বন-বাগানের পাখি বনমোরগ

এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…

সাঁওতাল বালিকার জানা ছিল বাসাটির অবস্থান। তাই সে সন্ধেবেলায় চা-বাগান পাড়ি দিয়ে চলেছে বনমোরগটিকে ধরার আশায়। ওর বাসায় যে ডিম আছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত বালিকা। মরা একটি চা-গাছের সরু ডাল সে ভাঙতে দেখেছিল ৫ দিন আগে। ভাঙা ডাল ঠোঁটে ধরে, চা-বাগানের তলা দিয়ে হেঁটে হেঁটে মোরগটি গিয়েছিল একটি টিলার পাশে। লাফ দিয়ে চড়ে বসেছিল হাত তিনেক ওপরে, টিলার গায়ে ওখানে বেশ বড়সড় গর্ত একটা, ঝোপঝাড়ে ঢাকা। ওখানে ঢুকে মোরগটি ঠোঁটের ডাল রেখে আবারো বেরিয়ে এসেছিল। আবার খুঁজতে শুর করেছিল শুকনো ডালপালা। সাঁওতাল বালিকা বুঝে ফেলেছিল, বনমোরগটি বাসা করেছে ওখানে।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের টিলাময় বন ও চা-বাগান বলতে গেলে মুখস্থ বালিকার। বহুবারই দেখেছে বনমোরগ-মুরগি, দেখেছে ছোট ছোট ছানা-পোনা। বাবা-ভাইদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সে তীর-ধনুক দিয়ে বনমোরগ-মুরগি শিকার করতে যেমন দেখেছে, তেমনি চা-বাগানের আশেপাশে ও বনে ঘোরার সময় বেশ কয়েকবার বনমুরগির ডিম খুঁজে পেয়েছে। ডিমগুলো বাড়িতে এনে মজা করে খেয়েছেও। মথুরার ডিমও সে খেয়েছে বারকয়েক। বালিকা তাই এই সন্ধেবেলায় চলেছে বাসায় বসা বনমোরগটিকে ধরতে। হিসেব মতো বাসায় ২/১টি ডিমও থাকার কথা। বাবার কাছ থেকে জেনেছে সে, বনমুরগি ৪/৫ দিনের ভেতর বাসা সাজিয়ে ফেলে। তারপরে ডিম পাড়তে শুরু করে। রোজ একটি করে ডিম পাড়ে পোষা মুরগির মতোই। প্রথম ডিমটি পাড়ার পর থেকেই বনমুরগি রাতে ডিম পেটের তলায় রেখে বসতে শুরু করে। প্রায় সময়েই ডিম পাড়ে ৫টি। ৪ ও ৬টি ডিমও দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় ১৯-২০ দিন পরে। সবগুলো ডিম ফুটতে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগে। মুরগিমাতা আরও একদিন বাদে ছানাদের নিয়ে বাসা ছেড়ে দেয়। ছেড়ে যাওয়া বাসায় আর ফেরে না মা। রাতে টিলার আশেপাশের ঝোপঝাড়ের তলায়, চা বাগানের তলায় বা অন্য কোনো যুৎসই জায়গায় মা ছানাগুলোকে ডানা-পেটের তলায় রেখে বসে ঘুমায়।

বনমোরগ
ছবি: উইকিপিডিয়া

হিসেব মতো বাসায় ২-১টি ডিম থাকতে পারে। সবগুলো ডিম পাড়ার পর এলে একই সঙ্গে মুরগি ও ডিম পেত সাঁওতাল বালিকা, কিন্তু ওই সময়ের ভেতর চা-শ্রমিকদের বা অন্য কারও নজরে পড়ে যেতে পারে বাসাটি। বনমুরগিরা কখন বাসা করে, তা জানে এই তল্লাটের সবাই। শীত কমলেই ওরা বাসা বাঁধতে শুরু করে। বর্ষাকালের আগ পর্যন্ত যে কোনো সময়েই বাসা করতে পারে বনমুরগিরা। বনমোরগদের ঘন ঘন ডাক শুনে বোঝা যায়, বনমুরগিদের বাসা বাঁধার কাজ চলছে। মোরগগুলো এ সময় আনন্দে ঘন ঘন ডাক ছাড়ে। আশেপাশের সবাইকে যেন খুশির খবর জানায়, আমাদের মুরগিগুলো এখন ডিম-বাচ্চা তুলবে।

