আমরা মাত্র ১০ শতাংশ মস্তিষ্ক ব্যবহার করি বলে একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। যদিও এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা এই ধারণাকে পুরোপুরি মিথ্যা বলে প্রমাণ করেছেন। আমরা আসলে আমাদের মস্তিষ্কের পুরোটাই সবসময় ব্যবহার করি। তবে যাদের স্ট্রোক হয়, মস্তিষ্কের আঘাত পান বা সার্জারির পরেও বেঁচে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু অন্যরকম হতে পারে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মস্তিষ্কের শতভাগ সচল না থাকলেও মানুষ স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে পারে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে মস্তিষ্কের কত শতাংশ প্রয়োজন? মানে মস্তিষ্কের কতভাগ ভালো থাকলে আপনি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন?
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা এখনো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। কিন্তু সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। মস্তিষ্কের কোন অংশে আঘাত লেগেছে, কেন লেগেছে, কখন লেগেছে এবং আঘাতের ধরণ কেমন ছিল—এসবের ওপর নির্ভর করে একজন মানুষ কতটা সুস্থ জীবনযাপন করতে পারবে। এমনকি মস্তিষ্কের কোনো অংশ পুরোপুরি বাদ দিলেও মানুষ কীভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, তা নিয়েও বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। জেনে হয়তো অবাক হবেন, মস্তিষ্কের কিছু অংশ অচল থাকলেও আপনি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন।
বিষয়টা পুরোপুরি বুঝতে একজন নারীর গল্প শোনা যাক। তাঁর নাম ইজি। সাধারণ একটা স্বাস্থ্য পরীক্ষায় জানতে পারেন, তাঁর মস্তিষ্কের বাঁ দিকের টেম্পোরাল লোব পুরোটাই অনুপস্থিত। এই অংশটি থাকে কানের কাছে। সাধারণত ভাষা বোঝা, শোনা এবং স্মৃতির জন্য মস্তিষ্কের এই অংশ খুব দরকারি। চিকিৎসকের মতে, ছোটবেলায় হওয়া কোনো সিস্টের কারণে তাঁর মস্তিষ্কের এ অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
লিব ছোটবেলায় দিনে প্রায় ৫০ বার খিঁচুনিতে আক্রান্ত হতো। তাই মাত্র নয় মাস বয়সেই তার হেমিস্ফেরেক্টমি করা হয়। এরপর মোরাকে হাসতে এবং গড়াগড়ি দিতেও নতুন করে শিখতে হয়েছিল।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মস্তিষ্কের এত বড় একটা অংশ না থাকা সত্ত্বেও ইজি একদম স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারতেন, পড়তে পারতেন, এমনকি রুশ ভাষাও শিখেছিলেন। যুকরাষ্ট্রের এমআইটির অধ্যাপক ইভেলিনা ফেডোরেনকো ইজির এই ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি দেখেছেন, ইজির মস্তিষ্কের অনুপস্থিত অংশের কাজ অন্য অংশ দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। সাধারণত ভাষা সংক্রান্ত কাজ করার সময় মানুষের মস্তিষ্কের বাঁ দিকের টেম্পোরাল লোব বেশি সক্রিয় হয়। কিন্তু ইজির ক্ষেত্রে সেই কাজগুলো তাঁর মস্তিষ্কের ডান দিকের অংশ করে দিচ্ছিল।
শুধু তাই নয়, মস্তিষ্ক এতই নমনীয় যে কিছু মানুষ মস্তিষ্কের অর্ধেক অংশ ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের নিউরোসার্জন উইলিয়াম বিংগামান ৫০০টিরও বেশি হেমিস্ফেরেক্টমি করেছেন। এটি এমন একটি সার্জারি যেখানে মস্তিষ্কের এক অংশকে দেহের সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। সাধারণত যাদের মারাত্মক মৃগী রোগ থাকে, তাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই অপারেশনে মস্তিষ্কের এক অংশকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে মস্তিষ্কের সেই অংশটি আর কাজ করে না। তবে অকেজো অংশও মস্তিষ্কের ভেতরেই থাকে। কারণ তা বের করতে গেলে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সার্জারি করতে হয়। এতে জটিলতা আরও বাড়ে। এই সার্জারির পর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা বেশ কঠিন হতে পারে। তবে অনেক রোগীই স্বাভাবিক হতে পেরেছেন।
