বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য তালিকার অন্যতম প্রধান উপাদান চাল। পোলাও থেকে খিচুড়ি, পান্তা, পিঠা—সবকিছুতেই আছে চালের উপস্থিতি। আমাদের পরিচিত চাল সাদা রঙয়ের। তবে গবেষণা বলছে, সাদা চালের তুলনায় রঙিন চালে পুষ্টিগুণ বেশি। লাল, কালো, বেগুনি কিংবা বাদামি রঙের চাল পুষ্টিগুণে সাদা চালের তুলনায় বহুগুণে এগিয়ে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক এই রঙিন চাল নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এটি দেখতে যেমন চমকপ্রদ, তেমনি পুষ্টিগুণেও অতুলনীয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. ছোলায়মান আলী ফকিরের নেতৃত্বে রঙিন চাল নিয়ে তিন বছর ধরে চলছে এ গবেষণা। লাল ও কালো রঙের চাল নিয়ে ইতিমধ্যে বিশদভাবে গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক মো. আলমগীর হোসেন এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ও সাগরিকা খাতুন।
গবেষণায় দেখা গেছে, কালো চালে জিংক ও আয়রনের পরিমাণ সাদা চালের তুলনায় ২-৩ গুণ বেশি। বিশেষত এশিয়ার মানুষের খাদ্যতালিকায় জিংক ও আয়রনের ঘাটতি একটি সাধারণ সমস্যা। কালো চাল এই সমস্যা সহজেই পূরণ করতে পারে।
গবেষণার ফলাফল সবার কাছে পৌঁছাতে এবং রঙিন চালকে জনপ্রিয় করতে গবেষকদল একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে কালো চাল দিয়ে তৈরি বাহারি খাবারের পসরা সাজানো হয়।
প্রতি ১০০ গ্রাম কালো চালে অ্যান্থোসায়ানিনের পরিমাণ ১ দশমিক ১২০ গ্রাম থেকে ৭ দশমিক ৩৫ গ্রাম। সাদা চালে এটি প্রায় অনুপস্থিত। এছাড়া কালো চালের প্রতি গ্রামে মোট ফিনলের পরিমাণ ৭-১০ মিলিগ্রাম এবং ফ্লাভোনয়েডের পরিমাণ ৫ থেকে ৬ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম। সাদা চালের তুলনায় এই পরিমাণ এক থেকে দেড় গুণ বেশি। অ্যান্থোসায়ানিন, ফিনল ও ফ্লাভোনয়েড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়া এগুলো অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণসম্পন্ন। এগুলো শরীরের অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে।
গবেষণার ফলাফল সবার কাছে পৌঁছাতে এবং রঙিন চালকে জনপ্রিয় করতে গবেষকদল একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে কালো চাল দিয়ে তৈরি বাহারি খাবারের পসরা সাজানো হয়। কালো চালের ময়দা দিয়ে তৈরি ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, তেল পিঠা, কেক, হালুয়া এবং পায়েস যেমন দেখতে আকর্ষণীয় ছিল, তেমনি পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ। কালো চালের খিচুড়ি, চিড়া এবং কালো চাল ও ভূট্টার পাকোড়া ছিল বিশেষ আকর্ষণ।
বিশেষ করে কালো চালের পায়েস সবাইকে মুগ্ধ করেছে। গুড়, দুধ আর কালো চালের সমন্বয়ে তৈরি এই পায়েস যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিকর। প্রদর্শনীতে উপস্থিত দর্শনার্থীরা শুধু খাবারের বাহারি পদই উপভোগ করেননি, বরং রঙিন চালের পুষ্টিগুণ নিয়েও সচেতন হয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নে রঙিন চালের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। গবেষকদের মতে, সঠিক প্রচারণা এবং রান্না করার পদ্ধতি মানুষকে জানানো গেলে রঙিন চাল দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
তবে এত গুণ থাকা সত্ত্বেও কালো চাল এখনো দেশের মানুষের কাছে তেমন জনপ্রিয় হয়নি। গবেষকরা মনে করেন, সাদা চালের প্রতি অভ্যস্ততা এবং কালো রঙের কারণে অনেকে এটি গ্রহণ করতে আগ্রহী হন না। তাই মানুষের পছন্দের দিকে লক্ষ্য রেখে মুখরোচক ও আকর্ষণীয় খাবার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রধান গবেষক।
কালো চালের আরেকটি বিশেষ গুণ উল্লেখ করে গবেষক জানান, ‘এই চাল শুধু পুষ্টিগুণেই অনন্য নয় বরং এটি কৃষকদের জন্যও সম্ভাবনাময় একটি ফসল। এর উচ্চ বাজারমূল্য এবং আন্তর্জাতিক রপ্তানির সুযোগ থাকায় এটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি এবং কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নে রঙিন চালের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। গবেষকদের মতে, সঠিক প্রচারণা এবং রান্না করার পদ্ধতি মানুষকে জানানো গেলে রঙিন চাল দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এই গবেষণার মাধ্যমে গবেষক শুধু নতুন একটি খাদ্য উপাদানকেই জনপ্রিয় করছেন না বরং পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখছেন।