জানা-অজানা
শীতল রক্তের প্রাণী মানে কী
আমরা জানি, মানুষ উষ্ণ রক্তের প্রাণী। সরীসৃপ শীতল রক্তের প্রাণী। এর মানে কি মানুষের রক্ত গরম আর ব্যাঙের রক্ত ঠান্ডা? না, সেটা নয়। তাহলে শীতল রক্তের প্রাণী মানে কী?
মানুষ উষ্ণ রক্তের প্রাণী। কম-বেশি এ কথা আমরা সবাই হয়তো শুনেছি। আরও বেশি সম্ভবত শুনেছি শীতল রক্তের প্রাণীদের কথা। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কোল্ডব্লাডেড’। যাঁরা গল্প-উপন্যাস, বিশেষ করে থ্রিলার ঘরানার কল্পকাহিনি পড়েন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই শব্দগুচ্ছের সঙ্গে পরিচিত। বৈজ্ঞানিকভাবে সাপ শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী। তবে এই শীতলরক্ত বলতে যা বোঝানো হয়, সেটা; আর থ্রিলার ঘরানার গল্পের ‘কোল্ডব্লাডেড’ এক জিনিস নয়। সত্যি বলতে কী, সাপের রক্ত কিন্তু আসলে শীতলও নয়! তাহলে ঘটনাটা কী?
বিষয়টা বুঝতে হলে প্রথমে সাধারণ শব্দ আর বৈজ্ঞানিক পরিভাষার পার্থক্য বুঝতে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে একটা শব্দ যে অর্থ বোঝায়, প্রচলিত অর্থে শব্দটির মানে সেটা নাও হতে পারে। যেমন পদার্থবিজ্ঞানে কাজ বলতে বোঝানো হয় কোনো বস্তুর ওপর প্রযুক্ত বল এবং বল প্রয়োগের ফলে বস্তুটির সরণের গুণফলকে। এটাকে বৈজ্ঞানিকভাবে লেখা হয়, W = F×s। বিষয়টাকে আরও নিখুঁতভাবে হিসাব করতে প্রযুক্ত বল আর সরণের মধ্যকার কোণকেও হিসাবে নিতে হবে। তবে আমাদের আলোচনার জন্য এর দরকার নেই, তাই সে জটিলতায় আমরা যাব না। একটা উদাহরণ দিলে বরং বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে।
অর্থাৎ দেয়ালটির সরণ হয়নি। তাই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় কাজের পরিমাণ শূন্য। যদিও প্রচলিত অর্থে আমি হয়তো সারাদিন অনেক কাজ করেছি, অনেক পরিশ্রম করেছি। এই পরিভাষাগত পার্থক্যের কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। ‘শীতল রক্তের প্রাণী’ শুনেও অনেকের এরকম বিভ্রান্তি হতে পারে
আমরা যদি একটা ফুটবলে আস্তে করে লাথি মারি, এবং বলটা যদি এর ফলে খানিকটা গড়িয়ে যায়; তার মানে প্রযুক্ত বলের (লাথি থেকে যে বল দেওয়া হয়েছে) জন্য ফুটবলটার সরণ (অতিক্রান্ত দূরত্ব) হয়েছে। অর্থাৎ কাজ হয়েছে। আবার আমি যদি একটা দেয়ালকে সারাদিন ধরেও ধাক্কা দিই প্রচণ্ড শক্তিতে, দেয়ালটি একটুও নড়বে না। অর্থাৎ দেয়ালটির সরণ হয়নি। তাই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় কাজের পরিমাণ শূন্য। যদিও প্রচলিত অর্থে আমি হয়তো সারাদিন অনেক কাজ করেছি, অনেক পরিশ্রম করেছি। এই পরিভাষাগত পার্থক্যের কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। ‘শীতল রক্তের প্রাণী’ শুনেও অনেকের এরকম বিভ্রান্তি হতে পারে।
সে আলোচনায় যাওয়ার আগে থ্রিলার গল্পে ‘কোল্ডব্লাডেড’ বলতে কী বোঝানো হয়, তা বলি। আক্ষরিক অর্থে এর মানে শীতল রক্ত নয়, বোঝানো হয় নির্মম। অর্থাৎ কেউ ঠান্ডা মাথায় কোন নির্মম আচরণ করছে, এটা বোঝাতেই এক্ষেত্রে শীতল রক্তের মানুষ বা কোল্ডব্লাডেড বলা হয়। আবার ‘সাপ শীতল রক্তের প্রাণী’—এ কথা শুনে কেউ যদি ভাবেন সাপ নির্মম প্রাণী, তা কিন্তু ঠিক নয়। বরং বেশিরভাগ সাপই নিরীহ। কেউ কেউ তাই ‘শীতল রক্ত’ শুনে মনে করতে পারেন, সাপের রক্ত বুঝি ঠান্ডা। আর মানুষ উষ্ণ রক্তের প্রাণী মানে বুঝি মানুষের রক্ত গরম। আসলে তা নয়।
বৈজ্ঞানিকভাবে ‘উষ্ণ রক্তের প্রাণী’ বা ওয়ার্মব্লাডেড মানে, এ ধরনের প্রাণীদের দেহের বা রক্তের তাপমাত্রা বাইরের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং এ ধরনের প্রাণীরা নিজ দেহে তাপ উৎপাদন করে তাপীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে
বৈজ্ঞানিকভাবে ‘উষ্ণ রক্তের প্রাণী’ বা ওয়ার্মব্লাডেড মানে, এ ধরনের প্রাণীদের দেহের বা রক্তের তাপমাত্রা বাইরের পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং এ ধরনের প্রাণীরা নিজ দেহে তাপ উৎপাদন করে তাপীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের দেহের একটি আদর্শ তাপমাত্রা থাকে। এই তাপমাত্রায় দেহ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। তাই শরীরের ভেতরে নির্দিষ্ট এই তাপমাত্রা বজায় রাখতে সদাসচেষ্ট থাকে দেহ। পরিবেশের তাপমাত্রা কম বা বেশি হলেও শরীর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় দেহের তাপ একই রাখতে চেষ্টা করে যায়।
যেমন মানুষের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট। মানুষের দেহের পেশীগুলোর কর্মক্ষম থাকতে এ তাপমাত্রা বজায় রাখা প্রয়োজন। তাই পরিবেশের তাপমাত্রা কমে গেলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস সংকেত পাঠায় সারা দেহে। আমাদের শীত লাগে। হাইপোথ্যামালাসের সংকেত পেয়েই শরীর চামড়ার ঠিক নিচের শিরা-উপশিরায় রক্ত প্রবাহ কমিয়ে দেয়, যেন পরিবেশের কম তাপমাত্রা রক্তের ওপর সেভাবে প্রভাব না ফেলে। বেশি শীতে আবার শরীরে কাঁপুনি হয়। এই কাঁপুনির ফলে পেশী সংকোচিত-প্রসারিত হয়, যার ফলে কিছুটা তাপ উৎপাদিত হয় দেহের ভেতরে। এভাবে মস্তিষ্ক দেহে তাপীয় ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। পাশাপাশি আমাদের যেহেতু শীত লাগতে থাকে, তাই আমরা ভারী জামা-কাপড় গায়ে দিই। এরকম নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে মানবদেহ নামের জৈবব্যবস্থাটি দেহের ভেতরের আদর্শ তাপমাত্রা বজায় রাখতে চায়। ‘উষ্ণ রক্তের’ সব প্রাণীর দেহেই এরকম ব্যবস্থা থাকে।
সাপ, ব্যাঙ বা অন্যান্য প্রজাতির সরীসৃপ—এ ধরনের শীতল রক্তের প্রাণীদের দেহে এরকম কোনো সুনির্দিষ্ট বা আদর্শ তাপমাত্রা বজায় রাখার ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো তাপ উৎপাদন ব্যবস্থা। ফলে পরিবেশের তাপ কমে গেলে এ ধরনের প্রাণীদের দেহের ভেতরের তাপও কমে যায়। তাপ বেশি কমে গেলে এই প্রাণীদের দেহের ভেতরের ব্যবস্থাগুলো অকেজো হয়ে পড়তে পারে। দেখা দিতে পারে শক্তিসংকট। তবে এসব প্রাণী অনেকটা শীত সহ্য করতে পারে। এই বিষয়টাকে কাজে লাগিয়ে প্রচণ্ড শীতের সময় শীতল রক্তের প্রাণীরা শীতনিদ্রায় চলে যায়। ইংরেজিতে এটাকে বলে হাইবারনেশন। অর্থাৎ এ ধরনের প্রাণীদের মস্তিষ্ক ভাবে, তুমি শীত সহ্য করতে পার, তবে অনেক বেশি শীতে তোমার দেহের ভেতরের ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়তে পারে। তাই শক্তি খরচ করো না। তোমার বাড়তি খাবার প্রয়োজন নেই, প্রজননের প্রয়োজন নেই—তুমি বিশ্রাম নাও।
দীর্ঘসময়ের জন্য তাই এ ধরনের প্রাণীরা শীতনিদ্রায় চলে যায়। শীত কেটে গেলে আবার জেগে উঠে ফিরে যায় স্বাভাবিক জীবনে।
মোট কথা হলো, ‘উষ্ণ রক্তের প্রাণী’ ও ‘শীতল রক্তের প্রাণী’—এ দুটি বৈজ্ঞানিক শব্দ। এদেরকে তাই আক্ষরিক অর্থে নেওয়া চলবে না।
লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা