বন্যপ্রাণী থেকে প্রযুক্তি: বায়োমিমেটিক্সের জাদু

পাখির ওড়া দেখে মানুষের মনে হয়েছিল, মানুষও যদি উড়তে পারত! রাইট ভাইয়েরা উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে। ধীরে ধীরে মানুষ আবিষ্কার করেছে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক সব উড়োজাহাজ। বড় উড়োজাহাজ থেকে ছোট ড্রোন প্রযুক্তি—সবকিছুর শুরুই প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ থেকে।

প্রাচীনকালে মানুষের শেখার জন্য আজকের মতো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা উন্নত শহরব্যবস্থা ছিল না। মানুষ শিখেছে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতির নিষ্ঠুর আচরণ যেমন মানুষকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখিয়েছে, তেমনি মানুষ প্রকৃতি থেকেই শিখেছে কীভাবে নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করা যায়। বন্যপ্রাণীকে পোষ মানিয়ে কৃষি থেকে শুরু করে শিকারে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। প্রাণীর আচরণ এবং অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মানুষ বের করেছে নতুন নতুন কৌশল।

জাপানের বুলেট ট্রেনের কথাই ধরা যাক। জাপানি ভাষায় এটি শিনকানসেন নামে পরিচিত। এর গতি বাড়ানো এবং উচ্চমাত্রার শব্দ সমস্যা সমাধান করার পেছনে ছিল মাছরাঙা পাখির আচরণ পর্যবেক্ষণ। ঘটনাটি ঘটে ১৯৭০ সালের দিকে। জাপান বুলেট ট্রেনের প্রথম মডেল চালু করে পরীক্ষামূলকভাবে। কিন্তু ট্রেনের গতি বাড়ালেই উচ্চ শব্দের কারণে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা সমাধান করেন জাপানি এক প্রকৌশলী। তিনি পাখি ভালোবাসতেন, প্রকৃতির সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করতে পছন্দ করতেন। তাঁর নাম ইওশিহি কোবাইশি। তিনি মাছরাঙা পাখির আচরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, মাছরাঙা যখন পানিতে ডুব দেয়, তখন তার নাক এবং শরীরের বিশেষ আকৃতির কারণে বাতাসে বাধা পায় না। ফলে প্রায় নিঃশব্দে পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করতে পারে। কোবাইশি এই ধারণা কাজে লাগিয়ে ১৯৯০-এর দশকে ট্রেনের সামনের অংশে পরিবর্তন আনেন। ফলে শব্দহীনভাবে ট্রেনের গতি প্রায় ১০-২০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হয়েছিল। প্রাণীর আচরণ, গতি-প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান কাজে লাগানোর এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় বায়োমিমিক্রি। বায়োমিমেটিক্স নামেও পরিচিত জীববিজ্ঞানের এই শাখা।

আরও পড়ুন
বাদুড় ভালোভাবে চোখে দেখতে পায় না। তাই বাদুড় চলাচল, শিকার এবং যোগাযোগের জন্য ইকোলোকেশন ব্যবহার করে। ইকোলোকেশন হলো একটি জৈবিক সোনার সিস্টেম। একে বায়োসোনারও বলে।
মাছরাঙার ঠোঁটের মত ডিজাইন করা বুলেট ট্রেনের সামনের অংশ
ছবি: বায়োলজি ফর ইঞ্জিনিয়ার্স

বায়োমিমেটিক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেক প্রযুক্তির উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানের বিভিন্ন যুদ্ধ বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্রের মডেল তৈরি করা হয়েছে পাখির ওড়া পর্যবেক্ষণ করে। পাখির পাখার গঠন এবং ওড়ার পদ্ধতি জেনে বিমান ইঞ্জিনিয়াররা বিমান তৈরির ক্ষেত্রে অ্যারোডাইনামিকস আরও উন্নত করেছেন।