পা টিপে টিপে সাঁওতাল বালিকা পৌঁছে গেল টিলাটির পাশে। আকাশে চাঁদ নেই। তারার আলোয় মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে বালিকা। জায়গামতো পৌঁছে সে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে খপ করে চেপে ধরতে গেল মুরগিটিকে, হাতের তলায় পড়লও মুরগিটি, কিন্তু বাঁ হাত বাড়ানোর আগেই মুরগি 'টক্ টক্' ডাক ছেড়ে উড়াল দিল। আশেপাশের সবাইকে বিপদসঙ্কেত জানিয়ে সে চা বাগানের মাথা ছুঁয়ে উড়ে গেল অনেকটা দূর। তারপর চুপচাপ সব। হতাশ বালিকার হাতে এল দুটি ডিম। ভাবল, ডিম দুটি রেখে যাই। মুরগিটি আবারো আসবে, আরও ডিম পাড়বে। কিন্তু না। বাবার কাছে সে জেনেছে, ভয় পেয়ে বাসা ছাড়লে মুরগিরা আর ফেরে না বাসায়। এমন কি, বাসায় সদ্য ফোটা দু-একটি বাচ্চা থাকলেও না। তাই মুরগি গেছে যাক, দুটি ডিম তো সে পেয়েছে। এমন মনোভাব নিয়ে সে ফিরতি পথ ধরল।

গত বছর সে একটি বাসায় ৬টি ডিম পেয়েছিল। সবগুলো ডিমেই বাচ্চা জন্মে গিয়েছিল, খাওয়া যায়নি। ডিমগুলো বাড়িতে এনে সে পোষা মুরগির পেটের তলায় দিয়েছিল। মুরগিটি ডিম তা দেয়ার উত্তাপে ছিল, তাই সে ডিমগুলো-তা দিয়েছে। সুন্দর ১২টি ছানা ফুটেছিল যার ৬টি বুনো। ওদের রক্ত ছিল লালচে বাদামি। দুদিন বাদেই ওরা পালিয়ে গিয়েছিল বনে। বালিকা জানত ওরা পোষ মানে না, চোখে চোখে রেখেছিল তাই। আটকে রাখা যেত। কিন্তু সেক্ষেত্রে ওরা খেত না কিছু, দুই চারদিনের ভেতরই মারা পড়ত। এটাও জানা ছিল বালিকার।

এই যে বনমুরগির কথা বললাম এতক্ষণ, এদের মোরগগুলো হয় খুব সুন্দর। হাটবাজার থেকে আমরা যে পোষা মোরগ কিনে খাই, তার ভেতরে মাঝে মধ্যে এমন দু-একটি মোরগ দেখা যায়, সেগুলো দেখতে হুবহু বনমোরগের মতো, কী গড়নে, কী রঙে। এ গুলোর ছবি তুলে বনমোরগ বলে চালিয়ে দিলেও সহজে কেউ ধরতে পারবে বলে মনে হয় না আমার।

