আমাদের পোষা পাখি

এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…

ভরদুপুরে গাছের ডালে বসেছে একটি ঘুঘু। মানরা, মানিকগঞ্জ সদর, ২১ জুলাইছবি: আবদুল মোমিন

শীতের বিকেল বেলা। ছোট ফুলবাগানের ফুলগাছগুলোতে জল দিচ্ছে নিপু। এমন সময় কাছের লিচু গাছটার মাথায় ঝড় উঠল যেন। তাকিয়েই চমকে গেল ও। বিশাল একটি পাখি লিচুর সরু ডালে দুপায়ের ভর রাখতে চেষ্টা করছে, পারছে না। বিশাল দুটি ডানা মেলে ধরে ঝাঁপটাচ্ছে প্রবল। কী বড় ওর ঠোঁট! ডান ডানাটার গোড়া ওর ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে নিপু চেঁচাতে শুরু করল। ছুটে এলেন ওর বাবা-মা। পাখিটিকে দেখে বাবা হেসে বললেন যে, এটার নাম হচ্ছে শামুকভাঙ্গা পাখি। কোনো শিকারি একে গুলি করেছে, আহত হয়েও এতদূর উড়ে এসে দম ফেল করে পড়েছে ওই লিচু গাছের মাথায়। ভালোই হলো। মাংস খাওয়া যাবে।

বাঁশের লগি দিয়ে পাখিটিকে পেড়ে ফেলা হলো নিচে। নিপুর বাবা কৌশলে ওর দুটি ডানা ধরলেন। ডানার ঝাঁপটায় পাখির রক্ত ছিটকে এসে লাগল তার জামাকাপড়ে। পাখিটি তার লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর মারতে চাইছে, পারছে না। নিপুর বাবা খুব খুশি। বললেন, এই পাখির ঝাঁক তো প্রায়ই আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে যায় সুন্দরবনের দিকে। ওদিক থেকেও আসে। ওরা নামে গিয়ে বিল কোদালিয়ায়।

রক্তাক্ত পাখিটিকে যখন বাড়ির উঠানে আনা হলো, নিপুর মনটা তখন কেঁদে উঠল। মুক্তি পাবার জন্য পাখিটি ছটফট করছে। ভয়ে ওর চোখ দুটি গেছে ঘোলা হয়ে। নিপু তখন বলেই ফেলল তার মনের কথা। পাখিটিকে পুষবে সে। ভালোবাসবে। খাওয়া চলবে না ওকে। রাজি হলেন ওর বাবা-মা। নিপুর একটি খাঁচাবন্দি পোষা টিয়া আছে। নিপুকে দেখলেই 'নিপু-নিপু' বলে ডাক ছাড়ে। বুলি ফুটেছে ওর মুখে। ঘরের বারান্দার চালায় ঝুলানো থাকে খাঁচাটি।

নিপুর বয়স ১০ বছর। বাবা-মার খুবই আদরের। শামুকভাঙ্গা পাখিটিকে তাই পোষার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। ডেকে আনলেন পাড়ার এক ডাক্তারকে। তিনি ক্ষতস্থানে কী সব পাউডার লাগিয়ে দিলেন। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন ক্ষতস্থানে কার্তুজের ছররা বিঁধে আছে কি না। নেই।

ঘরের তিনটি রুমের সবচেয়ে ছোটটিতে রাখা হলো পাখিটিকে। তড়িঘড়ি পুকুর থেকে ছোট-বড় শামুক, মাছ ও ঝিনুক তোলা হলো। একটি গামলার জলে রাখা হলো মাছগুলোকে। শামুক-ঝিনুকগুলোকে রাখা হলো মাটির মেঝেতে। একগাদা কুটো এনে এক কোনায় পাখিটির জন্য বাসা মতো করে দেয়া হলো। কিন্তু পাখিটি ওদিকে তাকাল না পর্যন্ত, চারপাশে হেঁটে হেঁটে পালাবার চেষ্টা করতে লাগলো, ঝাঁপটাতে লাগলো ডানা।

