পৃথিবীর আদিমতম ফুল

জীবাশ্মের ভিত্তিতে অঙ্কিত ১৭ কোটি ৪০ লাখ বছরের পুরানো সেই ফুল

পৃথিবীতে উদ্ভিদের জন্ম হয়েছে কবে? আর সেটি কী ছিল? পৃথিবীতে উদ্ভিদ জীবনের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ১০০ কোটি বছর আগে, কয়েক কোষী একধরনের শেওলার মাধ্যমে। সেই শেওলা থেকে কোটি কোটি বছরের অভিযোজনে পাওয়া গেছে আজকের উদ্ভিদজগৎ। এই উদ্ভিদজগতে আবার সব উদ্ভিদ বা গাছে ফুল ফোটে না। যেসব গাছে ফুল ফোটে সেগুলোকে আমরা বলি সপুষ্পক উদ্ভিদ বা ফুল ফোটানোর গাছ। সপুষ্পক উদ্ভিদ পেয়েছি প্রায় ১৪ থেকে ২৫ কোটি বছর আগের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। কবে সেই আদিমতম ফুলটি ফুটেছিল এই পৃথিবীর বুকে, কোটি কোটি বছরের সেই রহস্য কে ভেদ করে সঠিক উত্তর খুঁজে দিতে পারে?

২০১৯ সালে একদল গবেষক খুঁজে পেয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৪০ লাখ বছরের আদিম এক ফুলের জীবাশ্ম। সে যুগে এ পৃথিবীর বুকে ডাইনোসররা দাপিয়ে বেড়াত। পৃথিবীর সেই আদিমতম ফুলকে শনাক্ত করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন Nanjinganthus dendrostyla। এটাকেই এখন বলা হচ্ছে পৃথিবীর আদিমতম ফুল গাছ। এই আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত প্রায় ১৪ কোটি বছর আগের ক্রেটাসিয়াস যুগের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদের জীবাশ্ম ছিল সবচেয়ে পুরোনো ফুল গাছ হিসেবে স্বীকৃত ছিল।

আদিমতম ফুলের জীবাশ্ম

গবেষকেরা ঠিক এখনো নিশ্চিত নন, এর চেয়েও পুরোনো কোনো ফুল পৃথিবীতে আদৌ ছিল কি না। এমনকি জীবাশ্ম বিশ্লেষণের পরও ঠিক বুঝতে পারছেন না কোথায় এর বাস ছিল। চীনের নানঝিং ইনস্টিটিউট অব জিওলজি অ্যান্ড প্যালেন্টোলজির অধ্যাপক ও লেখক কুইয়াং ফু জানিয়েছেন এ কথা। তবে গবেষক দল সেখানে অনেকগুলো ফুলের জীবাশ্ম দেখতে পেয়েছেন। ২০১৮ সালে ফু ও তাঁর সহযোগী গবেষকেরা ১৯৮টি ফুলের ২৬৪টি জীবাশ্ম নমুনা পরীক্ষা করেন। তাঁরা চীনের দক্ষিণ জিয়াংশানে এই জীবাশ্ম-পাথরখণ্ড খুঁজে পান।

চীনের নানঝিং জুরাসিক আমলের পাথরে গঠিত একটি অঞ্চল। তাই সেখানে পাওয়া জীবাশ্মটি জুরাসিক কালের বলে তাদের বদ্ধমূল ধারণা। অবশ্য শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে তাঁরা এ সিদ্ধান্তে আসেননি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ও কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে সেই জীবাশ্মের বয়স নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছেন।

২০১৫ সালে গবেষণার ফল প্রকাশিত হলেও একদল গবেষক প্রায় ছয় বছর ধরে সেই গবেষণাকার্য চালিয়েছিলেন। সেই গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস-সাউথের গবেষক হার্ভে সকেট। তিনি বলেছিলেন, ‘আসলে আমাদের সেই আবিষ্কারের রোমাঞ্চটা ছিল অনেকটা বিগব্যাংয়ের মতো। ফুলের শুরু হলো কী করে, তা আবিষ্কার করাই ছিল মূল লক্ষ্য। পৃথিবীর প্রথম সেই ফুলটা ঠিক কত বড় ছিল, তা হয়তো বলা যাবে না, তবে ধারণা করা যেতে পারে তার আকার হয়তো এক সেন্টিমিটারের বেশি ছিল না।’

সত্যিই বিস্ময়কর ছিল পৃথিবীর সেই আদিমতম ফুলের আবিষ্কার। সেই আদিম ফুল থেকে সারা পৃথিবীতে এখন ছড়িয়ে রয়েছে সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রায় তিন লাখ প্রজাতি। নতুন এই ফুলই যদি আদিমতম ফুল হয়, তাহলে ২০১৫ সালের আবিষ্কৃত Montsechia vidalii ফুলটি তার আদিমত্বের গৌরব হারিয়ে ফেলবে, সে কথা এখন নিশ্চিত।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত