প্রাণিজগৎ
সেন্ট মার্টিনের প্রাণবৈচিত্র্য
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার জীববৈচিত্র্য মুগ্ধকর। এ সীমার সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন ও সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড জীববৈচিত্র্যের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই জীববৈচিত্র্যের কথা ও ব্যতিক্রমী নানা প্রাণীর বর্ণনা এবং এগুলো সংরক্ষণের গুরুত্ব সংক্ষেপে লিখেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান কাজী আহসান হাবীব।
সেন্ট মার্টিন যেন এক অপূর্ব স্বর্গরাজ্য। প্রবালদ্বীপ। প্রতিবছর সেখানে ঘুরতে যান হাজারো সমুদ্রপ্রেমী। তবে এই স্বর্গরাজ্যের অনেকটাই রয়ে যায় তাঁদের চোখের আড়ালে। সমুদ্রবিজ্ঞানীরা সেই আড়ালের জগৎটির রহস্যও জানতে চান। সমুদ্রের গভীরে চোখ রাখেন তাঁরা। নীল জলরাশির আড়ালের জগৎটিতে যাদের বাস, সেই প্রাণীদের জানার ইচ্ছাতে বিজ্ঞানীরা কাজ করে যান।
বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বিশাল বঙ্গোপসাগর। এর প্রায় ১ লাখ ২১ হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমা। এই সুবিস্তৃত জলসীমা নানা প্রজাতির উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এ সমুদ্রসীমায় দেশের একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলীয় অঞ্চল। এই অঞ্চলজুড়ে উপকূলীয় রেখার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। বাংলাদেশের এই বিশাল উপকূলীয় রেখা বরাবর মূলত তিন ধরনের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বা প্রতিবেশ দেখা যায়। এগুলো হলো—
১. চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চল বরাবর পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল। এটি ফেনী নদী থেকে শুরু হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত।
২. মধ্য উপকূলীয় অঞ্চল। এটি তেঁতুলিয়া নদী থেকে শুরু করে ফেনী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে রয়েছে মেঘনার নদীমুখের বিশাল মোহনা।
৩. ভারত ও বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত হাঁড়িয়াভাঙ্গা নদী থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল। এখানে মূলত রয়েছে সুন্দরবনের বিশাল ম্যানগ্রোভ জলাভূমি। এতে রয়েছে জালের মতো বিস্তৃত আধা লোনাপানির ছোট-বড় অসংখ্য নালা, খাল ও নদীর উপস্থিতি।
বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক অঞ্চল মূলত উষ্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু ও উচ্চ বৃষ্টিপাতসমৃদ্ধ। ভূমি থেকে প্রচুর পুষ্টি সাগরে নিয়ে আসে। ফলে এটি বিশ্বের অন্যতম উচ্চ উত্পাদনশীল ও জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্র। এ সামুদ্রিক জলসীমায় এখন পর্যন্ত ৭৫০টির বেশি প্রজাতির মাছ; প্রায় ৬০ প্রজাতির সামুদ্রিক কাঁকড়া; ৭ প্রজাতির কচ্ছপ; ৩০টির বেশি চিংড়ি প্রজাতি; ৩ প্রজাতির স্টারফিশ বা তারা মাছ; ৩০০টির বেশি প্রজাতির সামুদ্রিক মলাস্ক, যেমন শামুক, ঝিনুক, সি-স্লাগ, স্কুইড ও অক্টোপাস; ৯৮ প্রজাতির প্রবাল; ৯ প্রজাতির ডলফিন; ৩ প্রজাতির তিমি এবং ১৫৬ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল পাওয়া গেছে। বিশেষভাবে কিছু অঞ্চলের কথা বলতে হয়। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাভুক্ত এ অঞ্চলগুলো সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। যেমন প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড ইত্যাদি। এ লেখায় আমরা মূলত সেন্ট মার্টিন নিয়ে আলোচনা করব। তবে অন্য দুটি অঞ্চল নিয়েও থাকবে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড। এটি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের এক অনন্য আধার। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে, তা বলা বাহুল্য। তবে এর অনেকটাই সমুদ্রের ওপরে বা দ্বীপপৃষ্ঠে দেখা যায় না। অবশ্য যেটুকু দেখা যায়, তার আকর্ষণ এড়ানোই কঠিন!