ছবি: পিকচার বার্ড

বনমোরগ দেখতে খুবই সুন্দর। মাথার চমৎকার ফুলটা, গলার নিচের থলথলে চামড়াটা, চোখের চারপাশটা, বুজানো অবস্থায় ডানা যেখানে লেজের গোড়ায় শেষ হয়েছে সেখানটাসহ পিঠের কিছু অংশের রং লাল। কান সাদাটে। ঠোঁট থেকে চোখের নিচ দিয়ে চওড়া কালচে-কমলা টান কানের গোড়ায় এসে মিশেছে। মাথার পেছন দিকের চমৎকার পেলব পালকগুলোর রং আলতা-লাল। ঘাড়-গলার বাহারি পালকের রং হলুদ। পিঠ-বুক কালো। ঋতুভেদে এই রং লালচে-হলদেটে হয়। পালকের শেষ প্রান্ত কালচে। বুজানো পাখায় পালকের বিন্যাসগুলো ভালোভাবে বোঝা যায়। গায়ের রং ঘন-বাদামি। নখের রংও তাই। তরবারি নখটা (প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় দুই পায়ের পেছন দিকের যে দুটি নখ ওরা ব্যবহার করে) ছুরির মতো খুবই ধারালো এদের। বনমোরগের ঘাড়-গলায় ঝুলে থাকা বাহারি পালকগুলো যতটা সুন্দর, তার চেয়েও বেশি সুন্দর বোধহয় এদের লেজের গড়ন-ধরন, লেজ ও লেজের চকচকে কালো পালকগুলো। লেজের মূল পালক দুটি উল্টো তরবারির মতো দেখায়, লেজের অন্য পালকগুলোর চেয়ে এই দুটি বড়। শ্রীমঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা লেজের দুটি মূল পালক আমার সংগ্রহে আছে। সাঁওতালরা তীর-ধনুক দিয়ে ওটিকে শিকার করেছিল। শিকার করার পর মুহূর্তেই পালক দুটি আমি টেনে তুলেছিলাম। পালক দুটির মাপ ২৯ সেন্টিমিটার। সুন্দরবন থেকে সবশেষ ১৯৯১ সালে যে দুটি মূল পালক আমি মৌয়ালদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম, সে দুটির মাপ ছিল ৩৪ সেন্টিমিটার।

লালচে-বাদামির আভাসহ ডিমের রং সাদা। বনমোরগের শরীরের মাপ ৬০-৭০ সেন্টিমিটার। মুরগির মাপ ৪০-৪৫ সেন্টিমিটার।

বনমুরগি দেখতেও কম সুন্দর নয়। পোষা মুরগির চেয়ে একটু লম্বাটে গড়নের হয় ওরা। ওরা এক নজরে বাদামি-লাল ও ছিট-ছোপযুক্ত পাখি। টান ও ছিট-ছোপ থাকে পোড়া ইটের রঙের মতো পালকের ওপর। এদের লেজ লম্বাটে ধরনের। মূল পালক নেই।

এই মোরগ-মুরগিদের নাম বনমোরগ বা লাল বনমোরগ। ইংরেজি নাম Red Jungle Fowl. বৈজ্ঞানিক নাম Gallus gallus। সুন্দবনের বনমোরগের (মুরগিও) মাপজোক যেমন নিয়েছি বারকয়েক, শ্রীমঙ্গলেও তা করেছি। আমি নিজে সুন্দরবনে মোরগ-মুরগি শিকার করেছি, শিকার করতেও দেখেছি। হাতে নিয়ে ওদেরকে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এক শিকারি গুলি করেছিল একটি বনমুরগিকে। ওর সঙ্গে ছিল ৪টি ছানা। মুরগিটি আহত হয়েও উড়ে একটি বড় খাল পাড়ি দিয়েছিল। ছানাগুলো তাড়িয়ে ধরতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। বারবার লুকাচ্ছিল ওরা। আত্মগোপনের অসম্ভব সুন্দর কৌশল ওরা জানে। একজনের পায়ের তলায় পড়ে ১টি ছানা মারা গিয়েছিল। ২টিকে ধরা গিয়েছিল। বাকিটি হারিয়ে গিয়েছিল গোলবনে।

