মশা-ম্যাগনেট রহস্য!

ত্বক থেকে নির্গত ফ্যাটি এসিডগুলো মিলে এমন এক ধরনের সুগন্ধি তৈরি করে, যার অস্তিত্ব টের পেলে মশাদের আর মাথা ঠিক থাকে না।

হয়ত অনেকেই একজায়গায় বসে আছেন, অথচ মশা আপনাকে কামড়েই মজাটা বেশি নিচ্ছে। চারপাশ থেকে মশা এসে শুধু আপনাকেই খুঁজে পায়। কেন আপনিই? আপনার সঙ্গেই কেন?

স্ত্রী মশা যেকোনো মানুষকে শিকার বানাতে পারে। কিন্তু থাকে না এমন যে আমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে অন্যদের চেয়ে মশা একটু বেশিই খুঁজে পায়? প্রশ্ন হলো, কেন? পেছনের বিজ্ঞানটা কী? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আমাদের ত্বকে।

স্ত্রী মশা থেকে লুকানো প্রায় অসম্ভব—শুধু আমাদের নিঃশ্বাসের কার্বন নিঃসরণ, শরীরের তাপ আর গন্ধ ট্র্যাক করেই মানব প্রজাতির যেকোনো সদস্যকে ধরাশায়ী করতে পারে এ মশা। তবে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ একেবারে ‘মশা-চুম্বক’, যারা সবার জন্য বরাদ্দ মশার কামড়ের ন্যায্য অংশের খানিকটা বেশিই পায়।

 মশাদের খাদ্য হবার পেছনে কী দায়ী, এ বিষয়ে জনপ্রিয় হাইপোথিসিসগুলো কয়েকটি প্রভাবকের কথা বলে। তারা হলো—রক্তের ধরন, রক্তে শর্করার মাত্রা, রসুন অথবা কলা খাওয়ার অভ্যাস, কিংবা হতে পারে শুধু নারী ও শিশু হবার কারণে হয়ত। তবে মশার সুস্বাদু খাদ্য হবার পেছনে দায়ী এসব জনপ্রিয় প্রভাবক নিয়ে হাইপোথিসিসগুলোর পেছনে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই, এমনটাই দাবি রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি অব নিউরোজেনেটিকস অ্যান্ড বিহেভিয়ারের প্রধান লেসলি ভোশালের।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
একটা প্লেক্সিগ্লাস চেম্বারকে দুটি টিউবে ভাগ করে এক বিশেষ ধরনের দ্বি-প্রান্তিক অলফ্যাক্টোমিটার (মানদণ্ড) আবিষ্কার করেন ওডিবাল্ডিয়া।

এই দাবির পেছনের যুক্তি খুঁজতেই ভোশাল ও তাঁর গবেষণাগারের সাবেক পোস্টডক সহকর্মী মারিয়া এলেনা ডিওবাল্ডিয়া মিলে কাজে নেমে পড়লেন। মশাদের খাবার হওয়ার পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাইপোথিসিস—‘ত্বকের মাইক্রোবায়োটার সঙ্গে সংযুক্ত স্বতন্ত্র নানারকম গন্ধের ভিন্নতা’ আবারও পরীক্ষা করে সম্পূর্ণ এক ব্যাখ্যা বিনির্মাণের চেষ্টা চালালেন।

তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ত্বক থেকে নির্গত ফ্যাটি এসিডগুলো মিলে এমন এক ধরনের সুগন্ধি তৈরি করে, যার অস্তিত্ব টের পেলে মশাদের আর মাথা ঠিক থাকে না। আলাদা সেল করে করে গবেষণার ফলাফল তাঁরা প্রকাশও করেছেন। এ নিয়ে দ্য রকফেলার ইউনিভার্সিটির রবিন চেমার্স নিউস্টেইন প্রফেসর এবং হাওয়ার্ড হিউজ মেডিকেল ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ভোশাল বলছেন, ‘ত্বকে এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোর প্রচুর পরিমাণে উপস্থিতি এবং আপনার মশা-চুম্বক হওয়ার মধ্যে দারুণ শক্তিশালী এক সম্পর্ক রয়েছে।’

লেসলি ভোশালের বক্তব্য তো জানা গেল, এবারে তাঁর গবেষণা নিয়ে বলি। তিন বছরের গবেষণায় আটজন অংশগ্রহণকারীকে দিনে ছয় ঘন্টা বাহুতে নাইলন স্টকিংস পরতে বলা হয়েছিল। বেশ কয়েকদিন তাঁদেরক পরিয়ে রাখা হয়েছিল ওরকম নাইলন স্টকিংস। পরের কয়েক বছর ধরে গবেষকরা রাউন্ড-রবিন স্টাইল ‘টুর্নামেন্ট’-এর মাধ্যমে সম্ভাব্য নাইলনের সবগুলো জোড়াকে একটা আরেকটার বিরুদ্ধে রেখে পরীক্ষা করেছেন।

একটা প্লেক্সিগ্লাস চেম্বারকে দুটি টিউবে ভাগ করে এক বিশেষ ধরনের দ্বি-প্রান্তিক অলফ্যাক্টোমিটার (মানদণ্ড) আবিষ্কার করেন ওডিবাল্ডিয়া। কোনো বাক্সে রাখলে পরে ওই মিটারের দুই প্রান্ত মিলে একটা স্টকিং রাখতে পারে। জিকা, ডেঙ্গু, হলুদ জ্বর এবং চিকুনগুনিয়ার মতো ভয়াবহ সব রোগের প্রাথমিক বাহক প্রজাতি এডিস এজিপ্টি মশাকে তাঁরা প্রধান চেম্বারে রেখে বেশ কিছুদিন খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা দেখতে পান, মশাগুলো নাইলন টিউবের এক পাশ থেকে অন্য পাশে উড়ে বেড়ায় এবং ওপর থেকে নিচের দিকে যাতায়াত বেশ পছন্দ এদের। এডিস ইজিপ্টির জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় লক্ষ্য ছিল গবেষণার স্যাম্পল সাবজেক্ট ৩৩। আর সবচেয়ে কম আকর্ষণীয় ছিল স্যাম্পল সাবজেক্ট ১৯।

আরও পড়ুন

অংশ নেওয়া দলের সবার নাইলনই এক করে নেওয়া হয়েছিল। এরপর যা দেখা গেল, তা রীতিমতো ভয়ানক। কে কোন বাহুতে নাইলন পরেছিলেন, কেউ তো জানে না। তবে যাঁদের নাইলনে ওই স্যাম্পল সাবজেক্ট ৩৩ ছিল, মশারাও ঝাঁকে ঝাঁকে তাঁদের নাইলনের দিকেই হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।  

সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপাদান এবং সবচেয়ে কম আকর্ষণীয় উপাদান ও সেসব উপাদানের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে গিয়ে তাঁরা শনাক্ত করেন ৫০টি আণবিক যৌগ (রাসায়নিক বিশ্লেষণ কৌশল ব্যবহার করে)। ওই আণবিক যৌগগুলো বেশি কামড় খাওয়া মানুষদের সেবামে অনেক বেশি পরিমাণে উপস্থিত ছিল। কথা হলো, সেবাম কী? সেবাম লিপিড-চর্বি অণুর ভারসাম্য ঠিক রাখে, ত্বকের আর্দ্রতাকে আটকে দেয়। অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ ও খারাপ প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করে। এ ছাড়াও ত্বকে ভিটামিন-ই, চর্বি ও দ্রবণীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সরবরাহ করে সেবাম।

ঘটনা হলো, বেশি মশার কামড় খাওয়া লোকজনের শরীরে অন্যান্যদের তুলনায় বেশি মাত্রায় কার্বক্সিলিক এসিড তৈরি হয়। এটি আমাদের সেবামের মধ্যেই থাকে। আর আমরা জানি, প্রত্যেক মানুষের দেহেই রয়েছে স্বতন্ত্র গন্ধ। আমাদের দেহে এই স্বতন্ত্র গন্ধ তৈরিতে কার্বক্সিলিক এসিডের সুনিপুণ ব্যবহার করে ত্বকের ব্যকটেরিয়া।

এখন কথা হলো, এ গবেষণার ভিত্তি কী? কীভাবে এতটা নিশ্চিত হওয়া গেল? ভোশালির গবেষণা দল বলছে, বছরের পর বছর ধরে তাঁরা কিছু মানুষ এবং তাঁদের শরীরের উপাদান আগেকার দাবির ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণে রাখেন। তাঁরা দেখতে পান, যাঁরা মশা-ম্যাগনেট, তাঁদের আসলে কোনো পরিবর্তন নেই। যখন থেকে এরা মশা-ম্যাগনেট, তখন থেকে আজীবনের জন্যই তাঁরা মশা-ম্যাগনেট। এমনও হয়েছে যে, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মানুষদের শরীরের গন্ধে পরিবর্তন এসেছে, উপাদানেও। এমনকি পরিবর্তন এসেছে আচরণেও। কিন্তু কখনো বদলায়নি কার্বক্সিলিক এসিডের উপস্থিতি। সবসময় তাঁদের দেহে উৎপন্ন হয়েছে এ উপাদান। যেটি মশাদের জন্য সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক।

আরও পড়ুন
স্ত্রী মশা বেঁচে থাকে এবং প্রজনন ঘটায়। কিন্তু রক্ত ছাড়া এর কোনোটাই সম্ভব নয়!
আরও পড়ুন

মানবদেহে সাধারণত দুই ধরনের গন্ধ তৈরি হয়। আর মশারাও এই গন্ধ শনাক্ত করে দুধরনের আলাদা আলাদা রিসেপ্টরের সাহায্যে—অরকো এবং আই আর রিসেপ্টর। গবেষক দলের একটা চেষ্টা ছিল কোনোভাবে মশাগুলোকে মানুষের গন্ধে আকৃষ্ট হওয়া থেকে বিরত রাখা কিংবা মানবদেহ শনাক্তকরণের ক্ষমতাটুকু নষ্ট করে দেওয়া। ফলে তাঁরা এক ধরনের মিউট্যান্ট তৈরি করলেন, যে মিউট্যান্টে একটি অথবা দুটি রিসিপ্টরই ছিল অনুপস্থিত। কিন্তু এর আপাত ফলাফল কী পাওয়া গেল? ফলাফল হচ্ছে, অরকো মিউট্যান্ট ঠিকই ধরে ফেলত কারা আসলে ‘মসকুইটো ম্যাগনেট’ আর কাদেরকে অতটা না কামড়ালেও চলবে। তবে আই আর রিসিপ্টরের মিউট্যান্টগুলো মানুষের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেও কিন্তু আমাদেরকে খুঁজে বের করার ক্ষমতা ঠিকই রাখে এসব মিউট্যান্ট।

প্রসঙ্গত বলি, সেল জার্নালে প্রকাশিত ভোশালির আরও একটা গবেষণা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। এ গবেষণা থেকে জানা গেছে, এডিস ইজিপ্টি মশার ঘ্রাণতন্ত্র অত্যন্ত সুগঠিত এবং জটিল। এত উন্নত ঘ্রাণতন্ত্র না হলেও হয়তো চলতো এ মশার।

বাস্তবতা হলো, স্ত্রী মশা বেঁচে থাকে এবং প্রজনন ঘটায়। কিন্তু রক্ত ছাড়া এর কোনোটাই সম্ভব নয়! আর রক্তের অব্যাহত সরবরাহ সুনিশ্চিত ও ঝঞ্ঝাটহীন রাখতে এ মশার বিকল্প পরিকল্পনা থাকেই! ওই সাবজেক্ট ৩৩—কার্বক্সিলিক এসিড থেকে শুরু করে সবচেয়ে কম আকর্ষণীয় ১৯ এর খোঁজে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এ মশা। ত্বকের রাসায়নিক পার্থক্য ধরে ধরে শিকারে পরিণত করে লক্ষ্যবস্তুকে।

শেষ করার আগে একটা মজার প্রশ্ন নিয়ে কথা বলা যাক। মশা কামড়াবে না আর কোনো মানুষকে কখনো… সম্ভব কি? বিশ্লেষকদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে মশার সুগঠিত উন্নত ও জটিল ধরনের শক্তিশালী ঘ্রাণতন্ত্র এবং সেন্ট ট্র্যাকারের কার্যকারিতা বিবেচনায়, মশা মানুষকে কামড়াবে না কিংবা মানুষই মশার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে না, এমন ভবিষ্যৎ কল্পনা করা বেশ কঠিনই বটে। এমন হয়তো কল্পনায় সম্ভব হতে পারে যে, আমরা আমাদের ত্বকের মাইক্রোবায়োমকেই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছি মশার কামড় থেকে বাঁচতে। কিংবা হতে পারে, মানবদেহের সেবাম তথা ত্বকে আমরা সবচেয়ে কম আকর্ষণীয় উপাদানের আধিক্য নিশ্চিত করে পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে পারি। তবে এমন পরীক্ষা পরিচালনা শুধু কঠিনই নয়, অনেকটা অসম্ভব বৈকি!

তবে এমন আশা কিন্তু করাই যায় যে, গবেষকরা মশার অন্যান্য প্রজাতিগুলোর সার্বজনীন প্রভাবও পরীক্ষা করে দেখবেন। এতে করে ভবিষ্যতে হয়তো মশা-চুম্বকরা খানিকটা বাঁচলেও বাঁচতে পারেন মশার হাত থেকে। কে জানে!

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র:

১. রকফেলার ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি ইস্যু ১৪৫২৩

২. Maria Elena De Obaldia, Takeshi Morita, Laura C. Dedmon, Daniel J. Boehmler, Caroline S. Jiang, Emely V. Zeledon, Justin R. Cross, Leslie B. Vosshall. Differential mosquito attraction to humans is associated with skin-derived carboxylic acid levels. Cell, 2022; 185 (22): 4099 DOI: 10.1016/j.cell.2022.09.034