ছদ্মবেশী জীবজন্তু!

বিভিন্ন প্রাণীর ছদ্মবেশ

নাটক-সিনেমায় অভিনেতাদের ছদ্মবেশ নিতে কে না দেখেছে! অপরাধী ধরতে শার্লক হোমসের ছদ্মবেশ ভুবন বিখ্যাত। ঘাগু অপরাধীর কথা বাদ, সার্বক্ষণিক সঙ্গী ডাক্তার ওয়াটসনও তখন তাঁকে চিনতে পারেন না! যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে ফাঁকি দিতে সেনাবাহিনীও যে ছদ্মবেশ নেয়, সে খবরও আশা করি কারো অজানা নেই। কিন্তু মানুষ ছাড়াও অনেক জীবজন্তুও যে ছদ্মবেশ নেয়, সেটা কি জানা আছে? ভাবছেন, গুল মারছি? উঁহু, ঘটনা একেবারে সত্যি! সত্যি! তিন সত্যি! তাও বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, তাহলে খুলেই বলা যাক।

খাদ্য বা বাসস্থানের জন্য জীবজন্তুদের মধ্যে চলে শত্রু-শত্রু খেলা। বাঁচার প্রয়োজনে বড়রা ছোট বা দুর্বলদের শিকার করে। যেমন ছোট্ট প্রজাপতিকে খায় তার শত্রু ব্যাঙ। আর ব্যাঙকে সাপ, সাপকে খায় বাজ পাখি বা অন্য কেউ। এভাবে খাদ্যশৃঙ্খল অনুযায়ী এক প্রজাতি আরেক প্রজাতির শিকারে পরিণত হয়। ভারসাম্য আসে খাদ্যশৃঙ্খলে। টিকে থাকে জীবজগৎ। এ ক্ষেত্রে দুর্বল প্রাণী পরাজিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সবক্ষেত্রে কথাটা সত্যি নয়। দুর্বল প্রাণীরা গায়ের জোরে শক্তিশালী শিকারি প্রাণীর সঙ্গে পারে না বটে। কিন্তু তারা অন্যভাবে, বলা যায় ‘বুদ্ধির জোরে’, শক্তিশালী প্রাণীকে ফাঁকি দিতে বা পরাজিত করতে চেষ্টা করে। এমন এক পদ্ধতিই হলো ক্যামোফ্লেজ বা ছদ্মবেশ।

হরিণের ছদ্মবেশ, মিশে গেছে পরিবেশের সঙ্গে
একেক প্রজাতি একেক ছদ্মবেশ নেয়। কেউ গায়ের রং পরিবর্তন করে, কেউ অন্য প্রাণী বা গাছের মতো করে সাজায় নিজেকে। অনেকের গায়ের রং শত্রুর কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে

ক্যামোফ্লেজ পদ্ধতিতে প্রাণীরা কয়েকভাবে উপকৃত হয়। শত্রু বা শিকারি প্রাণীকে ধোঁকা দিয়ে প্রতিকুল পরিবেশে টিকে থাকে তারা। আবার অন্য প্রাণী শিকারেও এ পদ্ধতি বেশ কাজে দেয়।

একেক প্রজাতি একেক ছদ্মবেশ নেয়। কেউ গায়ের রং পরিবর্তন করে, কেউ অন্য প্রাণী বা গাছের মতো করে সাজায় নিজেকে। অনেকের গায়ের রং শত্রুর কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে। তাদেরকে কষ্ট করে রং পরিবর্তন করতে হয় না। যেমন হরিণ, খরগোশ, শজারুর ছদ্মবেশ এ ধরনের। এদের গায়ের রং সাধারণত ধূসর। এ কারণে তারা মাটি বা গাছপালার কাছাকাছি থাকলে শিকারি বাঘ বা সিংহ এদের সহজে আলাদা করে চিনতে পারে না।

এদিকে গায়ের সাদা-কালো দাগ জেব্রাকে রক্ষা করে শত্রু থেকে। এ দাগগুলোই তার ছদ্মবেশ। পশুরাজ সিংহের খাদ্য তালিকায় জেব্রাও আছে। অনেকে হয়তো জানেন না, সিংহ কালার ব্লাইন্ড বা বর্ণান্ধ। জেব্রা সহজাত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিংহকে ফাঁকি দেয়। সেটা কীভাবে? জেব্রা সাধারণত দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। গায়ে গা লাগিয়ে থাকায় দূর থেকে দেখলে সিংহের চোখে মনে হয় সাদাকালো বিশাল কোনো প্রাণী নড়াচড়া করছে। তাই সে ওই প্রাণীকে, মানে জেব্রাকে আক্রমণ করতে সাহস পায় না।

শুধু শিকার নয়, শিকারীও ছদ্মবেশ নিতে পারে

অনেকে বিপদ পড়লে নিজের গায়ের রং পরিবর্তন করতে পারে। এরা গায়ের রং বদলে পরিবেশের মতো করে নিয়ে লুকোতে পারে নিজেদের। যেমন গিরগিটি, ক্যামেলিয়ন, কাটলফিশ। গিরগিটি বিপদ টের পেলে গায়ের রং বদলে ফেলে। ফলে তাকে সেই পরিবেশ থেকে আলাদা করা যায় না। গবেষকরা বলেন, এদের দেহে বায়োক্রম নামের রাসায়নিক রঞ্জক থাকে। এ জন্য তারা ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাতে পারে। কিছু প্রাণী আবার ঋতুভেদে দেহের রং পরিবর্তন করে। যেমন মেরু শিয়াল। শীতকালে চারিদিকে ধু ধু সাদা বরফ থাকলে এদের গায়ের লোম থাকে ধবধবে সাদা। ফলে এরা বরফে ঘাপটি মেরে শিকার ধরতে পারে। আবার শত্রুর চোখও ফাঁকি দেয়। বসন্তের শুরুতে এদের লোমে কালো কালো ছোপ পড়ে। কারণ এ সময় তাদের ছদ্মবেশটা এমনই দরকার। অনেক পাখি এবং স্তন্যপায়ীও ঋতুভেদে গায়ের রং পরিবর্তন করে প্রাকৃতিক ছদ্মবেশ নেয়।

ক্যামেলিয়ন, রং বদলায় প্রয়োজনমতো

শত্রুর চোখে ধুলো দিতে ওস্তাদ সাগরতলের ক্যাটলফিশের কথা বলা যাক। এদের প্রধান শত্রু হাঙর, বড় মাছ আর বড় ক্যাটলফিশ। ক্যাটলফিশ পরিবেশের মতো নিজের দেহের রং তৈরি করতে পারে। ফলে শিকারি শত্রু ক্যাটলফিশের উপস্থিতি বুঝতে পারে না। এ ছাড়া শত্রুর উপস্থিতি টের পেলে এরা কালো রঙের একধরনের তরল ছুড়ে মারে। তাতে কিছু সময় শত্রু চোখে কিছু দেখতে পায় না। এর মধ্যেই ক্যাটলফিশ নিরাপদ দূরুত্বে সরে যায়। ঠিক একই পদ্ধতিতে শত্রুকে ফাঁকি দেয় অক্টোপাস।

কাটলফিশ

সাগরতলের আরেক অদ্ভুত প্রাণী সি ড্রাগন। এদের দেখে মনে হয়, শিকড় উপড়ানো কোনো জলজ উদ্ভিদ বোধ হয় ভেসে বেড়াচ্ছে। আসলে এদের নিয়ে একই ভুল করে শত্রুরাও। গাছের রূপ নেওয়ায় সি ড্রাগন শত্রুর হামলা থেকে বেঁচে যায়।

অনেক জীবজন্তুই অন্য প্রাণী বা গাছের ছদ্মবেশ নেয়। এতে শত্রুরা তাদের চিনতে পারে না। এই দলে আছে প্রজাপতি, ঘাসফড়িং, পাতা পোকা, ঝিঁঝিঁ পোকা, স্টিক পোকাসহ অনেক প্রাণী। স্টিক পোকার কথাই ধরা যাক। প্রথম দেখায় মনে হবে, একটা ছোট্ট কাঠি হয়তো পড়ে আছে। কিন্তু ভালোমতো খেয়াল করলে বোঝা যায়, সেটা জ্যান্ত। শখ করে কে আর কাঠি খেতে চায়! তাই বেঁচে যায় স্টিক পোকা। আবার সাদা চোখে লিফ ইনসেক্টের চেহারার সঙ্গে গাছের পাতার কোনো পার্থক্য নেই। তাকে দেখে গাছের মামুলি শুকনো মরা পাতা বলেই ভুল হয়। শত্রুর চোখে এভাবে ধুলো দিয়ে বেঁচে যায় লিফ ইনসেক্ট। প্রায় একই ধরনের ছদ্মবেশ নেয় ক্যামো মথ।

শীতকালে চারিদিকে ধু ধু সাদা বরফের মধ্যে শুভ্র ছদ্মবেশ

তবে এদের ছদ্মবেশ অনেক নিরীহ। অনেকে ভয়ংকর প্রাণীর ছদ্মবেশে শত্রুকে ভয়ও দেখায়। যেমন হক মথের ক্যাটারপিলার। এদের পেছন থেকে দেখলে মনে হবে কোনো হিংস্র সাপ মাথা উঁচিয়ে আছে। এই বোধহয় ছোবল দিল, বাপ রে! শত্রুকে ভয় দেখাতেই ক্যাটারপিলার এ ছদ্মবেশ নেয়। তাই কেউ তাকে ঘাটায় না। আর আউল বাটারফ্লাইয়ের দুটি পাখায় পেঁচার চোখের মতো হিংস্র দুটি চোখ আঁকা থাকে। দেখে মনে হয়, কোনো পেঁচা বুঝি জুলজুলে চোখে তাকিয়ে আছে। ভয়ে শত্রুরা এ প্রজাপতির কাছে ঘেঁষে না।

প্রাণীজগতে এমন ছদ্মবেশের হাজারো উদাহরণ আছে। তবে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে, বনের পশু হিংস্র হলেও তারা অকারণে কাউকে হত্যা করে না। বিপদ থেকে বাঁচতে অথবা ক্ষুধা মেটাতে ছদ্মবেশ নেয়। এসব পদ্ধতি মানুষ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। এ নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণাও। সেনাবাহিনীর ছদ্মবেশের ধারণা এসেছে এ থেকেই। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, পশুদের কাছ থেকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু মানুষ আজও অর্জন করতে পারেনি। সেটা জ্ঞানটা হচ্ছে, অকারণে কাউকে হত্যা করতে নেই।