হাঙরের ত্বকের গঠন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা পানিবাহী যানবাহনের গতি এবং ভেসে থাকার প্রক্রিয়া উন্নত করেছেন। মাইক্রোস্কোপিক ‘ডার্মাল ডেন্টিকল’ বা ‘রিবলেট’ পাওয়া যায় হাঙরের ত্বকে। এটি পানিরোধী এবং ত্বরিত গতিতে চলতে সহায়ক। সামুদ্রিক জাহাজের গায়ে এরকম রিবলেট ব্যবহার করে জাহাজের কর্মদক্ষতা উন্নত করা হচ্ছে। একইভাবে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন অত্যাধুনিক সুইমস্যুট।

হাঙরের ত্বকের আদলে তৈরি সুইমস্যুট

আমরা জানি, বাদুড় ভালোভাবে চোখে দেখতে পায় না। তাই বাদুড় চলাচল, শিকার এবং যোগাযোগের জন্য ইকোলোকেশন ব্যবহার করে। ইকোলোকেশন হলো একটি জৈবিক সোনার সিস্টেম। একে বায়োসোনারও বলে। বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতি এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। ইকোলোকেটিং প্রাণীরা পরিবেশে শব্দ নির্গত করে এবং তাদের কাছাকাছি বিভিন্ন বস্তু থেকে ফিরে আসা সেই শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি শোনে। প্রতিধ্বনির দূরত্ব বুঝে এসব প্রাণীরা চলাচল, শিকার এবং অন্যান্য কাজ করে। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রাডার প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে। আর এখন বিমান চলাচল, নেভিগেশন, সার্ভিলেন্সসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে রাডার প্রযুক্তি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী টিকটিকির আদলে রোবট তৈরি করেছে

বন্যপ্রাণীবিদ্যার জ্ঞান প্রকৌশলীদের বিভিন্ন প্রোটোটাইপ তৈরিতেও সাহায্য করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বায়োরোবটিকসের কথা। এখানে জীবন্ত প্রাণীর চলাচল, সংবেদনশীলতা এবং প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে রোবট তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী টিকটিকির আদলে রোবট তৈরি করেছে। এই রোবট একইসঙ্গে মাটিতে ও দেয়ালে চলাচল করতে পারে, অনেকটা টিকটিকির মতো। সঙ্গে এই রোবটের ছবি তোলার ক্ষমতা এবং সার্ভিলেন্স ক্ষমতাও অনুকরণ করা হয়েছে টিকটিকির আচরণের সঙ্গে মিল রেখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রোনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ কচ্ছপের আদলে রোবট বানানোর চেষ্টা করছে। এ ধরনের রোবট সমুদ্রের বিভিন্ন প্রযুক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যাবে।  

কাছিম আকৃতির রোবট
ছবি: নিউঅ্যাটলাস

প্রাণিবিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের সংমিশ্রণে জীবপ্রযুক্তিরও দারুণ অগ্রগতি হয়েছে। বায়োচিপ, বায়োফিল্টার এবং বায়োসেন্সর ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এখন রোগ নির্ণয়, পরিবেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং টক্সিসিটি নির্ণয় করতে সক্ষম। বায়োচিপ হলো একটি ছোট ল্যাবরেটরি, যেখানে হাজার হাজার রাসায়নিক বিক্রিয়া মাইক্রোস্কোপিক স্কেলে একসঙ্গে ঘটানো যায়। বিভিন্ন রোগ এবং নিরাপত্তা গবেষণায় এটি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বায়োসেন্সর চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় এটি।

এ ধরনের উদ্ভাবনগুলো প্রমাণ করে যে প্রকৃতি এবং প্রাণী আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান। শুধু প্রাণিবিজ্ঞানী নয়, প্রকৌশলীদের জন্যও প্রকৃতির জ্ঞান থাকা আবশ্যক। প্রাণিবিজ্ঞানের সঙ্গে প্রকৌশলের এই সংমিশ্রণ প্রযুক্তির উন্নতি এবং পরিবেশের স্থায়িত্ব রক্ষায় বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: জি.কে. সুরেশকুমার, বায়োলজি ফর ইঞ্জিনিয়ারস

আরও পড়ুন