যেভাবে গ্রেটা থুনবার্গ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিল জলবায়ু আন্দোলন

২০ আগস্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক বিশেষ দিন। ২০১৮ সালের এই দিনে জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ জলবায়ুর জন্য ধর্মঘট শুরু করে। কীভাবে গ্রেটা থুনবার্গের জলবায়ু আন্দোলন শুরু হলো, তা নিয়ে এই লেখা।

গ্রেটা থুনবার্গের জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘটছবি: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সুইডেনের নির্বাচনের প্রায় তিন সপ্তাহ আগের ঘটনা। সুইডেনের সংসদে বসে রাজনীতিবীদেরা জলবায়ু নিয়ে কথা বলেছেন। শুধু সুইডেনে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন সংসদ ভবনে হাজার হাজার রাজনীতিবিদ জলবায়ু নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেগুলোর কোনোটিই কোনো ফল দেয়নি। বিষয়টি খেয়াল করে সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ। সে সময় ওর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। গ্রেটা ভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তার নিজের কিছু একটা করতে হবে, যার মাধ্যমে পরিবর্তন আসবে। বিশেষ করে শিশুদের কথা সবাইকে জানাতে হবে। রাজনীতিবিদদের এই কথাটা মনে করিয়ে দিতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি জরুরি ব্যাপার। অন্য সবকিছু অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন থেমে থাকছে না বা থাকবে না।

তাই আজকের এই দিনে, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট গ্রেটা থুনবার্গ বেণী বেঁধে, একটি চেক শার্ট ও একটি নীল কোট পরে বাসা থেকে বের হয়। হাতে একটি কাঠের প্ল্যাকার্ড। যেটাতে হাতে লেখা, ‘SKOLSTREJK FÖR KLIMATET’। ‘জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট’। এ ছাড়া সে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে লিফলেট বানিয়েছিল সবাইকে দেওয়ার জন্য। ভাবনাটা ছিল, এই বিষয়ে সবার জানা উচিত। জলবায়ুর মতো সমস্যা সমাধানে সরকারি নীতি পরিবর্তন করতে হয়। পরিবেশ রক্ষার জন্য নতুন আইন করা প্রয়োজন। সংসদে বসা মানুষই পারেন নতুন আইন করতে। সে কারণেই গ্রেটা সেদিন সকালে সুইডিশ পার্লামেন্ট ভবনের সামনে গিয়েছিল।

শহরের নানা জায়গায় ১৫ বছর বয়সী গ্রেটা সম্পর্কে লোকজন কথা বলতে শুরু করে। গ্রেটাকে সমর্থন করা কিছু সাংবাদিক, সঙ্গে কিছু কৌতূহলী মানুষ গ্রেটার সঙ্গে যোগ দেয়। বেশ কয়েকজন মা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আসেন।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধের লড়াইয়ে কিশোরদের পথ দেখান গ্রেটা থুনবার্গ
ছবি: ভক্স ইমেজ

গ্রেটার বয়সী সব সুইডিশ শিশুদের মতো করে গ্রেটার সেদিন স্কুলে যাওয়ার কথা। কারণ সুইডেনে ছুটি আগস্টে শেষ হয়ে আবার ক্লাস শুরু হয়ে যায়। তা না করে গ্রেটা সাইকেলে চেপে শহরের কেন্দ্রে সংসদ ভবনের সামনে হাজির হয়। স্কুল কামাই করে বসে থাকে। সেই দিন—২০ আগস্ট ২০১৮, সোমবার গ্রেটা স্কুল ধর্মঘট শুরু করে। 

ধর্মঘটের প্রথম দিন একা একা বসে থাকল সে। পরদিন কিছু লোক যোগ দিল। এই দ্বিতীয় দিনে অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটে। কেবল গ্রেটার দিকে তাকিয়ে চলে যাওয়ার পরিবর্তে, সে ওখানে কী করছে তা ভাবার পরিবর্তে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কয়েকজন লোক গ্রেটার সঙ্গে যোগ দেয়। দ্বিতীয় দিনেই গ্রেটা আর একা ছিল না। সঙ্গে ছিল অন্যান্যরাও।