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এখন পর্যন্ত ৯৮ প্রজাতির প্রবাল, ৩০৩ প্রজাতির প্রবাল প্রতিবেশে বসবাসকারী মাছ, ১৮৭ প্রজাতির মলাস্ক, ১৩৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ২ প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস, ৪ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম, ৫ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ এবং ৯ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এ দ্বীপের সামুদ্রিক পরিবেশ মনোরম। পানির তলদেশে রয়েছে রংবেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল এবং প্রবাল প্রতিবেশে নানা রকম বিচিত্র প্রজাতির প্রাচুর্য। সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, প্রকৃতিপ্রেমী, স্কুবা ডাইভার বা ডুবুরিদের জন্য এটি তাই বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। তবে দেশে স্কুবা ডাইভিংয়ের সুবিধা তেমন নেই। তাই সমুদ্রতলের এত সব জীববৈচিত্র্য সেন্ট মার্টিন ভ্রমণকারী প্রায় সব পর্যটকের অদেখাই রয়ে যায়।
সম্প্রতি আমি (লেখক) ও আমার সহকর্মী গবেষক দল সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সাগরতলের জীববৈচিত্র্যের ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করি। এর মাধ্যমে দ্বীপের সাগরতলে লুকায়িত অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দী করি আমরা। সমুদ্রের তলদেশে তিন থেকে সাত মিটার গভীরতায় স্কুবা ডাইভিং এবং স্নরকেলিংয়ের মাধ্যমে এসব ছবি তোলা হয়েছে। এ সমীক্ষায় আমাদের গবেষক দল সাগরতলের বিভিন্ন শ্রেণির ১৩১ প্রজাতির প্রাণী ও ১৮ প্রজাতির উদ্ভিদের ছবি তোলে। এর মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক স্পঞ্জ, শক্ত প্রবাল, জোয়ানথিড প্রবাল, সমুদ্রচাবুক, সমুদ্রপাখা, সি-অ্যানিমোন, সি-ফার্ন, জেলি ফিশ, ফ্ল্যাট ওয়ার্ম, অক্টোপাস, সি-স্লাগ, শামুক, ঝিনুক, টিউব ওয়ার্ম, ফায়ার ওয়ার্ম, কাঁকড়া, লবস্টার, হারমিট কাঁকড়া, ফেদার স্টার, সমুদ্রতারা, সমুদ্রশসা, মাছ, সামুদ্রিক কচ্ছপ, সামুদ্রিক শৈবালসহ আরও অনেক কিছু। এ তালিকা শেষ হওয়ার নয়। তাই এ নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে বরং কিছু ব্যতিক্রমী ও আকর্ষণীয় প্রাণীর কথা বলা যাক।
প্রথমেই সামুদ্রিক স্পঞ্জের কথা বলি। এদের দেহ নরম ও মসৃণ। দেহপৃষ্ঠে অসংখ্য ছিদ্র থাকে। পূর্ণবয়স্ক স্পঞ্জ বিভিন্ন আকার, রং ও আকৃতির হতে পারে। যেমন গাছের মতো ছড়ানো, পেয়ালা আকৃতির, গোলাকার অথবা নির্দিষ্ট কোনো আকৃতিবিহীন। এদের কোনো মুখ, পরিপাকতন্ত্র, সংবহনতন্ত্র, পায়ু বা পেশিকোষ নেই। পানি থেকে ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য খাদ্যকণা গ্রহণ করে। মোটামুটি পরিচিত হলেও এই প্রাণীগুলো দারুণ বৈচিত্র্যময়।
এবারে বলি শক্ত বা পাথুরে প্রবালের কথা। সেন্ট মার্টিনের প্রবালপ্রাচীরের প্রধান গঠনকারী উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয় এদের। কারণ, এরা ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের তৈরি অস্থি নিঃসরণ করে। একটি প্রবালখণ্ড মূলত ‘পলিপ’ নামে শত থেকে হাজারো ক্ষুদ্র একক প্রবালের কলোনি। সাধারণত প্রবালের অসাধারণ উজ্জ্বল রং আসে পলিপের ভেতর বাসকারী ‘জুজ্যান্থেলি’ নামের ক্ষুদ্র শৈবাল থেকে। জুজ্যান্থেলি রঞ্জক পদার্থ উৎপন্ন করে। এগুলো পলিপের স্বচ্ছ দেহের ভেতর দিয়ে দেখা যায়। তাই প্রবালকে অপূর্ব সুন্দর দেখায়। প্রবাল খুব ধীরে ধীরে বাড়ে। বছরে এরা গড়ে মাত্র ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায়।
এ ছাড়া প্রবালের আরও অনেক ধরন আছে। এ রকম দুটি ধরনের কথা বলব। এক, সমুদ্রচাবুক বা সি-হুইপ। এটি চাবুক প্রবাল নামেও পরিচিত। এরা লম্বা, সরু, চাবুকের মতো শাখাযুক্ত। পাথর, প্রবালপ্রাচীর বা অন্য কোনো শক্ত পৃষ্ঠের ওপর লেগে থাকে। চাবুক প্রবাল অনেকটা পাতাহীন সামুদ্রিক গাছের মতো দেখতে। প্রায়ই লাল, কমলা, হলুদ, বেগুনি বা সাদা রঙের হয়। এগুলো লম্বায় তিন ফুট পর্যন্ত হতে পারে। দ্বিতীয় যে ধরনের কথা বলব, তার নাম জোয়ানথিড প্রবাল বা সমুদ্রমাদুর। খুব ছোট ফুলের কার্পেট বা মাদুরের মতো দেখায় এদের। কয়েক বর্গমিটার এলাকাজুড়ে ঘন কার্পেটের মতো তৈরি করতে পারে। এদের সাধারণত প্রবালপ্রাচীর, গভীর সমুদ্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন সামুদ্রিক পরিবেশে পাওয়া যায়।
সমুদ্রফুল দেখেছেন কখনো? এগুলো আসলে শক্ত কঙ্কালবিহীন একধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। নাম সি-অ্যানিমোন। বর্ণিল ফুলের মতো দেখতে। এ জন্য সমুদ্রের ফুলও বলেন অনেকে। বেশির ভাগ সময় সমুদ্রের তলদেশে পাথর বা প্রবালের গায়ে লেগে থাকে। যখন কোনো শিকার, যেমন ছোট মাছ এদের খুব কাছাকাছি আসে, তখন কর্ষিকা ব্যবহার করে শিকারের দেহে বিষাক্ত ফিলামেন্ট ঢুকিয়ে দেয় এরা। ফলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে শিকার। তখন এরা কর্ষিকা দিয়ে এই নিষ্ক্রিয় শিকার মুখের ভেতর টেনে নেয়।
ফুল যেমন আছে, তেমনি আছে সমুদ্রপাখা বা সি-ফ্যান। এগুলো একধরনের নরম প্রবাল। হাতপাখার মতো আকৃতি দেখে সহজেই চেনা যায়। বাস করে দলবদ্ধভাবে। দেখতে দারুণ সুন্দর। শাখা-প্রশাখাযুক্ত ও চ্যাপটা দেহগঠন। দেহের উপরিভাগ নরম টিস্যু দিয়ে আবৃত। পৃথিবীতে প্রায় ৫০০ প্রজাতির সি-ফ্যান পাওয়া যায়। একেকটি সি-ফ্যান আসলে অনেকগুলো সমুদ্র পলিপের কলোনি। প্রতিটি পলিপ শূন্য দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা আরও ছোট হয়। এদের ভেতরে বিশেষ একধরনের যন্ত্রণাদায়ক কোষ থাকে। সি-ফ্যান এই পলিপ ব্যবহার করে ছোট ছোট খাদ্যকণা, যেমন প্লাঙ্কটন বা ব্যাকটেরিয়া শিকার করে খায়।
জেলি ফিশের নাম সম্ভবত প্রায় সবাই শুনেছেন। এগুলো ছাতা বা ঘণ্টা আকৃতির মুক্ত সাঁতারু সামুদ্রিক প্রাণী। কোনো মস্তষ্ক, হৃৎপিণ্ড, হাড় বা চোখ নেই। কিছু প্রজাতির জেলি ফিশ স্পর্শ করলেও মানুষের বড় যন্ত্রণা হয়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো, এই জেলি ফিশগুলো প্রাণী হিসেবে অমর। একটি জেলি ফিশ কাটা পড়ে দুই খণ্ড হয়ে গেলে প্রতিটি খণ্ড থেকে একটি করে নতুন জেলি ফিশ তৈরি হতে পারে। তবে অমর হলেও শিকারে পরিণত হয় জেলি ফিশ। অনেক বড় আকারের সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন বড় মাছ ও কচ্ছপ এদের খেয়ে ফেলে। এমনকি কিছু প্রজাতির জেলি ফিশ অনেক দেশের মানুষেরও মজার খাদ্য।
এ রকম আরেকটি সুপরিচিত প্রাণী সমুদ্রতারা বা সি-স্টার। তবে সাধারণত এরা স্টারফিশ বা তারা মাছ নামে বেশি পরিচিত। নাম শুনেই বোঝা যায়, দেখতে তারার মতো। অমেরুদণ্ডী এই সামুদ্রিক প্রাণীর দেহের কেন্দ্রে একটি কেন্দ্রীয় চাকতি থাকে। এই চাকতি থেকে সাধারণত পাঁচটি বাহু বের হয়। তবে কিছু প্রজাতিতে ২৫টি পর্যন্ত বাহু থাকে। নলের মতো পা আছে এদের। এই নলাকার পা দিয়ে আঁকড়ে ধরে যেকোনো দিকে চলাচল করতে পারে। মজার বিষয় হলো কিছু প্রজাতির তারা মাছে ছিঁড়ে যাওয়া বাহুখণ্ড অথবা সম্পূর্ণ বাহুই পুনরায় গড়ে উঠতে দেখা যায়। তারা মাছের গড় আয়ু ৩৫ বছরের মতো।
এবার একটি শামুকজাতীয় প্রাণীর কথা বলি। এদের নাম নুডিব্রাঙ্ক বা সি-স্লাগ। নরম দেহের সামুদ্রিক গ্যাস্ট্রোপোড বা শামুকজাতীয় মলাস্কের একটি গ্রুপ এরা। ‘নুডিব্রাঙ্ক’ শব্দের অর্থ উন্মুক্ত ফুলকা। লার্ভা দশার পর প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এদের খোলস অদৃশ্য হয়ে যায়, উন্মুক্ত হয়ে পড়ে দেহ। দারুণ আকর্ষণীয় রং এদের। আকৃতির বৈচিত্র্যের কারণে সুপরিচিত। খোলস না থাকায় উজ্জ্বল রং এবং ঝাঁজালো গন্ধের ওপর নির্ভর করে শিকারিদের দূরে রাখে এগুলো।
এ রকম অদ্ভুত আরেকটি প্রাণীর নাম সি-কিউকাম্বার বা সমুদ্রশসা। না, সত্যি সত্যি শসা নয়, দেখতে শসার মতো। সে জন্যই এমন নাম। দেহ নরম, যদিও দেহপৃষ্ঠের নিচে কিছু অস্থি থাকে। অনেক সমুদ্রশসা তাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো পায়ুপথ দিয়ে বের করে ফেলে দেয়। পরে আবার উৎপন্ন করে নতুন করে। এদের কোনো মস্তিষ্ক নেই! নিশ্বাস নেয় পায়ু দিয়ে। সাধারণত বিভিন্ন ধরনের পণ্য, যেমন ওষুধ ও সম্পূরক খাদ্যবস্তু তৈরিতে এদের ব্যবহার রয়েছে।
কাঁকড়ার নাম শোনেনি, এমন কাউকে বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে এখানে বিশেষ একধরনের কাঁকড়ার কথা বলব। ইংরেজিতে এদের হারমিট ক্র্যাব বলা হয়। বাংলায় অনেক সময় ‘ঋষি কাঁকড়া’ বা ‘শামুক কাঁকড়া’ বলে। এরা নিজেদের নরম দেহকে রক্ষার জন্য সাধারণত সামুদ্রিক শামুকের ফাঁকা খোলসের ভেতর বাস করে। হারমিট ক্র্যাব আবর্জনাভোজী। মৃত প্রাণী বা যেকোনো কিছু পেলেই খায়। হারমিট ক্র্যাব ভালো খোলস পাওয়ার জন্য প্রায়ই খোলস পরিবর্তন করে। মজার বিষয় হলো এই খোলসের জন্য অন্য হারমিট ক্র্যাবদের সঙ্গে এদের মারামারিও বেধে যায় অনেক সময়।
আরেক ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী আছে, যারা বাস করে একধরনের টিউব বা নলের ভেতর। নাম টিউব ওয়ার্ম। এরা কোনো কিছুর পৃষ্ঠদেশে, যেমন পাথর বা ঝিনুক, এমনকি অন্য ওয়ার্মের টিউবের সঙ্গেও লেগে থাকে। দেহ খণ্ডায়িত। দেহের চারদিকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের স্থায়ী ও প্রতিরক্ষামূলক নলাকার আবরণ তৈরি করতে পারে।
সেন্ট মার্টিনের কথা অনেক তো হলো। এবারে সুন্দরবনের কথা বলি।