তেমন একজন রোগীর নাম মোরা লিব। সে বিংগামানের কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন। লিব ছোটবেলায় দিনে প্রায় ৫০ বার খিঁচুনিতে আক্রান্ত হতো। তাই মাত্র নয় মাস বয়সেই তার হেমিস্ফেরেক্টমি করা হয়। এরপর মোরাকে হাসতে এবং গড়াগড়ি দিতেও নতুন করে শিখতে হয়েছিল। ধীরে ধীরে থেরাপিস্টদের সাহায্যে সে কথা বলা শেখে। এখন সে কিশোরী। যদিও কথা বলে ধীরে ধীরে। অন্যের কথা বুঝতেও একটু বেশি সময় নেয়। কিন্তু মস্তিষ্কের এক অংশ নিয়েই সে দিব্যি বেঁচে আছে।
এ ব্যাপারে বিংগামান বলেন, ‘আমার হেমিস্ফেরেক্টমি করা রোগীরা পড়ালেখা করেছে, বিয়ে করেছে, বাচ্চা নিয়েছে, পরিবার তৈরি করেছে এবং মস্তিষ্কের এক পাশ না থাকা সত্ত্বেও মানসিকভাবে একদম স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। এটা কীভাবে সম্ভব, তা আমরা এখনো জানি না।’
২০ বছর বয়সী এক মহিলা হঠাৎ জানতে পারেন, তাঁর সেরিবেলাম নেই। ২০ বয়স পর্যন্ত তিনি জানতেন না যে সেরিবেলাম ছাড়াই তাঁর জন্ম হয়েছে। বেঁচে থাকলেও তাঁর কথা বলা এবং নড়াচড়ায় সমস্যা ছিল।
তবে মস্তিষ্কের কিছু অংশ আছে, যা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। যেমন, ব্রেইনস্টেম, থ্যালামাস বা ব্যাসাল গ্যাংলিয়া। মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা এই অংশগুলো আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন ও সংবেদনশীলতা নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে। এগুলো ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন।
তবে মস্তিষ্কের ভেতরের অংশে আঘাত লাগলে সেরে ওঠা কঠিন। বাইরের স্তরে আঘাত লাগলে তা কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ব্রেইনস্টেমে গুরুতর আঘাত লাগলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম।
নিউরোসার্জন উইলিয়াম বিংগামানের মতে, যত কম বয়সে মস্তিষ্কে আঘাত লাগে, সেরে ওঠার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে। যেমন, দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের হেমিস্ফেরেক্টমির ফলাফল ভালো হয়। তবে মস্তিষ্কের সেরিবেলামের ক্ষতি হলে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেরিবেলাম আমাদের নড়াচড়া ও ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
অবশ্য সেরিবেলাম ছাড়া বেঁচে ছিলেন, এমন উদাহরণও আছে। ২০ বছর বয়সী এক মহিলা হঠাৎ জানতে পারেন, তাঁর সেরিবেলাম নেই। ২০ বয়স পর্যন্ত তিনি জানতেন না যে সেরিবেলাম ছাড়াই তাঁর জন্ম হয়েছে। বেঁচে থাকলেও তাঁর কথা বলা এবং নড়াচড়ায় সমস্যা ছিল।
এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মস্তিষ্কের কিছু অংশ অকেজো থাকলেও বেঁচে থাকা যায়। এমনকি অর্ধেকটা অকেজো হলেও! মস্তিষ্কের কোনো অংশ না থাকলে অন্যভাবে সেই কাজ চালিয়ে নিতে পারে। তবে ঠিক কীভাবে মস্তিষ্ক এটি করতে পারে, তা এখনো জানেন না বিজ্ঞানীরা। তাই মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ঠিক কতভাগ মস্তিষ্ক প্রয়োজন, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এটুকু জোর দিয়ে বলা যায় যে, আমাদের ভাবনার চেয়ে মস্তিষ্ক অনেক বেশি রহস্যময় এবং চমকপ্রদ!