তৃতীয় দিন নাগাদ, তার সঙ্গে মাটিতে বসেছিল ছোট একটি দল। বেশির ভাগই অল্পবয়সী, তবে সেখানে একজন মা ছিলেন, যার সঙ্গে একটি স্ট্রলারে একটি ছোট ছেলে ছিল। ছিল ধূসর চুলের একজন মহিলা এবং একজন ছাত্র, যিনি পড়ার জন্য একটি বই নিয়ে এসেছিলেন। বিক্ষোভকারীরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেন। সময়টা সুইডিশ গ্রীষ্মের শেষ কয়েকদিন। তখন রোদ ছিল।

শহরের নানা জায়গায় ১৫ বছর বয়সী গ্রেটা সম্পর্কে লোকজন কথা বলতে শুরু করে। গ্রেটাকে সমর্থন করা কিছু সাংবাদিক, সঙ্গে কিছু কৌতূহলী মানুষ গ্রেটার সঙ্গে যোগ দেয়। বেশ কয়েকজন মা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে আসেন। আসেন কয়েকজন দাদা-দাদি। প্রচুর তরণদের দেখা গেল পার্লামেন্ট ভবনের সামনে। কেউ আবার গ্রেটার খাওয়াদাওয়ার জন্য কিছু নিয়ে এল।

নয় দিন পরে, বিক্ষোভ তখনও চলছে; বিক্ষোভকারীরা শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্র গামলা স্টান দ্বীপের একটি মনোরম স্কয়ার—মাইন্টোরগেটে সরে যেতে হলো। এটি সংসদ থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তাই সরে গেল গ্রেটা। কারণ আইন ভাঙতে না, প্রতিবাদ করতে চেয়েছে সে।

সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পাশাপাশি ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সামনে বক্তৃতা দিয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের একটি জলবায়ু অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল গ্রেটা।

এদিকে, স্টকহোমে কী ঘটছে, তা নিয়ে সারা বিশ্বের লোক আরও বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ল। একটি বড় ইংরেজি সংবাদপত্র গ্রেটার গল্প বলার সিদ্ধান্ত নিল। বিখ্যাত কাগজ দ্য গার্ডিয়ান ‘skolstrejk för klimatet’ সম্পর্কে একটি অনলাইন নিবন্ধ প্রকাশ করে। শিরোনামটিতে লেখা ছিল, ‘সুইডিশ ১৫ বছর বয়সী মেয়ে জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়তে ক্লাস কামাই করছে।’

ধর্মঘটের ষষ্ঠ দিনে গ্রেটা সবাইকে পরামর্শ দিয়েছিল, তাদের সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে প্রতিবাদ সম্পর্কে কথা বলা উচিত, ছবি এবং তথ্য শেয়ার করা উচিত। সে বলেছিল, এভাবে, এমনকি যারা প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেনি, তারাও একটি মেসেজ, লাইক বা শেয়ার দিয়ে নিজেদের সমর্থন দেখাতে পারবে। 

গ্রেটা বলে, ‘আপনার ফাঁকা বুলি দিয়ে আপনি আমার স্বপ্ন ও শৈশব চুরি করেছেন। আমরা একটি মহাবিলুপ্তির শুরুতে আছি।
ছবি: রয়টার্স

কী ঘটছে, সে খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গ্রেটা এ ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিদিন সে ইনস্টাগ্রামে ডায়েরি হিসেবে স্কুলের ধর্মঘটের ছবি তুলত। বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী এবং পরিচিতজনেরা জানতে চাইল: আমরাও আসতে পারি? আমরা তোমার সঙ্গে কখন দেখা করব? গ্রেটা সবাইকে স্বাগত জানাল।

অনেক লোক সংবাদপত্রে জলবায়ু ধর্মঘট নিয়ে প্রতিবেদন পড়ে। সবাই বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নেয়। সুইডেনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, অন্যান্য বড় ও ছোট শহরে বসবাসকারী সুইডিশরা গ্রেটার ডাক শুনে একই ধরনের প্রতিবাদের আয়োজন করে।

সুইডেনের দক্ষিণের একটি ছোট শহর লিংকোপিংয়ে। একদল লোক গ্রেটাকে সমর্থন করতে চায়। তাই তারা শহরের কেন্দ্রে একটি ফোয়ারার পাশে জড়ো হয়। গ্রেটা যেমন প্রতিবাদের সময় হাতে একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছিল, একইভাবে তারাও প্ল্যাকার্ড নিয়ে আসে। একটি প্ল্যাকার্ডে ছিল সাইকেলের একটি ছবি। ছবিটি এসেছে রোম থেকে। সাইকেলের প্যাডেলের জায়গায় লেখা ছিল: ধন্যবাদ গ্রেটা! আমরাও তোমার পাশে আছি!