সুন্দরবন বাংলাদেশের আরেকটি অনন্য বাস্তুতন্ত্র। এ অঞ্চলে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোট-বড় নদী-নালা ও খাল। বাস্তুসংস্থান ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি বঙ্গোপসাগরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়ার প্রজনন ও লালনক্ষেত্র। সুন্দরবনের জলাভূমি থেকে এ পর্যন্ত ৩২০ প্রজাতির মাছ; ৬৫ প্রজাতির চিংড়ি ও কাঁকড়া; ৫৪ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক; ৭ প্রজাতির উভচর; ২৪ প্রজাতির সরীসৃপ; ৪ প্রজাতির জলজ স্তন্যপায়ী, তথা ডলফিন; ৭২ প্রজাতির জলজ বা আধা জলজ পাখি; ২৮ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল; ১১০ প্রজাতির উদ্ভিদ প্লাঙ্কটন এবং ৪৪ প্রজাতির প্রাণী প্লাঙ্কটন পাওয়া গেছে। এ বনে বাটাগুর বাসকা নামে এক প্রজাতির কাছিম পাওয়া যায়। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই মহাবিপন্ন। দুনিয়ার অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে প্রজাতিটি একসময় দেখা গেলেও বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলা হয়। এরা সুন্দরবনের কেওড়া ফল খায় আর বীজ বনের নানা জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। এভাবে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে কাছিম বিশেষ ভূমিকা রাখে।
সুন্দরবনের যেসব বন্য প্রাণী ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে, সেসবের মধ্যে অন্যতম কুমির। সুন্দরবনে কুমির দেখার উপযুক্ত সময় হলো শীত মৌসুম। সাধারণত সকালের দিকে ভাটার সময় কুমির নদী বা খালের পাড়ে রোদ পোহায়। বিকেলেও ভাটা থাকলে কুমিরকে নদী বা খালের পাড়ে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখা যায়।
এ রকম গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় অঞ্চলটির নাম সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। এটি আসলে ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের একটি গভীর খাদ। এটি সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এই গভীর খাদের গড় গভীরতা প্রায় ১ হাজার ২০০ মিটার। মৎস্য প্রজাতির পাশাপাশি স্থানটি ৫ প্রজাতির তিমি ও ৮ প্রজাতির ডলফিনের বাসস্থান ও প্রজননক্ষেত্র। ডলফিন ও তিমিদের অনেক প্রজাতি দেখা যায় এ অঞ্চলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বোতলনাক ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, ঘূর্ণি ডলফিন, গোলাপি পিঠকুঁজো ইন্দো-প্যাসিফিক ডলফিন, মসৃণ পিঠের ডলফিন (পাখাহীন), ব্রাইডিস বা বলিন তিমি, গন্ডার তিমি বা শুক্রাণু তিমি ও ঘাতক তিমি।
বিপুল এই জীববৈচিত্র্য যে শুধু আমাদের মুগ্ধ করে, তা-ই নয়। এগুলো পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা তাই এ অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যকে বোঝার পাশাপাশি সংরক্ষণেরও চেষ্টা করছেন। নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে এ জন্য। তবে এসব অঞ্চলে, বিশেষ করে সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদেরও এ ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা যাবে না। নষ্ট করা যাবে না এসব অঞ্চলের সৌন্দর্য। নাহয় একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে এসব প্রাণী। এর প্রভাব পড়বে মানুষের ওপরও।