কেমন হতো বিড়ালহীন পৃথিবী

বিড়ালহীন পৃথিবীতে থাকত ইঁদুরের দৌরাত্ম্যছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি প্রতীকী ছবি

পৃথিবীর অনেক মানুষই বিড়াল পছন্দ করেন। আবার বিড়াল দেখলে বিরক্ত হন, এমন মানুষও কম নয়। এমনও মানুষ আছেন, যাঁরা পৃথিবীতে বিড়াল থাকার যৌক্তিকতা বুঝতে পারেন না। ভাবেন, বিড়াল না থাকলে হয়তো পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতে পারত। কিন্তু আসলেই কি তাই? বিজ্ঞান ভিন্ন কথা বলে।

মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে বিড়ালের যেমন অবদান আছে, তেমনি মানুষকে টিকে থাকতেও সাহায্য করে এই ছোট্ট আদুরে প্রাণী। সত্যি বলতে কী, বিড়াল ছাড়া আমরা হয়তো বাঁচতে পারতাম না। কারণ জানতে চান? আসুন, কল্পনায় বিড়ালশূন্য পৃথিবী থেকে একটু ঘুরে আসি।

প্রাচীন মিসরে যুদ্ধের দেবী বাসতেত (ইংরেজিতে ‘বাস্ট’ও বলা হয়) থেকে শুরু করে বনের রাজা সিংহ, আমাদের সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী প্রাণী চিতা কিংবা আপনার বাসায় দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটানো প্রাণীটা—সবই বিড়াল কিংবা বিড়ালজাতীয় প্রাণী। বিড়ালকে চাইলে অলস বলে কটাক্ষ করতে পারেন। কিন্তু পৃথিবীর সফল শিকারী প্রাণীদের তালিকায় ছয় নম্বরে আছে এরা। কাজেই বিড়ালকে বাঘের মাসি বলার যৌক্তিকতা আছে বলা যায়।

বিড়াল না থাকলে অবধারিতভাবে বেড়ে যেত ইঁদুরের সংখ্যা
ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি প্রতীকী ছবি

গৃহপালিত বিড়াল, যাকে আমরা মূলত বিড়াল নামে চিনি, প্রায় ৩২ ভাগ সময় শিকারকে মেরে ফেলতে পারে। রাস্তায় বড় হওয়া বিড়ালদের শিকার ধরার হার আরও বেশি। অন্যদিকে বন্য বাঘের শিকার ধরার ক্ষেত্রে সফলতার হার মাত্র ৫ শতাংশ। এর পেছনে অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। বাঘ শিকার করে হরিণের মতো দ্রুতগামী প্রাণীকে, ওদিকে বিড়ালের প্রধান শিকার ইঁদুর।

এ থেকে হয়তো বুঝতে পারছেন, আপনার পোষা বিড়ালটি কেবল তুলতুলে আদুরে প্রাণী নয়। রীতিমতো দানবীয় গুণাবলী রয়েছে এর। বলা চলে, ভয়ংকর শিকারী। দিনের ১৬-১৮ ঘন্টা সময় ঘুমিয়ে পার করে, সত্যি। বাকি সময়টা কাটায় ঘোরাঘুরির পাশাপাশি শিকার ধরা ও সে জন্য প্রশিক্ষণে। আর বিশ্বজুড়ে ইঁদুরের উপদ্রব কমাতে তো কাজ করেই।

ইঁদুর শিকারের এই দিকটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো ভাবছেন, ইঁদুর আর এমন কী বিপদ। ছোট্ট এই প্রাণী তো আর পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে না। কথা সত্য, কিন্তু সেটা বিড়াল আছে বলে। বিড়ালবিহীন পৃথিবীর জন্য এ কথা সত্যি নয়।

পৃথিবীতে ইঁদুরের দৌরাত্ম্য কমে যাওয়ার পেছনে আমরা নিজেদের বাহবা দিই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মধ্যযুগে ইঁদুরের কারণে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীজুড়ে প্রায় ২০ কোটি মানুষ মারা যায়। (প্লেগ হতো মূলত ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে। ইঁদুর ও ইঁদুরের গায়ে বাস করা এক ধরনের পরজীবি কীটপতঙ্গের মাধ্যমে এ ব্যাকটেরিয়া মানুষের দেহে প্রবেশ করত। বাতাসের মাধ্যমেও একজনের থেকে অন্যজনে ছড়াতো এ ব্যাকটেরিয়া। শরীরে ব্যাকটেরিয়া  সপ্তাহের মধ্যেই শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে ফেটে বেরিয়ে আসতো রক্তপুঁজ বেরিয়ে হতো যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। বিজ্ঞানীরা এ রোগের নাম দিয়েছিলেন বিউবোনিক প্লেগ।)