পরদিন সকালে চুপি চুপি নিপু উঁকি দিল ঘরে। দেখে, পাখিটি গামলার জল থেকে মাছ খাচ্ছে। তারপর সে একটি মাঝারি শামুক তুলে নিয়ে এল ঠোঁটের মাঝ বরাবর, দুই ঠোঁটের ফাঁকের ওই জায়গাটা বেশ একটু ফাঁকামতন। ওখানেই শামুকটা ধরে চাপ দিতেই কটাস শব্দে ভেঙ্গে গেল শামুকের শক্ত খোলা। খোলা ফেলে পাখিটি শামুকের মাংস খেতে লাগল। তখন খুশিতে নিপু যেই না ঘরে ঢুকল, অমনি ডানা ঝাঁপটে সরে গেল পাখিটি। একটু সরে এসে নিপু দাঁড়িয়ে রইল—দেখবে সে পাখিটির খাওয়া। কিন্তু পাখিটি টানটান গলায় তাকিয়েই রইল, খাবার খাচ্ছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নিপু। চুপি চুপি বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকাতেই দেখে, খাচ্ছে পাখিটি। সে বুঝল, মানুষের সামনে ও খেতে ভয় পায়।

শামুকভাঙ্গা পাখি
ছবি: আলীমুজ্জামান

বিশ দিনের ভেতর পাখিটি পোষা হয়ে গেল। অভ্যস্ত হয়ে গেল ওই বদ্ধ ঘরের জীবনে। নিপুর সামনেও খাবার খায়। ভয়ও পায় না তেমন। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমায় কুটোর বাসায়। বিকেলের দিকে ওর পায়ে দড়ি বেঁধে নিপু ওকে হাঁটাতে নিয়ে আসে ফুলবাগানের সামনে। পাখিটি হাঁটে। লাফ দেয়। পাখা মেলে উড়ালও দিতে চায় মাঝেমধ্যে। আকাশ পথে কোনো পাখি উড়ে গেলে ঘাড় কাত করে ও তাকিয়ে থাকে টানটান গলায়। ও এখন পুরোপুরি সুস্থ।

পাখির ঠিকানা হচ্ছে মুক্ত আকাশ। তাকে বন্দি করে রাখা বা বুনো জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করা অন্যায়। পাখির ডানার স্বাধীনতা কোনো মানুষেরই হরণ করা উচিত নয়।

সেদিন বিকেলেও নিপু পাখিটিকে হাঁটাচ্ছিল খোলা মাঠটাতে। দূর থেকে ধীর লয়ে উড়ে আসছে বিশাল একঝাঁক শামুকভাঙ্গা। এই কদিনে বাবার কাছে সে শামুকভাঙ্গা সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনেছে। বার কয়েক উড়েও যেতে দেখেছে ঝাঁক। এই ঝাঁকটি দেখে তার মনে হলো, বন্দি পাখিটিকে ছেড়ে দিলে কেমন হয়। পাখিটির পায়ের রশি খুলে দিল সে। পরম সোহাগে পাখিটিকে ধরল বুকের কাছে। উড়ন্ত ঝাঁকটি কাছাকাছি আসতেই শূন্যে ছুঁড়ে দিল সে হাতের পাখিটিকে। সঙ্গে সঙ্গে দুই বার ডাক ছেড়ে নিপুকে বোধহয় ধন্যবাদ জানাল পাখিটি। তারপর বিশাল দুটি ডানার বাতাসে নিপুর চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে উড়ে গেল পাখিটি, মিশল গিয়ে উড়ন্ত পাখির ঝাঁকে। চললো সুন্দরবনের দিকে। নিপুর মন ভরে গেল অনাবিল শান্তিতে। চোখ উঠল ভিজে। একটি পাখিকে মুক্তি দেওয়ার মধ্যে এতটা আনন্দ! এত শান্তি! সঙ্গে সঙ্গে সে সিদ্ধান্ত নিল, ছেড়ে দেবে পোষা টিয়াটিকেও। চলে এলো সে বাড়ির উঠানে। ছেলের কথা শুনে বাবা হেসে বললেন, শামুকভাঙ্গাটা প্রকৃতিতে টিকে থাকার মতো সব ট্রেনিংই পেয়েছিল। চিনেছিল শত্রু-মিত্র। ও টিকে থাকবে। খাবার খেতে পারবে। কিন্তু এই টিয়াটাকে আবেগের বশে ছেড়ে দিলে টিয়াটিকে হত্যা করার মতো কাজই করা হবে। ওকে আনা হয়েছিল বাচ্চা অবস্থায়। বুনো জীবনের কোনো ট্রেনিংই ও পায়নি। চেনে না খাবার, জানে না শত্রু-মিত্র কারা। প্রকৃতিতে টিকে থাকার সবরকম যোগ্যতাই ও হারিয়েছে। ওকে ছেড়ে দিলেও ফিরে আসতে চাইবে ওর অভ্যস্ত জীবনে। যদি চলেও যায়, বাঁচতে পারবে না ও।

