১৮৫০-এর দশকের কোনো এক সময়ের কথা। সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যা পড়ছিলেন ইউনিস ফুট নামে এক ব্যক্তি। সেটাই পড়তে গিয়ে একটি বিষয়ে তাঁর আগ্রহ জাগে। একজন বিজ্ঞানীর মতো করে তিনি বুঝতে চান, সূর্য কীভাবে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে? আর বায়ুর ঘনত্ব এবং গ্যাসের মিশ্রণে বায়ুমণ্ডল কতটা তাপ ধরে রাখতে পারে? কীসে এই অবস্থা প্রভাবিত হয়?
তিনি কয়েকটি পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে একটিতে দেখতে পান, কার্বনিক অ্যাসিড গ্যাসের উচ্চ ঘনত্ব বাতাসকে দ্রুত উত্তপ্ত করে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য উষ্ণ থাকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে তিনি বুঝতে পারেন, বায়ুমণ্ডলে যদি এই গ্যাসের পরিমাণ বেশি থাকে, তাহলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেশি হবে।
বর্তমানে কার্বনিক অ্যাসিড গ্যাসকে আমরা কার্বন ডাই-অক্সাইড হিসাবে চিনি। এই পরীক্ষাগুলো করে বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন ইউনিস ফুট। তিনি কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং বায়ুমণ্ডলের উত্তাপের মধ্যে প্রথম যোগসূত্র স্থাপন করেন। গ্রিনহাউস প্রভাব দেখার জন্য এটাই ছিল প্রথম পরীক্ষা।
সাধারণভাবে গ্রিনহাউস বলতে আমরা বুঝি শীতের দেশে চাষের জন্য ব্যবহৃত একটি ব্যবস্থাকে। ধরা যাক, কাচের ঘরের ভেতর টমেটো গাছ লাগানো হয়েছে। সূর্যের আলো কাচের ভেতরে প্রবেশ করে ঘরের ভেতর তাপ আটকে দেয়। এতে ভেতরের বাতাস গরম থাকে। সূর্যের তাপ আটকানোর জন্য এই ব্যবস্থা দারুণ কাজের।
এবার গ্রিনহাউসের জায়গায় পৃথিবীকে কল্পনা করা যাক। কাচের ফাঁদের পরিবর্তে ভাবা যাক গ্যাস-ফাঁদের কথা। এ ফাঁদে তাপ আটকা পড়ে। আসলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং জলীয় বাষ্পের মতো গ্যাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আটকে যায়। এগুলো সম্মিলিতভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসাবে পরিচিত।
এবার সূর্য এবং ভূপৃষ্ঠকে ভাবা যাক একটি ভলিবল খেলার মাঠের দুই পাশ। মাঝখানে বায়ুমণ্ডল হলো ভলিবল মাঠের নেট। সূর্য থেকে আসা আলোকে প্যাকেট বা বল হিসাবে কল্পনা করা যাক। আলোক বলের মাধ্যমে গ্রিনহাউস প্রভাবের কথা বোঝা যাবে। ভলিবল খেলায় থাকে একটি বল। এই খেলায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বল আছে।
সূর্য এই বলগুলোকে বিকিরণের বিভিন্ন রূপ হিসাবে চারদিকে পাঠায়। দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনি রশ্মি হিসাবে অনুভব করা যায় এগুলোকে। অনুভব করার একটি উপায় তাপ। এই তাপ সূর্য থেকে বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে এসে ভূপৃষ্ঠে আঘাত করে। পৃথিবীতে এসে তাপের অনেকটা স্থলভাগ ও সমুদ্রে শোষিত হয়। স্থল এবং সমুদ্র স্বাভাবিকভাবে কিছু তাপ প্রতিফলিত করে। কিন্তু গ্রিনহাউস প্রভাব যত বাড়ে, বেশি বেশি তাপশক্তি বায়ুমণ্ডলে আটকা পড়তে থাকে। এ শক্তি মহাকাশে ফেরত যাওয়ার পরিবর্তে বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয়। পরে আবার সেখান থেকে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। এভাবে এই শক্তি বা তাপ পৃথিবীকে উষ্ণ করে তোলে।
এখন এই মহাজাগতিক ভলিবল খেলায় পৃথিবী হারতে বসেছে। প্রতিবছর গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ আরও বাড়ছে। ভলিবল মাঠে পৃথিবীর কোর্টে ক্রমাগত বেশি সংখ্যক বল জমে যাচ্ছে। কিন্তু কোর্টে বল পেলেও অপর পাশে বল ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। বায়ুমণ্ডলের গ্যাসগুলোর মধ্যে অল্প অংশ গ্রিনহাউস গ্যাস। তবে এটুকুই গ্রহের সামগ্রিক তাপমাত্রা এবং এর জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এমনকি বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে মাত্র কয়েক ভাগ বাড়লেই বড় পরিবর্তন ঘটে তাপমাত্রায়। যা মারাত্মক আবহাওয়া বয়ে আনে। গলে যায় মেরু অঞ্চলের জমাট বরফ। পৃথিবীর জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে।