সব বাচ্চা বেঁচে থাকলে তিন বছর শেষে এই এক জোড়া ইঁদুর থেকে তৈরি হবে প্রায় অর্ধশত কোটি ইঁদুরের এক বিশাল কলোনি

এখনও ইঁদুর দমনে শতভাগ কার্যকর কোনো উপায় নেই মানুষের হাতে। হ্যাঁ, বিষ ও ফাঁদ আছে। কিন্তু পৃথিবীতে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের বেশির ভাগ কাজ আসলে করে বিড়াল। এককথায়, বিড়ালই হলো সত্যিকারের ‘ইঁদুর দমন কমিশন’। প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি ইঁদুর মেরে ফেলে এরা। বিড়াল না থাকলে তাই অবধারিতভাবে বেড়ে যেত ইঁদুরের সংখ্যা। ফলে, দেশে দেশে নেমে আসত দুর্ভিক্ষ ও মহামারী।

প্রাণী হিসেবে ইঁদুর বেশ নোংরা। নালা-নর্দমা বা অন্ধকার ময়লা জায়গায় এদের বাস। ইঁদুরের এক সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের পশমে থাকে বিভিন্ন ধরনের হাজারো জীবাণু। এসব জীবাণুর যেকোনোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে হুমকি। একটি বা দুটি ইঁদুরকে হয়তো ভয়ংকর ভাবার কিছু নেই। কিন্তু বিড়ালহীন পৃথিবীতে অল্প সময়ের মধ্যেই ইঁদুরের সংখ্যা হয়ে যেত কল্পনাতীত।  

কারণ, ইঁদুরের বংশবৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এক জোড়া ইঁদুর প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার বাচ্চা জন্ম দেয়। সব বাচ্চা বেঁচে থাকলে তিন বছর শেষে এই এক জোড়া ইঁদুর থেকে তৈরি হবে প্রায় অর্ধশত কোটি ইঁদুরের এক বিশাল কলোনি। অবস্থাটা ভাবতে পারছেন?

বিপুল পরিমাণ এই ইঁদুর তখন আর ছায়ায় বসবাস করবে না। বেরিয়ে আসবে আলোয়। তিন বছরের মধ্যেই বাড়িঘর সয়লাব হয়ে যাবে ইঁদুরের স্রোতে। ইঁদুর যে শুধু কামড়ানোর মাধ্যমে রোগ ছড়ায়, এমন নয়। ইঁদুরের মলমূত্র পৃথিবীর বাতাসকে দূষিত করে ফেলে। দূষিত এ বাতাস নিয়মিত গ্রহণ করলে ফুসফুস ভরে ওঠে বিষাক্ত তরলে। ফলাফল, মৃত্যু।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
মানুষ ছাড়াও ইঁদুরের কারণে কয়েক বছরের মধ্যে ৪০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখি, ৬০ শতাংশ সরীসৃপ বিলুপ্ত হয়ে যেত
ছবি: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি প্রতীকী ছবি

বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় অতিমারী রোধ করা হয়তো সম্ভব হতো। কিন্তু আটকানো যেত না দুর্ভিক্ষ। পৃথিবীর অনেক দেশেই কৃষকেরা বিড়াল পোষেন। কারণ ওই একটাই—ইঁদুরের উপদ্রব কমানো। ইঁদুরের প্রধান খাবার ছোট ছোট শস্যদানা। ফসলের ক্ষেত বলেন বা শস্যগোলা, ইঁদুরের হাত থেকে কিছুই নিরাপদ নয়। বিপুল পরিমাণ ইঁদুরের বেশি সময়ও লাগত না। খুব বড় আশংকা আছে, ইঁদুরের এ আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব হতো না। ফলে পৃথিবীজুড়ে শুরু হতো দুর্ভিক্ষ। আধপেটা মানুষের বড় একটা অংশ ইঁদুরের কারণে আক্রান্ত হতো প্লেগের মতো ভয়ংকর রোগে। দুর্ভিক্ষ ও মহামারি মানুষের অস্তিত্বকেই ফেলে দিত হুমকির মুখে। মানুষ ছাড়াও ইঁদুরের কারণে কয়েক বছরের মধ্যে ৪০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখি, ৬০ শতাংশ সরীসৃপ বিলুপ্ত হয়ে যেত।

এসব দুর্যোগ কেবল মানুষের একার পক্ষে মোকাবেলা করা হয়তো সম্ভব হতো না। মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়ত গোটা মানব সভ্যতা। এদিক থেকে চিন্তা করলে দেখবেন, বিড়ালকে আর ছোট্ট অলস প্রাণী মনে হচ্ছে না। আজকের পৃথিবীর এ অবস্থার পেছনে বিড়ালের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। কোনো প্রাণীই আসলে অপ্রয়োজনীয় নয়। পৃথিবীর জন্য সবাই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: প্রদায়ক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: হোয়াটইফশো, উইকিপিডিয়া

এই সিরিজের আরও লেখা পড়ুন

১. ব্ল্যাকহোলে পড়ে গেলে কী হবে?

২. চাঁদ না থাকলে কী হতো?

৩. পৃথিবীর ব্যাসার্ধ দ্বিগুণ হলে কী হতো?

৪. পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?

৫. সূর্যের ভর অর্ধেক হলে কি হত?

৬. পৃথিবীর দুটি চাঁদ থাকলে কী হতো?

৭. মহাকর্ষ না থাকলে কী হতো?

৮. জীবাশ্ম জ্বালানী না থাকলে কী হতো?

৯. পৃথিবী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ হলে কী হতো?

১০. পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকলে কী হতো?

১১. সপ্তাহ ধরে চোখের পলক না ফেললে কী হবে?

১২. মানব সভ্যতা টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?

১৩. পৃথিবী আলোর গতিতে ঘুরলে কী হতো?

১৪. সূর্যে নিউক্লিয়ার বোমা ফেললে কী হবে?

১৫. পৃথিবীর সমস্ত সাপ মারা গেলে কী হতো

১৬. মানুষের ঘাম না হলে কী হতো?

১৭. সৌরজগতে আরেকটা নক্ষত্র ঢুকে পড়লে কী হতো?

১৮. পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে কী হতো?

১৯. মানুষ পরমাণুর মতো ছোট হতে পারলে কী হতো?

২০. সূর্য পালসারে পরিণত হলে পৃথিবীর কী হতো?

২১. মানব সভ্যতা টাইপ টু সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?

২২. উড়োজাহাজের ভেতর সব যাত্রী একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?

২৩. সমস্ত রাস্তা সোলার প্যানেলে ঢাকলে কেমন হতো?

২৪. সূর্য নীল নক্ষত্র হলে কী হতো

২৫. সৌরজগতের গ্রহগুলোর আকার দ্বিগুণ হলে কী হতো?

২৬. মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৃথিবীর সব ময়লা ফেললে কী হতো?

২৭. লবণ না থাকলে কী হতো?

২৮. পৃথিবী আলোর বেগে ঘুরলে কী হতো?

২৯. মহাবিশ্বের সমস্ত হিলিয়াম হারিয়ে গেলে কী হতো?

৩০. সৌরজগতে বায়ুমণ্ডল থাকলে কী হতো?

৩১. কেপলার টুটুবি সৌরজগতের গ্রহ হলে কী হতো?

৩২. এক মিনিটের জন্য ঘর্ষণ বল না থাকলে কী হতো

৩৩. বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে কী হতো

৩৪. চাঁদে হ্যালির ধূমকেতু আছড়ে পড়লে কী হতো

৩৫. পৃথিবীর দুটি সূর্য থাকলে কী হতো

৩৬. পৃথিবী ঘনকাকৃতির হলে কী হতো

৩৭. মহাকাশ সাদা হলে কী হতো

৩৮. পাঁচ সেকেন্ডের জন্য অক্সিজেন না থাকলে কী হতো

৩৯. মানব সভ্যতা টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশন হলে কী হতো

৪০. সৌরজগতে ব্ল্যাকহোল ঢুকে পড়লে কী হতো

৪১. মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরলে কী হতো