ছবি: ইবার্ড

এই লাল বনমোরগ আর বনমুরগিই হচ্ছে পৃথিবীর সব ধরনের পোষা মোরগ-মুরগির আদি পিতা-মাতা। সেই আদি পিতা-মাতা বাংলাদেশের সুন্দরবন, সিলেট-চট্টগ্রামের টিলা-পাহাড়িবনসহ নেত্রকোনা জেলার গারোপাহাড় এলাকা ও জামালপুর জেলার গারোপাহাড় এলাকায় আছে। আছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডু ইকোপার্কে। টাঙ্গাইলের মধুপুর বনেও থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য আমরা গর্ব অনুভব করতে পারি। এলাকাভেদে খাদ্যতালিকা একটু ভিন্ন। গারোপাহাড় এলাকায় ওদেরকে আমি ধানক্ষেতে নেমে ধান খেতে দেখেছি। বৃহত্তর সিলেটের বনমোরগরাও ধান খাবার সুযোগ পায়। সুন্দরবনে আবার ধান নেই। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনেও ধান খাওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। তবে ওদের কমন খাদ্য তালিকায় আছে কচি ঘাস-পাতার ডগা, যেকোনো ধরনের শস্যদানা, ছোট ছোট মাছ ও ব্যাঙ, নির্বিষ ও বিষধর ছোট সাপ। কেঁচো, ছোট কাঁকড়া, আঞ্জন, টিকটিকি ও বিভিন্ন ধরনের পোকা মাকড়সহ কাঁচা মরিচ, কচি বেগুন। সুন্দরবনের বাওয়ালি-মৌয়ালদের কাছে শুনেছি ধান-চাল ছিটিয়ে মোরগ-মুরগি পাকড়াও করার চেষ্টা ওরা করে সুন্দরবনে। ভাতও ছিটায়। মৌয়ালরাই সুন্দরবনে মুরগির ডিম-বাসা বেশি পায়। সুন্দরবনের বাসার উপকরণে ঘাস, শুকনো কেয়াপাতা-গোলপাতার আধিক্য থাকে।

আমি যে ৩ বার সুন্দবনে ওদের ডিম-বাসা দেখেছি, সেই ৩ বারই ছিল মাঘ মাস। লালচে-বাদামির আভাসহ ডিমের রং সাদা। বনমোরগের শরীরের মাপ ৬০-৭০ সেন্টিমিটার। মুরগির মাপ ৪০-৪৫ সেন্টিমিটার। যদিও মোরগে মোরগে তুমুল লড়াই লাগে, তবুও একদলে ৭/৮টি মুরগি ও ৩/৪টি মোরগ দেখা যায়। ধান কেটে নেওয়ার পর খুব ভোরে ও সন্ধ্যার আগে দলবেঁধে ওরা ধানক্ষেতে নামে। এই দুই সময়েই বন্দুকশিকারিরা ওদের শিকার করার মোক্ষম সুযোগ পায়। এমনিতে কী শ্রীমঙ্গল, কী সুন্দরবন; ওদেরকে শিকার করা খুবই দুরূহ কাজ। অত্যন্ত চালাক আর বুদ্ধিমান ওরা। মাটিতে বুক-পেট ঠেকিয়ে ঝোপঝাড়ের তলায় বা গাছের আড়ালে আত্মগোপন করতে ওস্তাদ। ভালো দৌড়াতে যেমন পারে তেমনি পারে দ্রুত উড়তে। তবুও সুন্দরবনে ওরা গুইসাপ, মেছোসাপ ও সাগর-ঈগলের কবলে পড়ে যায় মাঝে-মধ্যে। জেলে-বাওয়ালিদের কাছে শুনেছি, কুমিরও নাকি ধরে ওদের জলপান করার সময়।

পোষা মুরগির মতো বনমুরগিও বাসা করার পর ডিম পাড়ার আগে ডাকাডাকি করে, ডিমে সে একাই তা দেয়। তা দেওয়ার সময় মুরগির শরীর ফুলে থাকে, মেজাজ থাকে খারাপ।

বনমোরগ-মুরগির মাংস খেয়েছি আমি বাল্য-কৈশোরে। কিন্তু আজ আর আমি পেলেও ওদের মাংস খাব না। কেননা এখন জানি, ওরা মানুষের বড় উপকারী বন্ধু। নানা রকম ক্ষতিকর পোকামাকড় ওরা খায়, বন-বনানীর স্বাস্থ্য ভালো রাখে। আর বনের স্বাস্থ্য ভালো থাকা মানে পরিবেশ ভালো থাকা। অভিজ্ঞতার আলোকে এবার কিছু তথ্য জানাচ্ছি:

১. বনমুরগির বাচ্চা ধরে পোষ মানানো যায় না। কিছুই খায় না। সুযোগ পেলেই পালায়। চট্টগ্রামের রামগড়ের একটি চা বাগানের ম্যানেজারের ছেলে লতিফ, বাল্য-কৈশোর যে ওখানেই কাটিয়েছে। সে আমাকে বলেছে, বহুবার বনমুরগির বাচ্চা ধরে এনেছে (১৯৭০-৭৫), রাখতে পারে নি, পালিয়েছে, অথবা না খেয়ে মরেছে। সেই লতিফ আমার বন্ধু ও সহকর্মী। আমার এলাকার এক বাওয়ালি বাল্যকালে আমাকে দুটি ডিম এনে দিয়েছিল, বাচ্চাও ফুটেছিল। পালাতে গিয়ে বাগানে গিয়ে পড়েছিল গুইসাপের কবলে।