নিপু বুঝলো বিষয়টি। টিয়াটিকে ছাড়ল না। তবে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, বাকি জীবনে সে আর কোনোদিন কোনো পাখি পুষবে না। পাখির ঠিকানা হচ্ছে মুক্ত আকাশ। তাকে বন্দি করে রাখা বা বুনো জীবনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করা অন্যায়। পাখির ডানার স্বাধীনতা কোনো মানুষেরই হরণ করা উচিত নয়।

ওপরে উল্লিখিত দুটি পাখিই কিন্তু ছিল পোষা। ওরা পোষ মেনেছিল। কিন্তু এই পোষ মানারও রকমফের আছে। কী রকম? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে জেনে নেয়া যাক, পোষা পাখি কাকে বলে?

আরও পড়ুন

পোষা পাখি কাকে বলে?

আমার মতে, পোষা পাখি হচ্ছে সেই সব পাখি, যেসব বুনো পাখিকে ধরে খাঁচায় বন্দি করে রাখলেও সুস্থ থাকে, সজীব থাকে, নিয়মিত খাবার খায় ও উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ডাকাডাকি করে বা গান গায় এবং উপকরণ ও জায়গা থাকলে বাসা বাঁধে ও ডিম পেড়ে সেই ডিম তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। সেই বাচ্চাদের খাওয়ায় ও আদর করে। এসব পাখিই হচ্ছে পোষা পাখি। খাঁচা ছোট হতে পারে, মাঝারি হতে পারে আবার অনেক বড়ও হতে পারে। বিশাল জায়গা জুড়ে উঁচু উঁচু গাছগুলোকে ভেতরে রেখেও চমৎকার বেষ্টনী করা যায়, ওর ভেতরে পাখিরা বলতে গেলে বুনোপাখির মতোই স্বাধীন থাকে। চিড়িয়াখানাতেই সাধারণত এই ব্যবস্থা করা হয়। বাড়ির ছাদ বারান্দায় বড় জায়গা করা যায়।

