জলচর কোড়া

এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…

এক জোড়া পুরুষ কোড়াছবি: মো. মারুফ রানা

বাচ্চা চারটির বয়স এখন চার মাস চলছে। হাবাগোবা ভাবটা রয়ে গেছে আজও, চালচলনেও আনাড়িভাব। সুন্দর চোখে সব সময় যেন একটা ভয় লেগে থাকে। চার ভাইবোন সব সময়েই কাছাকাছি থাকে। কেউ একটু দূরে সরে গেলে অন্যরা চাপাস্বরে তাকে কাছে ডাকে। রাতের বেলায় হোগলা বা নলখাগড়ার ঘন ঝোপের ভেতরে পাশাপাশি আশ্রয় নেয়। শরীরে শরীর মিশিয়ে মাটিতে বুক-পেট ঠেকিয়ে ঘুমায়। এখন শীতকাল, তাই পিঠের পালকের ভেতর ঠোঁট গুঁজে রাখে। তাতে শীত কম লাগে। এদের নাকের ছিদ্রটা বেশ বড়, জোরালো বাতাস ঢুকলে চাপা বাঁশির শব্দের মতো ওঠে। তাতে ওদের শীতও বেশি লাগে।

বাচ্চা চারটির মা-বাবাও রাতে আশ্রয় নেয় একই এলাকায়। কিন্তু মা-বাবার ভেতরে এখন যোগাযোগ নেই। দুজনের কেউই বাচ্চাদের আদর সোহাগ তো করেই না—আদর সোহাগ পাওয়ার জন্য মা বা বাবার দিকে এগোলে তারা গলা উঁচিয়ে ভয় দেখায়, তেড়ে আসে। বাচ্চা চারটি বুঝে উঠতে পারেনি যে বাবা-মা এই সেদিনও তাদের ভালোবাসত, খাবার চিনিয়ে দিত, পাখার আড়ালে রাখত বিপদ-আপদে, সেই মা-বাবা কেন এখন এমন করছে?

এই তো সেদিনের কথা। ছয় ভাই-বোন মিলে মা-বাবার পেছনে পেছনে উড়ে এই বিলের পথে পাড়ি জমিয়েছিল। দূরত্ব তো কম কিছু ছিল না। প্রায় ৫ কিলোমিটার পথ। বেশ নিচু দিয়ে মা-বাবার পেছনে পেছনে পাশাপাশি সারি বেঁধে আসছিল এদিকে। বাচ্চা ছয়টির পাখা ক্লান্তির ভারে অসাড় হয়ে আসছিল। ছয় ভাই-বোন তখনো জানত না—কোথায় চলেছে এরা।

ক্লান্ত পাখায় উড়তে উড়তে একসময় মা-বাবা নেমেছিল একটি ঝাউগাছের মাথায়। মিনিট পনেরো জিরোবার পর গাছতলায় এসেছিল একজন মানুষ। মা-বাবা তখন গলা লম্বা করে ভয়ে ভয়ে দেখছিল নিচের দিকে। তখনই প্রচণ্ড শব্দ। গুলি করেছিল লোকটি। সঙ্গে সঙ্গে ঝট করে উড়াল দিয়েছিল মা-বাবা। বাচ্চারাও উড়ল, কিন্তু ওরা দেখল, ওদের এক ভাই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তখন ওরা ৫ জন। আরও অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর পথে পড়েছিল ছোট একটা নদী। ওই নদীটা পাড়ি দেওয়ার সময় আকাশের অনেক ওপর থেকে জেটবিমানের মতো সাঁই সাঁই শব্দে নেমে এসেছিল একটি কুড়াবাজ। পাক খেতে খেতে এসেই সে আরেক ভাইকে নখরে গেঁথে ফেলেছিল। ভাইটির সে কী কান্না। কয়েকটি পালক খসে বাতাসে ঘুরপাক খেতে খেতে নিচের দিকে নামছিল। ভাইটি মুক্তির জন্য পাখা ঝাপটাচ্ছিল। ঈগলটি চলে যাচ্ছিল অন্যদিকে।

জন্মস্থানটা তো ছিল একটা ধানের মাঠ। জন্মেই প্রথম দেখেছিল সবুজ ধানগাছ আর পানি। পেয়েছিল পানির গন্ধ। দেখেছিল মাথার ওপরের খোলা আকাশ। আর সেই আকাশে উড়ন্ত বাজ, চিল ও বালিহাঁস। যে বাসায় জন্মেছিল ছয় ভাই-বোন, সে বাসাটা ছিল বেশ পুরু, আরামদায়ক।
আরও পড়ুন