এগুলো কীভাবে জানা গেল? কয়েক মিলিয়ন বছর পুরোনো শিলা এবং জীবাশ্মের রসায়ন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, কীভাবে প্রাচীনকালে তাপমাত্রা ওঠানামা করেছিল। কীভাবে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কম-বেশি হয়েছে। সাম্প্রতিক চিত্র বুঝতে হিমবাহ থেকে ভালো রেকর্ড পাওয়া যায়। গ্রিনল্যান্ডের বরফ এবং অ্যান্টার্কটিকার বরফের ক্যাপগুলো কয়েক হাজার বছর আগে থেকে বায়ুমণ্ডলের ক্ষুদ্র বুদবুদগুলো সংরক্ষণ করেছে। বর্তমানে এগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই রেকর্ডগুলো বলে, পৃথিবীর সাড়ে চার বিলিয়ন বছরজুড়ে কখনো কখনো আজকের তুলনায় অনেক বেশি ঠান্ডা ছিল। অন্যান্য সময়ে পৃথিবী ছিল অনেক উষ্ণ।
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়া স্টেশন এবং জাহাজে তাপমাত্রার পরিমাপ শুরু হয়। ক্রমাগতভাবে এটা এখনও চলছে। এই তথ্যের মাধ্যমে জানা যায়, পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
গত ২০০ বছরে একটি বড় ঘটনা শিল্পবিপ্লব। মানুষ যখন আবিষ্কার করল জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে অনেক দ্রুত এবং অনেক কম চেষ্টায় কাজ করা যায়, তখন কয়লা, তেল এবং গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি তাপ এবং বিদ্যুতের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে ওঠে। এই আবিষ্কার আধুনিক সভ্যতাকে বর্তমান রূপ দিয়েছে। যেমন গাছ থেকে একটি বইয়ের কাগজ প্রস্তুত হয়ে পাঠকের হাতে আসতে বিভিন্ন পর্যায়ে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তাপ উৎপাদন করে তা ব্যবহার করা হয়।
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবহাওয়া স্টেশন এবং জাহাজে তাপমাত্রার পরিমাপ শুরু হয়। ক্রমাগতভাবে এটা এখনও চলছে। এই তথ্যের মাধ্যমে জানা যায়, পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। পরে বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইটের সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা অনুসরণ করতে শুরু করেন। এ ছাড়া ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডে খুঁজতে শুরু করেন জলবায়ু পরিবর্তনের সূত্র।
এই শতকের শেষে স্কটিশ প্রকৌশলী জেমস ওয়াট একটি কয়লা চালিত বাষ্প ইঞ্জিনের নকশায় কিছু উন্নতি করেন। তাঁর আশা ছিল, এ নতুন ইঞ্জিন গভীর কয়লাখনির তলদেশ থেকে আরও দক্ষভাবে পানি পাম্প করবে। কিন্তু এটি তার আশার চেয়ে অনেক ভালো কাজ করেছে। এখনও পর্যন্ত এই যন্ত্রের উন্নত রূপ আমরা সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করছি।
ওয়াট প্রথম আধুনিক বাষ্প ইঞ্জিন তৈরি করেন। এটিই সভ্যতাকে শিল্প বিপ্লবের দিকে নিয়ে গেছে। কয়েক লক্ষ বছর হাত বা গায়ের শক্তি এবং প্রাণীর সাহায্যে মানুষ কাজ করেছে। জেমস ওয়াটের আবিষ্কারের পর মাত্র কয়েক দশকেই এখন যন্ত্রের সাহায্যে প্রায় সব করা হয়। ইউনিস ফুটের গ্রিনহাউস গ্যাস আবিষ্কার থেকে জেমস ওয়াটের স্টিম ইঞ্জিন পর্যন্ত আবিষ্কারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বেড়েছে। তাই গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে এখন বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকারও নানা উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রেটা থুনবার্গের মতো জলবায়ু সচেতন কিশোর-তরুণরা গড়ে তুলেছে জলবায়ু আন্দোলন। এখনই সময় জলবায়ু সচেতন হওয়া। তা না হলে একসময় পৃথিবীটা হয়তো আর বাসযোগ্য থাকবে না।
লেখক: বিজ্ঞানকর্মী