দেহঘড়ি
সাপে কাটার প্রাথমিক চিকিৎসা
মাঝেমধ্যে আমরা সবাই দুর্ঘটনার মুখে পড়ি। পড়ে গিয়ে ব্যথা পাই, রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করা গেলে বড় ধরনের সমস্যার হাত থেকে বাঁচা যায়। ‘দুর্ঘটনায় প্রাথমিক চিকিৎসা’ বইয়ে সেরকমই কিছু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ক্ষত সৃষ্টি, রক্তপাত, হাড় ভাঙ্গা, পুড়ে যাওয়া কিংবা সামান্য আহত হওয়ার ফলে যা যা হতে পারে, সেগুলোর প্রাথমিক চিকিৎসার উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে এই বইয়ে। বইটি ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরপর ১৯৮২ সালে মির পাবলিশার্স মূল বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে। ১৯৮৬ সালে দ্বিজেন শর্মার বাংলা অনুবাদে বইটি প্রকাশ করে মির প্রকাশন। বইয়ের লেখক ভ. ভ. ইউদেনিচ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিষাক্ত সাপের কামড়ের ক্ষত জীবনের জন্য মারাত্মক আশংকার বিষয়। বেশির ভাগ সাপে কামড়ের ঘটনা ঘটে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায়। শুধু ভারতেই বছরে ১ লাখ মানুষকে সাপে কাটে। (বাংলাদেশে এই তথ্য আরও ভয়ংকর। প্রতি বছর সাপ প্রায় ৪ লাখ ৩ হাজার মানুষকে আক্রমণ করে। এর মধ্যে মারা যান প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষ।)
বিষাক্ত সাপের ওপরের দাঁতের গোড়ায় থাকে বিষের থলি। কামড়ানোর সময় ক্ষতের বিষ রক্তনালীতে প্রবেশ করে ও রক্তস্রোতের সঙ্গে পরিবাহিত হয় সারা দেহে। সাপের বিষে থাকা নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থের মধ্যে কতগুলো স্নায়ুতন্ত্র (প্রবাল ও সমুদ্রের সাপের এবং কোনো কোনো র্যাটু সাপের বিষ) আক্রমণ করে, অন্যগুলো রক্তনালী ও হৃৎপিণ্ডের কাজ বাধাগ্রস্ত করে ও রক্ততঞ্চন ঘটায় (অর্থাৎ রক্ত জমাট বেঁধে যায়)। সে জন্য সাপের বিষক্রিয়ার প্রথম লক্ষণগুলো ভিন্ন ধরনের হয়। দংশনের পর ৩০-৯০ মিনিটের মধ্যে সাধারণ বিষক্রিয়া দেখা দেয়। দংশিত লোকটির হৃৎপিণ্ডে অভিঘাত ঘটতে পারে কিংবা শ্বসনকেন্দ্র ও পেশীগুলোর অসাড়তার জন্য রক্তচাপ হ্রাস ও শ্বাসবন্ধসহ সে অবসন্ন হয়ে পড়ে।
শুধু ভারতেই বছরে ১ লাখ মানুষকে সাপে কাটে। (বাংলাদেশে এই তথ্য আরও ভয়ংকর। প্রতিবছর সাপ ৪ লাখ ৩ হাজার মানুষকে আক্রমণ করে। এর মধ্যে মারা যান প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষ।)
প্রবাল ও সামুদ্রিক সাপের ছোবলের স্থানীয় লক্ষণ: সাপের কামড়ে ফোলা চামড়ায় দুটি ক্ষুদ্র বিন্দু দেখা যায়। ভাইপারের (অ্যাডার বা র্যাট সাপ) দংশনে যন্ত্রণা বোধ হয়, দংশনস্থল পোড়াতে থাকে, চামড়া লালচে হয়ে ফুলে ওঠে, পুরো প্রত্যঙ্গে শিরাগুলোর মতো দংশনস্থলেও প্রচুর রক্তপাত ও অন্তর্তঞ্চন (থ্রম্বসিস) ঘটে।
প্রাথমিক চিকিৎসা: ক্ষতস্থল থেকে ১৫ মিনিট ধরে ভেতরের বস্তুগুলো দ্রুত ও প্রবলভাবে চুষে বের করে নেওয়া। লক্ষণীয়, দংশনের প্রথম ৬ মিনিট মুখ দিয়ে ক্ষতটি চুষলে তিন-চতুর্থাংশ বিষ বেরিয়ে আসা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া চলে। ক্ষত শুকিয়ে গেলে চামড়া টেনে তুলে ভাঁজ করে ও চাপ দিয়ে সেটা খুলে দংশনের ভেতরের জিনিসগুলো মুখ, পাম্প বা রবারের নল দিয়ে চুষে আনা প্রয়োজন। চোষণকারীর মুখে আসা বিষ দ্রুত গলে গিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। স্মরণীয়, ছোবল থেকে নিঃসৃত বিষের মাত্রা এ ক্ষেত্রে মোটেই বিপজ্জনক নয়, এমনকি সাহায্যকারীর ঠোঁটে ও মুখের আভ্যন্তরীণ আস্তরণে আঁচড় বা ফাটল থাকলেও সমস্যা নেই।
বিষ চুষে তোলার পর দংশনস্থলে আয়োডিন টিংচার বা অস্ত্রোপচারের স্পিরিট অথবা ব্রিলিয়ান্ট গ্রিন লাগাতে হবে। শরীরের আক্রান্ত অংশ থেকে বিষযুক্ত লসিকা ধারার বেগ কমানোর জন্য প্রত্যঙ্গটি অনড় রাখা বাঞ্ছনীয়। চা, কফি, ঝোল, বুলিয়ন ইত্যাদির মতো জলীয় পদার্থ যথেষ্ট পরিমাণে পান করতে হবে। দংশিত প্রত্যঙ্গে পাক-তাগা বাঁধা কিংবা বারুদ, অ্যাসিড, ক্ষার, ফুটন্ত তেল ইত্যাদি দিয়ে দংশনস্থল পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগীকে দ্রুত নিকটতম হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। যেখানে সর্পবিষনাশী সিরাম (Serum) (অ্যান্টিগুসা, অ্যান্টিয়েফা, অ্যান্টিকোব্রা ইত্যাদি) মজুত রয়েছে।
প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগীকে দ্রুত নিকটতম হাসপাতলে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। যেখানে সর্পবিষনাশী সিরাম (Serum) (অ্যান্টিগুসা, অ্যান্টিয়েফা, অ্যান্টিকোব্রা ইত্যাদি) মজুত রয়েছে।
সর্পদংশনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নিরোধক ব্যবস্থা হিসাবে উল্লেখ্য: চামড়ার উঁচু জুতা ও শক্ত করে বোনা পোশাক ব্যবহার, তাঁবু ও বাসস্থানের আশপাশ সতর্কভাবে পরীক্ষা।
মনে রাখতে হবে, সাপেরা সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না। তারা শুধু আত্মরক্ষা করে। যাঁরা বিষাক্ত সাপ মারতে বা ধরতে চেষ্টা করেন, তাঁরাই দংশিত হয়।
(চলবে...)
* আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগিয়ে চুষে বিষ বের করলে রোগী ভালো হয়ে যাবেন—এমন একটি ধারণা এ লেখায় রয়েছে। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত বলে বইয়ে এটি রয়ে গেছে। কিন্তু ঢাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. সাইফ হোসেন খান লিখেছেন, এরও কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সাপের বিষ একবার শরীরে ঢুকে গেলে, রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেটি চুষে বের করা সম্ভব নয়। কোনো অবস্থায়ই আক্রান্ত স্থানে মুখ দেওয়া উচিত নয়। বরং যিনি মুখ দেবেন, তাঁর ক্ষতি হবে।