আরও কিছু সময় ওড়ার পরে চার ভাই-বোনের নজরে পড়েছিল বিশাল এই বিল। বিলের যেন শেষ নেই। পানি আর পানি। ওপরে বিশাল খোলা আকাশ। কত রকম পাখি যে ওরা দেখতে পাচ্ছিল। চার ভাই-বোন অবাক যেমন হয়েছিল এত রকমের জলের পাখি দেখে, তেমনি ঘাবড়ে গিয়েছিল পাখিদের সংখ্যায়।

এই জলের পাখিটির নাম কোড়া। জলমোরগও বলা যায়। ইংরেজি নাম Kora, Water Cock। বৈজ্ঞানিক নাম Gallicrex cinerea।
অলংকরণ: হাশেম খান (২০০৮)

ওই প্রথম দেখা। ডুবুরি, পানকৌড়ি, জলপিপি, সাপপাখি, ধূসর বক, ঢেঙা, চা-পাখি, জিরিয়া, রেইল, ক্রেক, জলমুরগি, সরালি হাঁস, বড় সাদা-বক, কালিমসহ আরও কত পাখি। চার ভাই-বোন আগে আর দেখেনি। দেখেনি এ রকম বিশাল বিল। দেখবে কীভাবে? এদের জন্মস্থানটা তো ছিল একটা ধানের মাঠ। জন্মেই প্রথম দেখেছিল সবুজ ধানগাছ আর পানি। পেয়েছিল পানির গন্ধ। দেখেছিল মাথার ওপরের খোলা আকাশ। আর সেই আকাশে উড়ন্ত বাজ, চিল ও বালিহাঁস। যে বাসায় জন্মেছিল ছয় ভাই-বোন, সে বাসাটা ছিল বেশ পুরু, আরামদায়ক। বড়সড় গোলগাল ধরনের বাসাটা ছিল শরঘাস, কাশের ডগা আর ধানপাতা দিয়ে তৈরি, ছিল বেশ লুকানো জায়গায়, ধানক্ষেতে চওড়া ও উঁচু আইলের ভেতরে ছায়া ছিল একটা জিয়লগাছের—যেটার গোড়া ছিল পানির ডোবা। আশপাশে ছিল শোলাগাছ আর কলমিলতার ঘন দাম। জিয়লগাছটা না থাকলে আকাশটা ওরা দেখতে পেত সরাসরি। 

বাচ্চা ছয়টির বয়স যখন হয়েছিল মাত্র ২/৩ দিন, তখন ওরা বাসা ছেড়ে নেমে পড়েছিল পানিতে। আহা! পানির ছোঁয়া কী মিষ্টি। জলজ উদ্ভিদ, ধান, কাশ, কলমি ও শোলাগাছের কী আশ্চর্য জলজ ঘ্রাণ। ছয় ভাই-বোন আনন্দে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিল। এত মজা রেখে এতদিন তারা বোকার মতো বাসায় বসেছিল!

মা-বাবার পেছনে পেছনে ঘুরতে ঘুরতে ছয় ভাই-বোন শিখে ফেলেছিল বিপদ থেকে বাঁচার কৌশল। এই ধানের মাঠের নানান রকম জলের পাখিকে ফেলেছিল চিনে। যেমন বালি হাঁস, ডাহুক, কানিবক। চিনেছিল খাবার। তারপর ওদের বয়স যখন হয়েছিল ২৫/২৬ দিন, তখন একদিন ওরা পাখা মেলে উড়েছিল। আহা! ওড়ার এত আনন্দ। কিন্তু মা-বাবার হুঁশিয়ারিতে ওরা ওড়ার অনুমতি আর পায়নি। শিখে ফেলেছিল যে না-পারলে উড়তে নেই, তাতে নানান বিপদ ঘটতে পারে। সবচেয়ে বেশি ভয় মানুষকে, তারপরে গুইসাপ আর ভোঁদড়কে। বিপদে একদিন অবশ্য পড়ে গিয়েছিল এক ভাই আর এক বোন। মাছের জন্য পেতে রাখা জালে গলা দিয়ে আটকে গিয়েছিল ওরা। অনেক টানাটানির পরে অবশ্য মুক্তি পেয়েছিল। আরেকদিন একটু খোলামতন জায়গায় বেরুতেই আকাশ থেকে ডাইভ মেরেছিল একটি সাগর-ঈগল। উল্টে গিয়ে ঘাসবনে ঢুকে না পড়লে উপায় ছিল না সেদিন। এতসব বিপদ-আপদের মধ্যেও চলছিল বেশ। প্রতিদিনই শিখছিল নতুন নতুন কিছু। কিন্তু যেটা ওরা বুঝতে পারেনি, সেটা হচ্ছে, ওরা যে ডিমের ভেতর থেকে বেরিয়েছিল, সে ডিমের রং কেমন ছিল। ওরা তো জানেই না, ওরা ছিল ডিমের ভেতর। কেননা, ডিমের খোসা মা-বাবা ওদের জন্মাবার পরপরই জলে ফেলে দিয়েছিল। ওরা জানে না, মা-বাবা কত কষ্ট করে এই ধানের মাঠের ভেতর বাসা বাঁধার জায়গা খুঁজতে ঘোরাঘুরি করেছিল তিন দিন। তারপর দুজনে মিলে অনেক কষ্টে বাসাটি সাজিয়েছিল ৫ দিনে। শেষে মা ডিম পেড়েছিল, আর সে ডিমের খোসা ছিল মেটে রঙের, ওপরে ছিল লালচে ছিটছোপ। মা-বাবা পালা করে ২৩ দিন তা দেওয়ার পরেই-না ডিম থেকে বেরিয়েছিল ছয় ভাইবোন! তখন ভাদ্রমাস।