পোষ মানার রকমফের কেমন

মুক্ত পোষা পাখি: যেসব পাখি পোষ মানার পর খাঁচা থেকে ছেড়ে দিলেও উড়ে চলে যায় না, পোষক বা পোষকদের আশপাশেই থাকে, ডাক দিলে উড়ে এসে হাতে, ঘাড়ে বা মাথায় বসে, বিশ্রামের সময় হলে খাঁচায় ঢুকে পড়ে, তারাই হচ্ছে মুক্ত পোষা পাখি। এদেরকে ছেড়ে দিয়েও পোষা চলে দিব্যি। এ রকম পাখির উদাহরণ হচ্ছে: আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল (ম্যাগপাই রবিন), কমলাবউ (অরেঞ্জ হেডেড গ্রাউন্ড থ্রাস), ভীমরাজ (র‍্যাকেট টেইল্ড ড্রোঙ্গো), ডাহুক (হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন), কালিম (পার্পল মুরহেন), কোড়া (কোরা), বুলবুল (রেড ভেন্টেড বুলবুল) ও ডুংকর (ইন্ডিয়ান মুরহেন)। তবে পোষক ভালো না হলেও পোষা পাখিটির বয়স (পোষাকালীন বয়স) একটু বেশি হলে এবং বাচ্চা অবস্থা থেকে পুষতে শুরু করলেই কেবল মুক্ত পোষা পাখি পাওয়া যেতে পারে। মুক্ত পোষা পাখি কালিম ডিম-বাচ্চাও দেয়, পোষা মুরগির মতো বাচ্চাদের নিয়ে চরাইও করে। কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার কিছু এলাকায়, শেরপুর জেলার একটি এলাকায় ও বাগেরহাট জেলার একটি গ্রামে আমি এ রকম মুক্ত পোষা কালিম ও তাদের কুশি কুশি ছানাদের দেখেছি। কিশোর বয়সে আমি দোয়েল, ডাহুক, হালতি, বনকোয়েল, বড় হালতি, কমলাবউ ও ডুংকর পোষার চেষ্টা করেছিলাম।

কীটপতঙ্গ শিকারের অপেক্ষায় দোয়েল।
ছবি: সোয়েল রানা
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের অনেক মানুষই পাখি পোষে শখের বশে। দেখতে ভালো, মনকাড়া ডাক ছাড়ে বা গান গায়, অথবা নানান রকম সুন্দর সুন্দর কসরত দেখায় খাঁচার মধ্যে, এ কারণেই পাখি পোষে।

বন্দি পোষা পাখি: যেসব পাখি খাঁচাবন্দি করা ছাড়া পোষা চলে না, সুযোগ পেলেই উড়ে পালিয়ে যায়, তারাই হচ্ছে বন্দি পোষা পাখি। এ দলে সব পোষা পাখিকেই ফেলা চলে।

 

খাঁচায় অভ্যস্ত পোষা পাখি: যেসব পাখি খাঁচার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, চুপচাপ থাকে, খাঁচা থেকে পালাবার জন্য ছটফট করে না বা খাঁচা ভেঙে পালাবার কসরত করে না, তারাই হচ্ছে খাঁচায় অভ্যস্ত পোষা পাখি। এ দলে পড়ে তিলা ঘুঘু (স্পটেড ডাভ), ভাত-শালিক (কমন ময়না), সবুজ ঘুঘু (ব্রাঞ্জড উইংড ডাভ), শ্যামা ইত্যাদি।

খাঁচায় ছটফট পাখি: যেসব পাখি দিনের বেশিরভাগ সময়ে খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করে, ফাঁক-ফোঁকর খোঁজে ও ঠোঁট-পা চালিয়ে খাঁচা ভেঙে পালানোর কসরত করে, তারাই পড়ে এই দলে। খাঁচায় অভ্যস্ত পোষা পাখিদের মনোভাব যেমন- ‘খাঁচায় খুব সুখেই আছি, নিরাপদে আছি,’। খাঁচায় ছটফট পাখিদের স্বভাব ঠিক এর উল্টো। হাবভাবে ওরা সব সময় প্রকাশ করে যে, ‘খাঁচার ভেতরে বড্ড যন্ত্রণায় আছি। মুক্তি পেতে চাই।’ এ দলে আছে টিয়া (আলোক্সজাড্রিন প্যারাকিট), লালবুক টিয়া (রেড ব্রেস্টেড প্যারাকিট), কন্ঠি টিয়া (রোজ রিংগড প্যারাকিট), লটকন (লরি কিট), ময়না (হিল ময়না), সিপাহি বুলবুল (রেড হুইসকার্ড বুলবুল) ও অন্যান্য পাখি। টিয়ারা তো সুযোগ পেলেই খাঁচার শিক কেটে পালায়। আবার মুক্ত পোষা টিয়াও আমি ঢাকার রূপগঞ্জে দেখেছি। তবে এটা ব্যতিক্রম।

ভাত শালিক। এই পাখির ইংরেজি নাম কমন ময়না
ছবি: পলাশ বড়ুয়া

বাংলাদেশের মানুষ পাখি পোষে কেন?

শুধু শখের জন্য: বাংলাদেশের অনেক মানুষই পাখি পোষে শখের বশে। দেখতে ভালো, মনকাড়া ডাক ছাড়ে বা গান গায়, অথবা নানান রকম সুন্দর সুন্দর কসরত দেখায় খাঁচার মধ্যে, এ কারণেই পাখি পোষে। এসব পোষকের প্রধান বিবেচ্য পাখির সৌন্দর্য। খাঁচায় বন্দি ঘুঘু গলা ফুলিয়ে ডাকছে, আয়নায় নিজেকে দেখে প্রতিপক্ষ ভেবে আক্রমণ করতে চাইছে, এমন দৃশ্য দেখতে ভালোই লাগে। পোষা পুরুষ কোড়াও আয়নায় নিজেকে দেখে প্রতিপক্ষ ভাবে, আক্রমণ করতে চায় প্রবল বিক্রমে। শৌখিন পোষকেরা সাধারণত পোষে ময়না, ভাত শালিক, ঝুঁটি শালিক, দুই তিন প্রজাতির মুনিয়া, টিয়া, ছিট ঘুঘু, লাল ঘুঘু (রেড টার্টল ডাভ), সবুজ ঘুঘু, শ্যামা ইত্যাদি। বেশ কয়েক বছর যাবৎ ঢাকাসহ দেশের অনেক ছোট বড় শহরে বিদেশি পাখি পোষার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বিদেশি পাখি কেনার দোকানও রয়েছে। শৌখিন পোষকেরা সৌন্দর্যের কারণেই বিদেশি পাখি পোষে। এ দলে পড়ে লাভ বার্ড, জাভা স্প্যারো, বদরী, রোজেলা, ককাটেল, জেব্রা ফ্রিঞ্জ ইত্যাদি। এই সব বিদেশি পাখি বহু বছর যাবৎ খাঁচায় থাকতে থাকতে, বংশ বৃদ্ধি করতে করতে এখন খাঁচায় একেবারেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খাঁচার পাখি নামেই এরা খ্যাত। এক জার্মান দম্পতিকে আমি পাখির দোকান থেকে একজোড়া লাভ বার্ড ও একজোড়া জাভা স্প্যারো কিনে ঢাকার আকাশে উড়িয়ে দিতে দেখেছিলাম। ওই দম্পতি আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু চারটি পাখিকে মৃত্যুর দরজায়ও ঠেলে দিয়েছিলেন। খাঁচায় জন্মগ্রহণ করা পাখি, যে কি না খাঁচার ভেতরেই বড় হয়েছে, তার পক্ষে বাংলাদেশ নামে এই বিদেশের প্রকৃতিতে কোনোভাবেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কাক-চিলে যদি নাও ধরে, তবুও মরবে ওরা অনাহারে। এ ধরনের বন্দি পাখিকে মুক্ত করে দেয়ার বিপদও কম নয়। 

আরও পড়ুন
শহর বন্দরে একটু বেশি দামে বিক্রি হলেও গ্রামগঞ্জে এ রকম একজোড়া ঘুঘু ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়

সুখ ও জীবিকার জন্য: এককালে গ্রাম-বাংলার অনেক মানুষ ক্ষেত খামারের কাজের অবসরে পোষা পাখি দিয়ে বুনো পাখি শিকার করে বিক্রি করত। এটা ছিল শখের পাশাপাশি টাকা রোজগারের একটা উপায়। তখন পাখিও প্রচুর ছিল, শিকারও মিলত দেদার। তারা সাধারণত পুষত দুই তিন প্রজাতির ঘুঘু, ডাহুক, কালিম, কোড়া, বুলবুল ইত্যাদি। উল্লিখিত পাখিদের পুরুষগুলোই পোষা হত। ওদের পুরুষগুলো তার রাজত্বে অন্য কোনো অচেনা পুরুষ দেখলেই আক্রমণ করতে আসে। এসেই পড়ে যায় ফাঁদে। সরু সরু বাঁশের লগি একটার পেছনে আরেকটি লাগিয়ে পোষা ঘুঘুকে খাঁচা সমেত তুলে দেয়া হয় কোনো গাছে। পোষকের শিস শুনে বা এমনিতেই ঘুঘুটি ডাকতে শুরু করে। বুনো ঘুঘু এসে খাঁচার সামনে যেই বসতে যায়, অমনি সে পাতা জালের ফাঁদে বন্দি হয়ে যায়। আর ঘুঘুর ফাঁদ যে কী জিনিস! ‘ঘুঘু দেখেছ, ঘুঘুর ফাঁদ দেখোনি’ কথাটির উদ্ভব কী এমনি এমনি হয়েছে। ডাহুক, কোড়া, কালিমের ক্ষেত্রেও এ রকমটি ঘটে। তবে খাঁচা ছাড়াও ডাহুক, কোড়া ও কালিম পাখি শিকার করতে দেখেছি আমি। ডাক শুরু করতেই বা পোষা পাখিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে আসে বুনোপাখি, লেগে যায় মারামারি। পায়ে পায়ে আঁকড়ে ধরে পরস্পরকে। তখন পোষক দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলে বুনো পাখিটিকে। ডাহুক, কোড়া ও কালিম আজো পোষা হয় গ্রাম-বাংলায়। তবে শিকার মেলে খুব কম। ঘুঘু বিশেষ করে তিলাঘুঘু পোষার প্রচলন আজও যথেষ্ট আছে, শিকারও বেশ মেলে। শহর বন্দরে একটু বেশি দামে বিক্রি হলেও গ্রামগঞ্জে এ রকম একজোড়া ঘুঘু ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়।

পাখি পোষার প্রবণতা কাদের বেশি: শিশু-কিশোরদের ভেতরই পাখি পোষার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। গ্রাম-বাংলার শিশু-কিশোরেরা আজও পাখির বাসা দেখে রাখে, নজরে নজরে রাখে, সময় মতো পাখির ছানা এনে খাঁচা বন্দি করে ফেলে। বড়দের ভেতর যেমন মহিলাদের পাখি পোষার শখ বেশি, তেমনি শিশু-কিশোর বয়সীদের ভেতর মেয়েদের পাখি পোষার শখ একেবারেই কম লক্ষ করা যায়।