আগস্টের ২০ তারিখ সকালে যখন গ্রেটা প্রথমবার বাড়ি ছেড়ে সংসদের দিকে রওনা হয়, তখন তার মনে স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল। সে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘট করবে। এদিন ছিল নির্বাচনের দিন। যখন সুইডিশ নাগরিকরা তাদের প্রতিনিধিদের ভোট দেবেন। এর মাধ্যমে নির্বাচিত নারী-পুরুষ বসবেন সংসদে।

যেহেতু অনেক লোক তাকে সমর্থন করছে, তাই তাদের যতটা সম্ভব জলবায়ু ধর্মঘট সম্পর্কে জানানো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে গ্রেটার। বিক্ষোভের শেষ দিনে সবাইকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করে সে। সবাই মিলে আওয়াজ তোলে:

২০১৮ সালের ২০ আগস্ট গ্রেটা থুনবার্গ বেণী বেঁধে, একটি চেক শার্ট ও একটি নীল কোট পরে বাসা থেকে বের হয়। হাতে একটি কাঠের প্ল্যাকার্ড। যেটাতে হাতে লেখা, ‘SKOLSTREJK FÖR KLIMATET’। ‘জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট’।

‘জলবায়ু ধর্মঘট

কোথায়?

মিন্টোরিয়েটে

কখন?

শুক্রবার ৭ সেপ্টেম্বর! সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা

কিছু খাবার আর পানি

আর বসার জন্য একটি মাদুর এনো।’

এরপরের গল্প সবার জানা। আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে গ্রেটার ধর্মঘট। নির্বাচনের পর আবার সে স্কুলে ফিরে এল। কিন্তু ধর্মঘটের জন্য শুক্রবারের ক্লাস বাদ দিয়ে দিল। এই দিনগুলোকেই বলা হয় ‘ভবিষ্যতের জন্য শুক্রবার’ (ফ্রাইডেস ফর ফিউচার)। গ্রেটার ধর্মঘট বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের জন্য তাদের নিজস্ব শুক্রবারে ধর্মঘটে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করে। বেলজিয়াম, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডসের মতো দেশে ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলন। বাংলাদেশেও এক শুক্রবারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ধর্মঘট পালিত হয়েছে। 

হাউ ডেয়ার ইউ! (কত দুঃসাহস আপনার!)’। সেই মাসে লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভকারী ১৬৩টিরও বেশি দেশে জলবায়ু ধর্মঘট-মিছিল করে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের একটি জলবায়ু অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল গ্রেটা। যে অনুষ্ঠানে সে একটি দূষণমুক্ত ইয়টে আটলান্টিক পাড়ি দেয়
ছবি: সিবিএস নিউজ

গ্রেটা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে কথা বলার জন্য অসংখ্য আমন্ত্রণ পেয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পাশাপাশি ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সামনে বক্তৃতা দিয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের একটি জলবায়ু অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল গ্রেটা। যে অনুষ্ঠানে সে একটি দূষণমুক্ত ইয়টে ভ্রমণ করে যোগ দেয়। এই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় একটি আবেগপূর্ণ মন্তব্য ভাইরাল হয়। গ্রেটা বলে, ‘আপনার ফাঁকা বুলি দিয়ে আপনি আমার স্বপ্ন ও শৈশব চুরি করেছেন। আমরা একটি মহাবিলুপ্তির শুরুতে আছি। আপনি যেসব কথা বলতে পারেন, তা হলো টাকা আর সারাজীবনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির রূপকথার গল্প। হাউ ডেয়ার ইউ! (কত দুঃসাহস আপনার!)’। সেই মাসে লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভকারী ১৬৩টিরও বেশি দেশে জলবায়ু ধর্মঘট-মিছিল করে। 

গ্রেটা থুনবার্গকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতা এবং আচরণ পরিবর্তন করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—অনেকের মধ্যেই এ ধর্মঘট বা আন্দোলনের মাধ্যমে সচেতনতা এসেছে। বাংলাদেশেও আলোচনা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। গতকাল পর্যন্তও যদি আমরা সচেতন না থেকে থাকি, তবে সেটা আজই শুরু করতে হবে।

পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে। এখনই।

সূত্র: সহজ ভাষায় জলবায়ু পরিবর্তন : বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে যা জানা দরকার বই থেকে

আরও পড়ুন