মানসিক চাপে কি অল্প বয়সে চুল পেকে যায়? প্রশ্নটি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বেশ কয়েক বছর ধরেই ভাবছেন। কথাটি বেশ প্রচলিতও—স্ট্রেস বা মানসিক চাপে থাকলে চুল পেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এর জনপ্রিয় উদাহরণ। ২০০৮ সালে যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাঁর চুল ছিল একদম কালো। দুই মেয়াদে ৮ বছর শেষে অফিস ছেড়ে যাওয়ার সময় তাঁর চুল দেখা গেল পুরো পেকে গেছে। একদম সাদা। অথচ তখনো তিনি বার্ধক্যে পৌঁছাননি।
চুল পেকে যাওয়ার জন্য মানসিক চাপ আসলেই দায়ী কি না, এ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা আছে। অকালে চুল পেকে যাওয়ার সঙ্গে মানসিক চাপের সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন বলে কেউ কেউ দাবি করেছেন বটে, তবে কোনো গবেষণায় বিষয়টি পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি।
মানসিক চাপ এবং পাকা চুলের বিজ্ঞান
গবেষকেরা চুলের রং ও মানসিক চাপ নিয়ে জরিপ করে দুটোর সম্পর্ক বের করার চেষ্টা করেছেন।
এরকম একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। এ গবেষণায় তুরস্কে তরুণদের ওপর জরিপ করা হয়েছিল। এগারো শর বেশি পাকা চুলের তরুণ এ জরিপে অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ৩১৫ জন দাবি করেছেন, তাঁদের অকালে চুল পেকে গেছে। এবং তাঁদের মানসিক চাপ আছে। বাকিদের মানসিক চাপ ছিল না। তবে সবারই অ্যালকোহল বা মদ পান, দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা বংশগত পাকা চুলের কোনো না কোনোটির ইতিহাস আছে। যেমন কিছু তরুণের বাবা-মারও অল্প বয়সে চুল পেকে গেছে বলে জানা যায়।
২০২১ সালে প্রকাশিত একটি ছোট গবেষণা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। একটু ভিন্নভাবে মানুষের ওপর করা এ গবেষণা বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়েছে। গবেষকেরা এ জন্য ১৪ জন স্বেচ্ছাসেবীর কাছ থেকে কিছু চুল ছিঁড়ে নেন। স্বেচ্ছাসেবীদের সবার কিছু পরিমাণে হলেও পাকা চুল ছিল।
২০২০ সালে প্রকাশিত একটি ইঁদুরের ওপর করা গবেষণায় বিষয়টি আরও একধাপ এগিয়ে যায়। গবেষকেরা ইঁদুরকে বিভিন্ন উপায়ে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে মরিচের গুড়ার রাসায়নিক ইনজেকশন দেওয়া। এই ইনজেকশনের মাধ্যমে ইঁদুরকে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ প্রতিক্রিয়া দেখাতে প্ররোচিত করা হয়। ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ মানে প্রাণীর জিনে থাকা প্রাচীন ভীতি। এর জন্যই কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে প্রাণী লড়াই করে, অথবা পালিয়ে যায়। ধরা যাক, কোনো বনে একটি ঝোপ নড়ে উঠল। একটা হরিণ সেটা দেখল। ঝোপের এই নড়া দেখে সঙ্গে সঙ্গে হরিণটি প্রতিক্রিয়া দেখাবে। সে ঝোপে থাকা প্রাণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে বা দূরে পালিয়ে যাবে।
ওই গবেষণায় ইঁদুরের ওপর রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে স্ট্রেস হরমোন নোরপাইনফ্রাইন ক্ষরণ হয়েছিল। ফলে ইঁদুরের পশমে রঞ্জক ফুটিয়ে তোলার সঙ্গে জড়িত স্টেম কোষের চুলে ফলিকল কমে গিয়েছিল। এভাবে ইঁদুরের পশম পেকে গজিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেম সেল এবং রিজেনারেটিভ বায়োলজির অধ্যাপক ইয়া-চিয়েহ সু এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘গবেষকেরা একটি ল্যাবে মানুষের স্টেম কোষে অতিমাত্রায় নোরপাইনফ্রাইন প্রবেশ করিয়ে একই রকম প্রভাব দেখেছেন। তবে মানুষ নিয়ে এ ধরনের গবেষণা করা কঠিন। কারণ গবেষকেরা প্রাণী বা ল্যাবে মানব কোষের মতো করে মানুষের ওপরে কৃত্রিমভাবে হাই স্ট্রেস বা মানসিক চাপের প্রতিক্রিয়া নীতিগতভাবে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন না।’ এ কথার অর্থ, সরাসরি গবেষণাগারে মানুষের ওপর এ ধরনের পরীক্ষা করা যায় না। নীতিগতভাবে এটা বেআইনি ও অন্যায়। তবে একটু ভিন্নভাবে সে চেষ্টা করেছেন গবেষকেরা।
২০২১ সালে প্রকাশিত একটি ছোট গবেষণা এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। একটু ভিন্নভাবে মানুষের ওপর করা এ গবেষণা বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়েছে। গবেষকেরা এ জন্য ১৪ জন স্বেচ্ছাসেবীর কাছ থেকে কিছু চুল ছিঁড়ে নেন। স্বেচ্ছাসেবীদের সবার কিছু পরিমাণে হলেও পাকা চুল ছিল। এর মধ্যে কিছু নমুনা ছিল পুরোপুরি পাকা, কিছু আংশিক পাকা, আর কিছু মোটেও পাকা ছিল না। এরপর চুলের উচ্চ রেজ্যুলুশনের ডিজিটাল ছবি তৈরি করা হয়। স্বেচ্ছাসেবীদের চুল কত দ্রুত বড় হয়, তা অনুমান করে প্রতিটি চুলের অংশ কখন পেকেছিল, তা বের করেন গবেষকেরা।
এরপর স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে আগের বছরের মানসিক চাপকালীন সময়ের একটি টাইমলাইন তৈরি করা হয়। সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন চাপের সময় বের করে গবেষকেরা দেখেন, একটি চুল পেকে যাওয়ার সময়ের সঙ্গে প্রায়ই স্বেচ্ছাসেবীদের আগের বছরের সবচেয়ে চাপের মুহূর্তটি মিলে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিহেভিয়ারাল মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক মার্টিন পিকার্ড এই গবেষণা দলে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রথম কোনো গবেষণায় ঠিক চুল পাকা শুরুর মুহূর্তের সঙ্গে নির্দিষ্ট মানসিক চাপের ঘটনা মিলিয়ে দেখা হলো।’ এটিই প্রথম বাস্তব প্রমাণ যে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ সত্যিই কিছু লোকের চুল পেকে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে।
এ ধরনের গবেষণায় মানসিক চাপজনিত পরিবর্তন শনাক্ত করতে থাকলে একসময় চুল পেকে যাওয়ার সঠিক কারণ নির্ণয় করা সম্ভব বলে মনে করেন অনেক গবেষক। এর মাধ্যমে চুলের রং আবার ফিরিয়ে আনার চিকিৎসাপদ্ধতি বের করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা। তবে এটি নিশ্চিত করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
অ্যালোপেসিয়া আইরেটা নামে আরেকটি অসুখ আছে, যার কারণে চুল পড়ে। অতিরিক্ত বা অপ্রচলিত থাইরয়েড কেমোথেরাপিও অকালে চুল পাকার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
চুল পেকে যাওয়ার অন্যান্য কারণ
বেশির ভাগ মানুষের চুল পাকে জিনগত কারণে। কারো বাবা-মায়ের যদি অল্প বয়সে চুল পেকে যাওয়ার ইতিহাস থাকে, তবে তার চুলও কম বয়সে পেকে যেতে পারে।
কিছু অসুখের কারণেও অকালে চুল পেকে যায়। এর মধ্যে আছে ভিটিলিগো বা মেলানিনজনিত কারণে ত্বকের রং হারানো। এর মাধ্যমে চুলও রঙ হারায়। আসলে, মেলানিন একধরনের জৈব রাসায়নিক। দেহে কী পরিমাণ মেলানিন উৎপন্ন ও ক্ষরিত হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে মানুষের ত্বক বা চুলের রং কেমন হবে। এ রাসায়নিকের উৎপাদন ও ক্ষরণের পরিমাণ বেশি হলে ত্বক ও চুল কালো হয়। এর পরিমাণ কমে গেলে চুল পেকে যেতে পারে, অর্থাৎ সাদা হয়ে যেতে পারে।
আবার অ্যালোপেসিয়া আইরেটা নামে আরেকটি অসুখ আছে, যার কারণে চুল পড়ে। অতিরিক্ত বা অপ্রচলিত থাইরয়েড কেমোথেরাপিও অকালে চুল পাকার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। আয়রন বা লোহা, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন বি১২ ও ভিটামিন ডি-এর ঘাটতির সঙ্গে চুল দ্রুত পেকে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। আবার স্থূলতা এবং ধূমপানের কারণেও অকালে চুল পেকে যেতে পারে।