জোড়া ঘুঘু পাখি
ছবি: আনিস মাহমুদ

কীভাবে পোষার জন্য পাখি সংগ্রহ করা হয়: গ্রাম-বাংলায় পাখি সংগ্রহ করা হয় পাখির বাসা থেকে। পোষা পাখি বড় হলে কেনাবেচার রেওয়াজও আছে। পোষকের শিস শুনে ডাকতে শুরু করে যে ঘুঘু, ডাহুক, কালিম ও কোড়া তাদেরকে বলা হয় ‘শিকারি’। শিকারি ঘুঘু, ডাহুক, কোড়া চড়া দামে বিক্রি হয়। পোষার জন্য পাখি বা পাখির বাচ্চা কেনার জন্য (বাংলাদেশের পাখি) ১৫ দিনব্যাপী একটা বাজার বসে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানায়। সবাই বলে ‘পাখির মেলা’। হিন্দু সম্প্রদায়ের রথের মেলার শুরুতেই শুরু হয় ওই পাখির মেলা, জমজমাট হয় উল্টোরথের দিনে। ২০০০ সালে ওই পাখির মেলায় গিয়েছিলাম আমি। শুধু পাখি নয়, পোষা পাখির জন্য খাঁচার মেলাও বসে আলাদাভাবে। বাহারি সব খাঁচা। দাম ২০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। ভোগবেতাল গ্রামের ওই রথের মেলায় দেখেছিলাম ময়না, গো-শালিকের বাচ্চা, কোড়ার বাচ্চা, বকের বাচ্চা ও হলদে বউয়ের বাচ্চাসহ আরও অনেক পাখি। কেনাবেচা হচ্ছিল ভালোই। ওই পাখির মেলা ঘিরে ওই এলাকার শিশু-কিশোররা বেশ আগে থেকেই নানা রকম পাখির বাসার খোঁজ-খবর রাখতে শুরু করে, পাখির ছানা নিয়ে মেলায় যায় বেচতে। অনেক মানুষ পোষার জন্য ওই মেলায় পাখি কিনতে যায়। এখানে শখ ও জীবিকার আশ্চর্য সমাহার দেখা যায়। ২০০৮ সালের মেলায়ও গিয়েছিলাম।

আরও পড়ুন
অভিজাত শ্রেণির লোকজন এক সময় বুলবুল পুষত। মোরগ লাড়ইয়ের মতো বুলবুলির লড়াইও এক সময় জনপ্রিয় খেলা ছিল এই বাংলায়।

বাংলাদেশে কী কী পাখি পোষা হয়: বাংলাদেশে বিদেশি বাদ দিলে সাধারণত পোষা হয় ময়না, শালিক, ঘুঘু, টিয়া, ডাহুক, কালিম, কোড়া, ডুংকর, বুলবুল, মুনিয়া, হলদে বউ, শ্যামা ইত্যাদি। হাঁস-মুরগি-তিতির (আফ্রিকান গিনি ফাউল) কবুতরও কিন্তু পাখি। যেসব রাজহাঁস বা অন্য হাঁস ও কবুতর পোষা হয়, ওদের আদি পিতা-মাতারা কিন্তু আজো বুনো রয়ে গেছে। যেমন দুনিয়ার সব পোষা মোরগ-মুরগির আদি পিতামাতা হচ্ছে লাল বনমোরগ ও মুরগি (রেড জঙ্গল ফাউল), যেটা আজও বাংলাদেশের সুন্দরবনে, সিলেট, চট্টগ্রামের পাহাড় টিলাময় জঙ্গলে যথেষ্ট আছে। হাঁসেদের আদি পিতামাতারাও প্রতি বছর অতিথি হয়ে আমাদের দেশে আসে। আর দুনিয়ার সব পোষা কবুতরের আদি যে পিতামাতা, সেই বুনো কবুতর বা জালালী কবুতর (ব্লু রক পিজিয়ন) বাংলাদেশে তো বটেই, ঢাকা শহরেও প্রচুর আছে। সুন্দরবনের বন মুরগির ডিম পোষা মুরগির তায়ে বসিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে পোষার চেষ্টা আমি কিশোর বয়সে বেশ কয়েকবার করেছিলাম। সুন্দরবন থেকে ধরে আনা ছানাও পোষার চেষ্টা করেছিলাম, সফল হইনি। বুনো কবুতরকেও পোষ মানানো অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় পোষা পাখি হচ্ছে কবুতর। কবুতর শান্তির প্রতীক। বাংলাদেশে যত কবুতর পোষা হয়, সে তুলনায় অন্য পাখি একেবারেই নগণ্য। 