২. পোষা মুরগির মতো বনমুরগিও বাসা করার পর ডিম পাড়ার আগে ডাকাডাকি করে, ডিমে সে একাই তা দেয়। তা দেওয়ার সময় মুরগির শরীর ফুলে থাকে, মেজাজ থাকে খারাপ। ওদের শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকে। যাকে বলা যায় ‘ডিম তা দেওয়ার উত্তাপ’।

৩. বিপদ দেখে সতর্ক সঙ্কেত দিতে বনমোরগ খুব ওস্তাদ। খুব ভোরে, নির্জন দুপুরে আর সন্ধ্যার আগে বনমোরগের ডাক বেশি শোনা যায়। তবে ওদের গলার স্বর কম, পোষা মোরগের ডাকের মতো চড়া নয়। রাত কাটায় ওরা বাঁশঝাড় ও অন্যান্য গাছের ডালে। বিপদসঙ্কেত পেলেই ছানারা হাওয়া হয়ে যায়।

৪. সুন্দরবনে ওরা হরিণ-শুয়োরের আশপাশে ঘোরে উড়ন্ত পোকা- মাকড় খাবার আশায়। শীতে রোদ পোহায় মাটিতে শরীর এলিয়ে, পাখা মেলে দিয়ে। পাশাপাশি ওদের আশেপাশে ঘোরে কীট-পতঙ্গভোজী ছোট ও মাঝারি পাখিরা, ওই উড়ন্ত কীট-পতঙ্গ খাওয়ার আশায়। ছোট ছানারা মায়ের কোলে (পিঠে) চড়ে। পোষা মুরগির ছানাদের মতো ডাকাডাকি করে না। ওরা ধুলো বা মাটি স্নান করতে পছন্দ করে। ওতে ওদের শরীরের পরজীবী পোকা ঝরে যায়, মরে যায়। অতি উৎসাহী শিশু-কিশোরেরা যদি বনমোরগ পর্যবেক্ষণ করতে চায়, তবে চা-বাগান এলাকা ও সুন্দরবনে গিয়ে শীতের ভোরে বা ধান কেটে নেওয়ার পরে গোপন জায়গায় বসবে। বনমোরগ দেখার সুযোগ তাহলে পাওয়া যাবে হয়তো।

বনমোরগ সুন্দরবনে যথেষ্ট আছে। অন্যান্য জায়গার বনমোরগরা খুব বেশি ভালো নেই। ডিম-বাচ্চা চুরি হয়। শিকারিদের হাতে মারা পড়ে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে আমি ৩ দিনের জন্য পার্বত্য খাগড়াছড়ি জেলায় গিয়েছিলাম। খাগড়াছড়ি সদরের একটি বাজারে নাকি মাঝে মধ্যে বনমোরগ ওঠে। উপজাতিরা বিক্রি করতে আনে। কিন্তু শিশু-কিশোরদের নিশ্চয়ই জানা আছে, সরকার সব ধরনের পাখি ও বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ করেছেন। তাই শিশু-কিশোরদের উচিত হবে বনমোরগ তো বটেই, সব ধরনের পাখি শিকার ও বিক্রির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। যারা পাখি মারে ও বিক্রি করে, তাদের বোঝানো ও সমবয়সীদের ভেতর যারা পাখিদের উপকারের কথা জানে না তাদের বোঝানো। বনমোরগরা ভালো থাকুক বাংলাদেশে, ওরা যে দেশের সম্পদ। ওদের ডাকে মুখরিত থাকুক আমাদের বনগুলো।

লেখক: প্রকৃতিবিদ ও পাখিবিশারদ

* লেখকের বাংলাদেশের পাখি (৩য় খণ্ড), শিশু একাডেমি (২০০৮) থেকে নেওয়া