলে দিয়েছেন। শিশুদের সূর্যালোকে সময় কাটাতে হবে। দৈনিক গড়ে এক ঘন্টা বাইরে সময় কাটালে ৪৫ শতাংশ মায়োপিয়ার ঝুঁকি কমে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করা, টানা অনেক সময় কাছের জিনিস না দেখা। এক্ষেত্রে ২০-২০-২০ নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রতি ২০ মিনিট কাছের জিনিস দেখার পর ২০ সেকেন্ড সময় ২০ ফুট দূরের কোনো বস্তুর দিকে দেখতে হবে। পাশাপাশি পড়াশোনা করতে হবে আলোকিত স্থানে। মোবাইল বা কম্পিউটার একটু দূর থেকে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে নীরব এই মহামারী প্রতিহত করা যেতে পারে।