মানুষ কেন পাখি পোষে: পাখি পোষা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। বলা যায় জন্মগত প্রবৃত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পাখি পুষে আসছে। একদিন যা ছিল নেশা, ক্রমে ক্রমে তা পেশায় পরিণত হয়। পাখির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই মানুষ পাখি পুষতে শুরু করেছিল। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের ছিল একটি মদীশালা। সেখানে ছিল বহু দেশিবিদেশি পাখি। তিনি নিয়মিত ওসব পাখির আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতেন।

বর্তমান যুগে পাখি বিজ্ঞানীরাও কিছু কিছু পাখি পোষেন গবেষণার জন্য। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হিসেবে শিকারি পাখিদের পোষা শুরু হয়েছিল। ঈগল-বাজরা মুক্ত অবস্থায় খরগোশ, অন্যান্য পাখি ও ছোট ছোট প্রাণী শিকার করত, আজও তা করে। বাংলাদেশের দুই তরুণের কথা আমি জানি, যাদের একজন একটি বাজ পুষেছিল, পরে ছেড়েও দিয়েছিল। অন্যজন এখনো পুষছে একটি ঈগল। অভিজাত শ্রেণির লোকজন এক সময় বুলবুল পুষত। মোরগ লাড়ইয়ের মতো বুলবুলির লড়াইও এক সময় জনপ্রিয় খেলা ছিল এই বাংলায়।

এক জোড়া বুলবুলি
ছবি: সুপ্রিয় চাকমা
আরও পড়ুন

পাখি পোষা কি উচিত

এই বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্কে গেলে কোনো পক্ষই জিততে পারবে না সহজে। মানুষ পাখি পোষে নানা আকর্ষণে। কিছু পাখি মানুষের কিছু কথা নকল করতে পারে, যাদেরকে বলা হয় কথা বলা পাখি। এ দলের পাখিদের মধ্যে ময়না ও টিয়াই পড়ে প্রথমে এবং এই দুটি পাখিরই ছানা সংগ্রহ করা হয় নির্মমভাবে মা-বাবার কোল খালি করে ছিনিয়ে আনা হয়। ছানাদের শোকে কিন্তু মা-বাবারা কাঁদে, ছানারাও কাঁদে মা-বাবার শোকে। তিলা ঘুঘু বাচ্চার শোকে দুই তিন দিন পর্যন্ত করুণ স্বরে কাঁদে, খাঁচাবন্দি বাচ্চাদের আশপাশে অস্থির ওড়াউড়ি করেও কাঁদে। অনেক শিশু-কিশোর বাজঈগল পোষে শখের বশে। কিন্তু এটা তো উচিত কাজ নয়। বরং শিশু-কিশোরেরা স্কুলভিত্তিক, পাড়া ভিত্তিক বা এলাকা ভিত্তিক ‘ভালোবাসি পাখি’ (লাভ বার্ড) ক্লাব ‘ভালোবাসি বন্যপ্রাণী’ (লাভ ওয়াইল্ড লাইফ) ক্লাব বা ‘বন্যপ্রাণী রক্ষা ক্লাব’ (ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাব) গঠন করে পাখি পর্যবেক্ষণ করতে পারে। যারা পাখির বাসা নষ্ট করে, পাখির ছানা সংগ্রহ করে নিজে পোষার জন্য বা বিক্রির জন্য, তাদের বুঝিয়ে নিবৃত্ত করতে পারে। এর মাধ্যমে শিশু-কিশোরেরা একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণের অনাবিল আনন্দ যেমন লাভ করতে পারে তেমনি পারে পাখিবন্ধুদের উপকার করতে। পাখিরা হচ্ছে প্রকৃতির উড়ন্ত দুরন্ত সুন্দর। ওরা প্রকৃতির বন্ধু। মানুষের বন্ধু পাখি। তাদের বন্দি করে পোষা উচিত নয়।

 * লেখকের বাংলাদেশের পাখি (৩য় খণ্ড), শিশু একাডেমি (২০০৮) থেকে নেওয়া

আরও পড়ুন