মাইক্রোপ্লাস্টিক! আজকের বিশ্বের এক আতংকের নাম। খাদ্যকণা, প্রাণিদেহ, উদ্ভিদ, মাটি, বাতাস বা সমুদ্র—সবখানেই মিলছে এর অস্তিত্ব। প্লাস্টিক আমাদের জীবনযাত্রা সহজ করেছে সত্যি, কিন্তু বিনিময়ে পৃথিবীকে যে খেসারত দিতে হচ্ছে, তা আগে থেকে জানলে হয়তো প্লাস্টিক উদ্ভাবনই করতেন না কেউ। কার্বন-হাইড্রোজেনের বিশেষ গঠনে তৈরি এ যৌগের আণবিক গঠন ভীষণ শক্ত। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এ ধরনের যৌগকে বলে হাইড্রো-কার্বন। প্লাস্টিক বিশেষ ধরনের হাইড্রোকার্বন। নানারকম প্লাস্টিক আছে। যেমন খুব পরিচিত একধরনের প্লাস্টিক হলো পলিথিন (পলিইথিলিন)।
বেশ সহজে ভাঙে না বা ছেঁড়ে না। ইচ্ছেমতো আকার দেওয়া যায়, স্থিতিস্থাপক ধর্ম আছে। পানিতে নষ্ট হয় না। এককথায় একটা বস্তুর সোনায় সোহাগা হতে যত গুণ দরকার, তার সবই আছে প্লাস্টিকের। আর সেটাই হয়েছে কাল। সাধারণ অন্যসব পদার্থের মতো এটা পরিবেশে দ্রুত পচে যায় না। সহজে মিশে যায় না মাটির সঙ্গে। দীর্ঘ সময় পর প্লাস্টিকের কণা ভেঙে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে। প্রশ্ন হলো, মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরে প্লাস্টিকের পরিণতি কী হয়?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক আরও ভাঙতে থাকে। তবে এই ভাঙার বিষয়টি নির্ভর করে বেশ কিছু জিনিসের ওপর। গবেষকদের মতে, প্লাস্টিক যত ছোট টুকরোয় পরিণত হয়, ভাঙতে সময় লাগে তত বেশি। বেশিরভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয় বড় প্লাস্টিকের টুকরো ভেঙে। স্বাভাবিকভাবে প্লাস্টিকের মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তর হওয়ার জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ। সূর্যের আলো, অক্সিজেন ও ঘর্ষণের কারণে ধীরে ভাঙতে থাকে এই প্লাস্টিক। বিভিন্ন অণুজীবও এই ভাঙন বা ডিকম্পোজিশন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করে প্লাস্টিকের ধরনের ওপর।
বিজ্ঞানীদের মতে ন্যানোপ্লাস্টিক কণা অনেক সময় মাইক্রোপ্লাস্টিকের চেয়েও ক্ষতিকর। এনভায়রনমেন্টাল কেমিস্ট্রি লেটার জার্নালে এ সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর।
এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিকও ভাঙতে পারে। ভেঙে পরিণত হয় ন্যানোপ্লাস্টিকে। ন্যানো মানে, এক বিলিয়ন বা একশ কোটির এক ভাগ। ১০-৯। অর্থাৎ ন্যানোপ্লাস্টিকের ব্যাস ১-১০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে। প্লাস্টিকের এসব ন্যানোকণা খালি চোখে দেখা যায় না। এমনকি যন্ত্রের সাহায্যেও সহজে শনাক্ত করা যায় না এসব কণা। হতে পারে, সে কারণে ন্যানোপ্লাস্টিক নিয়ে আমরা খুব একটা শুনি না, যতটা শুনি মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে।
বিজ্ঞানীদের মতে ন্যানোপ্লাস্টিক কণা অনেক সময় মাইক্রোপ্লাস্টিকের চেয়েও ক্ষতিকর। এনভায়রনমেন্টাল কেমিস্ট্রি লেটার জার্নালে এ সম্পর্কে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর। যুক্তি হিসেবে শুরুতেই গবেষকেরা বলেন, ন্যানোপ্লাস্টিকের এমন হওয়ার কারণ, এরা অতিক্ষুদ্র ও অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল। তাঁদের মতে, প্লাস্টিকের এসব কণা আরও দূরবর্তী অঞ্চলে পৌঁছাতে পারে। এমনকি জীবন্ত কোষেও পাওয়া যেতে পারে এগুলো। গবেষণাপত্রটিতে তাঁরা অন্য ন্যানোকণা ও কৃত্রিম ন্যানোকণার সঙ্গে ন্যানোপ্লাস্টিকের গঠন, আকার, প্রতিক্রিয়াশীলতা গতিশীলতা, বায়োফিল্ম ও জীবাণু, দূষক ও প্রাকৃতিক জৈব পদার্থের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়াগুলো তুলনা করে দেখান। ন্যানোপ্লাস্টিকের সেসব ভয়ংকর দিক নিয়ে আরও বড় পরিসরে লিখতে হবে। তাই এ লেখায় আর সে আলোচনায় যাচ্ছি না।
এই নীরব ঘাতক প্লাস্টিক থেকে বাঁচতে আপাতত নিজেদের সচেতন হওয়া ছাড়া কোনো উপায়। অবস্থা যতটা খারাপ হয়েছে ইতিমধ্যেই, তার চেয়ে যেন আরও বেশি খারাপ না হয়, সেদিকটা নিয়ে চেষ্টা করতে পারি আমরা সবাই। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া, যেখানে সেখানে প্লাস্টিক না ফেলা, যত দূর সম্ভব প্লাস্টিক রিসাইকেল করা ইত্যাদি। সবাই মিলে এগুলো করলে একসময় পৃথিবী নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলবে। কমে আসবে মাইক্রো বা ন্যানোপ্লাস্টিকের তাণ্ডবলীলা।
লেখক: শিক্ষার্থী, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, এনভায়রোমেন্টাল কেমিস্ট্রি লেটারস, উইকিপিডিয়া