বেশ বড়সড় এই জলের পাখিটির নাম কোড়া। জলমোরগও বলা যায়। ইংরেজি নাম Kora, Water Cock। বৈজ্ঞানিক নাম Gallicrex cinerea। শরীরের মাপ ৪৪ সেন্টিমিটার। খুবই সুন্দর পাখি। লম্বা পা, লম্বাটে ঘাড়। সাধারণ সময়ে পুরুষ ও মেয়ে পাখি দেখতে একই রকম।

কার্তিকের শেষ দিকে মাঠের জলে টান পড়ল। জায়গায় জায়গায় মাটি জেগে উঠল। ধানের চারায় রং লাগল। তারপরও ছয় ভাই-বোন মা-বাবার সঙ্গে রয়ে গিয়েছিল ওই মাঠে। অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময়ে যখন মাঠ প্রায় শুকিয়ে গেল, ধান কাটার জন্য মানুষ নামতে শুরু করল মাঠে, তখন আর ওখানে থাকা নিরাপদ মনে করল না মা-বাবা। তা ছাড়া ধান কেটে নেওয়ার পর শুকনো মাঠে খাবার যেমন জুটবে না, তেমনি থাকবে না নিরাপত্তা। এ রকম সময়েই ছয় ভাই-বোনকে নিয়ে দূরে পাড়ি জমিয়েছিল মা-বাবা। যেখানে যাচ্ছে সেখানে শীত-গ্রীষ্মেও পানি থাকে, খাবার মেলে, আছে নিরাপদ আশ্রয়; নানান রকম জলজ উদ্ভিদ, বড়বড় ঘাসবন, হোগলাবন, আরও কত কী!

ক্লান্ত ডানায় চার ভাই-বোন যখন অবাক চোখে দেখছে নানা রকম পাখি, বিশাল বিল, তখন মা-বাবা নেমে পড়েছিল একটা হোগলাবনের পাশে। নেমেছিল চার ভাই-বোনও। বিলের ওপরে চক্কর দিচ্ছিল সরালি হাঁসের ঝাঁক, উড়ছিল বাজ-ঈগল আর শালিক, ফিঙে, কসাইসহ কতরকম পাখি। অবাক চোখে দেখছিল চার ভাই-বোন।

আরও পড়ুন

আস্তে আস্তে বিলের আশপাশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল তারা। বুঝে ফেলেছিল এটাই হচ্ছে তাদের স্থায়ী আস্তানা। বর্ষাকালে বিশাল এই হাওড় যখন পানিতে টইটম্বুর হয়, তখন খাদ্য যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না নিরাপদ আশ্রয়। বেরিয়ে পড়তে হয় তখনই। জলভরা ধানক্ষেত, পাটক্ষেত বা ছোট ছোট বিল-জলাশয়-মাঠে চলে যায় এরা। ডিম-বাচ্চা তুলে আবারো ফিরে আসে এই স্থায়ী আস্তানায়।

শীত বাড়ল। প্রতিদিন শত শত পরিযায়ী পাখি এসে নামতে লাগল এই বিলে। চার ভাই-বোনের বিস্ময়ের আর অন্ত রইল না। কোন দেশে বাড়ি ওদের, কেমন ওদের দেশ! বিলে চরতে চরতে নানান রকম পাখির সঙ্গে দেখা হয়। তেড়ে যায় মারতে। ওরা যেন বলে, মারবে কেন বাছারা। আমরা তো তোমাদের দেশে এসেছি বেড়াতে। আমাদের দেশে এখন দারুণ শীত। খাদ্যের অভাব। তাই তো চলে এসেছি তোমাদের কাছে। এসো, আমরা মিলেমিশে থাকি। আমরা সবাই তো জলের পাখি। পানিই আমাদের ঠিকানা। সময় হলেই আমরা ফিরে যাব। তোমাদেরকেও যেতে হবে অন্য কোথাও। বাছারা, ডিম-বাচ্চা তুলে আগামী বছর যখন তোমরা ফিরে আসবে এখানে, তখন আবারো দেখা হবে আমাদের সঙ্গে। এই তো নিয়ম।

ওদের বয়স যখন হয়েছিল ২৫/২৬ দিন, তখন একদিন ওরা পাখা মেলে উড়েছিল। আহা! ওড়ার এত আনন্দ। কিন্তু মা-বাবার হুঁশিয়ারিতে ওরা ওড়ার অনুমতি আর পায়নি। শিখে ফেলেছিল যে না-পারলে উড়তে নেই, তাতে নানান বিপদ ঘটতে পারে। সবচেয়ে বেশি ভয় মানুষকে, তারপরে গুইসাপ আর ভোঁদড়কে।
লড়াইবাজ পাখি হিসেবে বিশেষ পরিচিত কোড়া
ছবি: মুজাহিদুল ইসলাম

শীত ফুরাল। গরমকাল এল। বিলে পানি রইল। ফিরে গেল পরিযায়ী পাখিরা। এল বর্ষাকাল। তখন চার ভাই-বোন আর একসঙ্গে থাকে না। বড় হয়ে গেছে। যার যার মতো থাকে। চার জন চার জনের মতোই পাড়ি জমাল গ্রামের ধানের মাঠগুলোর দিকে।

এক ভাই এসে নামল সেই ধানের মাঠে, গত বছর ভাদ্রে যেখানে তার জন্ম হয়েছিল। বেশ বড় মাঠ। ধান আর ধান। ওই মাঠে এসেছে আরও কয়েকটি পাখি। একই প্রজাতির।

ভাই-পাখিটির তখন কেবলই গলা খুলে ডাকতে ইচ্ছে করে। ভোর, ভরদুপুর আর সন্ধে নামার আগে। সে গলা ফুলিয়ে মাথা দুলিয়ে ‘ট্রুব, ট্রুব ট্রুব’ শব্দে জোরে জোরে ডাকে। সে ডাক ছড়িয়ে পড়ে বহু দূর। আশপাশের মানুষ বুঝতে পারে মাঠে কোড়া পাখি এসে গেছে।

বেশ বড়সড় এই জলের পাখিটির নাম কোড়া। জলমোরগও বলা যায়। ইংরেজি নাম Kora, Water Cock। বৈজ্ঞানিক নাম Gallicrex cinerea। শরীরের মাপ ৪৪ সেন্টিমিটার। খুবই সুন্দর পাখি। লম্বা পা, লম্বাটে ঘাড়। সাধারণ সময়ে পুরুষ ও মেয়ে পাখি দেখতে একই রকম। মেয়েপাখির শরীরের মাপ হচ্ছে ৩৯ সেন্টিমিটার।

এক নজরে কোড়া হচ্ছে বাদামি রঙের পাখি। মাথার চাঁদি কালচে। পাখার প্রান্তের পালকগুলো কালো। বাদামি পিঠের ওপর কালচে কালচে ছোপ আছে। বুকে আড়াআড়িভাবে অস্পষ্ট কালচে কালচে সূক্ষ্ম দাগ। পেট ও লেজের তলায় ওই পাথালি দাগ বেশি ঘন ও স্পষ্ট। লেজের আগা তীর্যক। ভয়ে ও আনন্দে ওই লেজ ঘন ঘন দোলায়।

আরও পড়ুন

বাসা যখন বাঁধে, তখন পুরুষ পাখিটির রং যায় বদলে। ঘাড়, চিবুক ও পিঠ কালো হয়ে যায়। গলা, বুক ও পেটের রংও হয়ে যায় কালচে। ওই সময় পুরুষ কোড়াকে ভারি সুন্দর দেখায়। চোখ হয় বেশি উজ্জ্বল। ডাকাডাকিও বেড়ে যায় বাসা বাঁধার আনন্দে।

কোড়ার, বিশেষ করে পুরুষ কোড়ার কপালের আলতার মতো লাল রঙের শক্ত বর্মটি ওর সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্মটি আবার কপালের ওপরে প্রায় ৪ সেন্টিমিটারর মতো বাড়ন্ত থাকে, যাকে মনে হয় চোখা শিং। হ্যাঁ, শিং-ই বটে। লড়াইয়ের সময়ে (পুরুষে পুরুষেই লড়াই হয়, কেননা প্রতিটি পুরুষ কোড়া একটা নির্দিষ্ট এলাকা নিয়ে রাজত্ব করে। তার রাজত্বে অন্য পুরুষ কোড়া ঢুকলেই লড়াই লেগে যায়।) কপালের ওই বর্ম আর শিং ওরা ব্যবহার করে। ও রকম লড়াই আমি গাছে বসে দেখেছি। সামান্য ঠোকাঠুকির শব্দও শোনা যায়। মেয়ে কোড়ারও বর্ম আছে। তবে সেটা ছোট, মাথার ওপরে জেগেও থাকে না।

কোড়ার চোখের রং লাল। লম্বা পা ও পায়ের লিকলিকে লম্বা চারটে আঙুলের রঙও লাল। ঠোঁটও লাল। জিভের রং পান্না-সবুজ।

কিশোরবেলায় আমি নিজেও বহুবার কোড়ার ডিম এনে ভেজে খেয়েছি, বাচ্চা পুষেছি। ভালো পোষ মানে এবং পোষা কোড়া দিয়ে বুনো কোড়া শিকার করা যায়। বাংলাদেশে পোষা কোড়া আজো আছে। তবে কমে গেছে আগের চেয়ে।
বাংলাদেশে পোষা কোড়া আজো আছে। তবে কমে গেছে আগের চেয়ে। ভালো পোষ মানলে ছেড়ে দিয়েও পোষা যায়।

পায়ের আঙুল লম্বা হওয়ায় ওরা জলজ উদ্ভিদের ওপর দিয়ে যেমন হাঁটতে পারে, তেমনি প্রয়োজনে ডুব-সাঁতারও দেয়। অসম্ভব চালাক। এই কোড়া পাখিরা ঘাস, পাটক্ষেত, ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়েই কেবল হেঁটে বেড়ায়। না-পারতে উড়বে না। বিপদের গন্ধ পেলে লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত হেঁটে দূরে সরে যাবে। বাচ্চা হওয়ার খুশিতে প্রচণ্ড রকম ডাকাডাকি করে, সে জন্য মানুষ বুঝে ফেলে বাসাটি কোন এলাকায় আছে এবং সহজেই তারা বাসা খুঁজে ডিম ও বাচ্চা নিয়ে যায়। কিশোরবেলায় আমি নিজেও বহুবার কোড়ার ডিম এনে ভেজে খেয়েছি, বাচ্চা পুষেছি। ভালো পোষ মানে এবং পোষা কোড়া দিয়ে বুনো কোড়া শিকার করা যায়। বাংলাদেশে পোষা কোড়া আজো আছে। তবে কমে গেছে আগের চেয়ে। ভালো পোষ মানলে ছেড়ে দিয়েও পোষা যায়। প্রভুর ইশারায় উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুনো কোড়ার ওপর। লড়াই বাঁধে এবং পায়ে পা আঁকড়ে ধরে, ছাড়ে না সহজে। এমনিতেই কোড়ারা তুখোড় লড়াকু পাখি। ওরা খায় কচি কচি জলজ ঘাস, গুল্ম, ধান ও ঘাসের বীজসহ পোকা-মাকড়, শামুক ব্যাঙ ইত্যাদি।

আজ থেকে ৩০ বছর আগেও বাংলাদেশে প্রচুর কোড়া ছিল, কমে গেছে অনেক। এখন আর শাওন-ভাদ্রে শোনা যায় না ওদের উঁচু কণ্ঠের মন-ভুলানো সুরেলা ডাক। কমে গেছে ওদের আবাসভূমি, মরছে শিকারিদের হাতে। উপকারী এই পাখিটিকে টিকিয়ে রাখা বড়ই জরুরি, নইলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ওরা।

লেখক: প্রকৃতিবিদ ও পাখিবিশারদ 

* লেখকের বাংলাদেশের পাখি (৩য় খণ্ড), শিশু একাডেমি (২০০৮) থেকে নেওয়া

রং-বেরঙের পাখি নিয়ে আরও পড়ুন