প্রাণিজগৎ
বাংলাদেশে দেখা মেলে যেসব চিলের
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
আগের অংশ
চিল জাতীয় পাখি বাংলাদেশে আছে ৩ রকম। ১. শঙ্খচিল: ইংরেজি নাম Brahmiony kite, বৈজ্ঞানিক নাম Haliastur indus। ২. ভুবনচিল: ইংরেজি নাম Black kite, বৈজ্ঞানিক নাম Milvus migrans govinda, এটা আমাদের আবাসিক পাখি। অন্য একটি ভুবনচিলের বৈজ্ঞানিক নাম M. Migram lin-eatus, এরা পরিযায়ী। ৩. সাদা চিল: ইংরেজি নাম Black-shouldered kite, বৈজ্ঞানিক নাম Elanus caeruleus। ধানক্ষেতের আশেপাশে ইঁদুর ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে, তাই এদেরকে ধানচিলও বলা হয়। লোকালয় থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে।
১. শঙ্খচিল (৪৮ সেন্টিমিটার): বুক, পেটের কিছু অংশ ও গলাসহ কপাল সাদা। ওই সাদার ওপরে খাড়া খাড়া টান। পিঠও সাদা, সেখানে খাড়া দাগ অস্পষ্ট। ডানা বন্ধ অবস্থায় পিঠের রং ময়লাটে লাল, পেটের নিচের অংশের রংও সেরকম। ডানার প্রান্ত হালকা কালো।
লেজের আগাটা গোলাকার ধরনের। অল্পবয়সী কিশোর-কিশোরী শঙ্খচিলের পিঠ থাকে খয়েরি, ডানাও তাই। বুকের সাদাটাও থাকে মলিন।
ছোট মাছ, ছোট সাপ, হাঁস-মুরগির ছানা প্রিয় খাদ্য। কাঁকড়াও খায়। কণ্ঠস্বর হচ্ছে ‘ট্যাঁ ট্যাঁ, টিঁউ...।’
দুজনে মিলে বাসার জায়গা নির্বাচনে লাগায় ২-৭ দিন। তারপর দুজনে মিলেই শুকনো ডালপালা দিয়ে গাছের ডালে বেশ বড়সড় বাসা করে ৩-৫ দিনে। ডিম পাড়ে দুটি, সাদাটে রং। দুজনে পালা করে ডিমে তা দেয়। ২৬-২৮ দিনে ডিম ফোটে। দুজনেই বাচ্চাদের খাওয়ায়। বাচ্চারা উড়তে পারে ২৮-৩২ দিনে।
ভুবনচিল গাছের চেয়ে বেশি বাসা করে টাওয়ার, পানির ট্যাংকির তলায় বা ওপরে। বড় বড় শহরে খুঁজলে ডিশ-অ্যান্টেনার ভেতরেও বাসা পাওয়া যাবে। এরা বছরের পর বছর একই জায়গায় বাসা করতে পছন্দ করে।
২. ভুবনচিল (আবাসিক, ৬১ সেন্টিমিটার): লেজ ইলিশ মাছের লেজের মতো। ওই লেজ ওদের ওড়ার সময় দারুণ সহায়তা করে। নৌকার হালের মতো লেজ ব্যবহার করে ওরা ঝটপট দিকবদল যেমন করতে পারে, তেমনি পারে বাতাসের প্রতিকূলে উড়তে। দ্রুত ওপরে উঠে যেতে পারে, নামতেও পারে নিচে।
ভুবনচিল এক নজরে খয়েরি রঙের পাখি। ডানার ওপরে হালকা বাদামি টান ও ছোপ। দূর থেকে লালচে-খয়েরি মনে হয়। ঠোঁট কালচে। চোখের মণি লালচে। দলে থাকতে পছন্দ করে। বাঁকানো ঠোঁট ছুরির মতো ধারাল।
পরিযায়ী ভুবনচিলের (৬৮ সেন্টিমিটার) লেজটা ইলিশ মাছের লেজের মতো নয়। এদের বুক-পেটে হালকা খাড়া খাড়া দাগ। এটি আমাদের স্থানীয়টার চেয়ে আকারে কিছুটা বড়। একটানা উড়তেও পারে অনেকক্ষণ।
ভুবনচিল শীতকালেই বাসা করে বেশি, মাঝে-মধ্যে গরমকালেও। শঙ্খচিল বাসা করে শরতে বেশি, শীতে কম। গরমকালেও বাসা করতে দেখা যায়।
ভুবনচিল গাছের চেয়ে বেশি বাসা করে টাওয়ার, পানির ট্যাংকির তলায় বা ওপরে। বড় বড় শহরে খুঁজলে ডিশ-অ্যান্টেনার ভেতরেও বাসা পাওয়া যাবে। এরা বছরের পর বছর একই জায়গায় বাসা করতে পছন্দ করে। দুজনে মিলে জায়গা নির্বাচন করে ২-৪ দিনে। বাসা বানায় প্রায়ই গাছের কাঁচা সরু ডাল দিয়ে। গাছের কাঁচা ডাল পায়ে ধরে যখন আকাশে ঘুরে ঘুরে ওড়ে তখন মনে হয় ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ঢাকার আকাশে এটা দেখা যায়, অন্যান্য শহরেও। ঢাকার মতিঝিলসহ বড় বড় ভবনগুলোর শীততাপ নিয়ন্ত্রণ বক্সের ওপরে বা আড়ালেও বাসা করে। ডিম প্রায়শ ৩টি। ২টি ও ৪টির সংখ্যা কম। দুজনে পালা করে তা দেয়। ডিম ফোটে ২৯-৩৩ দিনে। বাচ্চারা উড়তে পারে ৩০-৩৬ দিনে। ডিম পাড়ার পর থেকে বাচ্চাদের উড়তে শেখা পর্যন্ত ভুবনচিলদের (বিশেষ করে বড় বড় শহরে) স্বস্তি থাকে না। কাকেরা দলবেঁধে বাসার পাশে বসে, উত্যক্ত করে, জ্বালায়। ডিম-বাচ্চা নষ্ট করতে চায়। একটি পাখিকে তাই ডিম-বাচ্চার সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতে হয়।
ভুবনচিলের প্রিয় খাদ্য মরা-ইঁদুর, মরা-মাছ, কাকের তুলতুলে বাচ্চা। বাসি-পচা খেতে ভালোবাসে। শহরের ডাস্টবিন, ময়লার ভাগাড় থেকে খাদ্যবস্তু তুলে খায়। কসাইখানার পরিত্যক্ত হাড়-মাংস, নাড়িভুঁড়ি খুব পছন্দ। শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ওরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শঙ্খচিলের মতো এরাও বাচ্চাদের খাদ্য খাওয়ায় ঠোঁটে কেটে টুকরো টুকরো করে। ভুবনচিলের কন্ঠস্বর হচ্ছে ‘চিরি চিরি চিরি’।
প্রসঙ্গত, এখানে একটি তথ্য দিচ্ছি। প্রবল ঝড়-বৃষ্টি হলে কেবল উড়তে শেখা আনাড়ি ভুবনচিলের ছানারা মারা পড়ে। ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় ২০০ বাচ্চা আহত-নিহত হয়। পাখিপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা আহত বহু পাখিকে পরম মমতায় চিকিৎসা ও সেবাযত্ন করে সুস্থ করে উড়িয়ে দেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপাশা মুনমুন নামে এক মেধাবী ছাত্রী একটি আহত ভুবনচিলকে পরম মমতায় বাসায় নিয়ে সেবাযত্ন করেন ২০০৮ সালেই। ওটাও ঝড়ে আহত হয়েছিল। তিনি একটি আহত ঘুঘুকেও বাঁচিয়েছিলেন।
ভুবনচিলের মতো এরা বাসা বাঁধার সময় একই জায়গায় ফিরে আসে। পুরনো বাসাকে আবার নতুন করে সাজায়। এরা বাসা বেশি করে হেমন্তকালে। প্রায় সময় ডিম ৪টা, দৈবাৎ ২ ও ৩টা দেয়।
৩. ধানচিল/সাদাচিল (৩৫ সেন্টিমিটার): বুক-পেট সাদাটে। চোখের ওপরে যেন চওড়া কাজলের টান। বুজানো অবস্থায় ডানার ওপরিভাগ বাদামি ছাইরঙা। চোখের মণি লালচে। ঠোঁটের ওপরটা হলদেটে, নিচটা কালচে। ডানার উপরিভাগে, ঘাড়ের দু পাশটাতে চওড়া কালো টান। তাইতো এদেরকে ‘কালো ডানার চিল’ বলা হয়।
এদের প্রিয় খাদ্য ধানক্ষেতের ইঁদুর। কীটপতঙ্গও খায়। খায় ছোট ছোট সাপ ও ব্যাঙ। সুযোগ পেলে পাখির বাচ্চা, তক্ষক, কাকলাস, ইঁদুর শিকারের জন্য এরা শূন্যে উড়ে হোভারিং করে। দেখতে সুন্দর লাগে।
ভুবনচিলের মতো এরা বাসা বাঁধার সময় একই জায়গায় ফিরে আসে। পুরনো বাসাকে আবার নতুন করে সাজায়। এরা বাসা বেশি করে হেমন্তকালে। প্রায় সময় ডিম ৪টা, দৈবাৎ ২ ও ৩টা দেয়। দুজনে পালা করে ডিমে তা দেয়। ২৪-২৮ দিনে ডিম ফোটে। বাচ্চারা উড়তে পারে ২৮-৩০ দিনে।