পোকা কেন আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়

কীটপতঙ্গ আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ছবি: সংগৃহীত

গ্রীষ্মের সন্ধ্যা। সূর্য ছুটি নিয়েছে দিনের কাজ শেষে। নিজের ঘরের জানালাটা খুলে দিয়েছেন। বাতাস আসছে, ভালো লাগছে। আলো জ্বেলে দিয়ে একটা বই হাতে তুলে নিয়েছেন। একটু পরেই টের পেলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিরা চলে এসেছে। অদ্ভুত দেখতে কিছু পোকা এসে বসছে আপনার বইয়ের পাতায়, শরীরের নানা জায়গায়। বিরক্তির একশেষ যাকে বলে!

গ্রাম-বাংলার মানুষ এই দৃশ্যের সঙ্গে বহুল পরিচিত। শহরে এ দৃশ্য একদম পরিচিত না হলেও নিতান্ত অপরিচিত নয়। বিশেষ করে মথ বা ড্রাগনফ্লাইয়ের মতো কীটপতঙ্গ আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কেমন ঘোরের মতো এসব পোকা ছুটে আসে আলোর দিকে। অনেক পোকা এ সময় এলোমেলোভাবে উড়তে থাকে, অনেকগুলো আবার ডাইভ (মানে, মাথা নিচু করে ঝাঁপ) দেয় আলো লক্ষ্য করে। মোমবাতি জ্বালানো থাকলে এসব পোকাদের জন্য বিষয়টা খুব সুখকর হয় না। অনেকগুলো গিয়ে পড়ে একদম আগুনের মধ্যে।

কিন্তু কেন এমন হয়? কেন কিছু পোকা আলো দেখে ঘোরগ্রস্থের মতো ছুটে আসে, জীবনের পরোয়া না করে ঝাঁপ দেয় জ্বলন্ত অনলে?

অনেক বিজ্ঞানী বলেন, এসব আলোর রশ্মি হয়তো পোকাদের কাছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাধাহীন, মুক্ত পথ বলে মনে হয়। সে জন্যই তারা ওই পথ ধরে ছোটে। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যেতে চায় না।

এ প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটু হিমশিমই খেতে হয়। দেখা যায়, বেশ কিছু ব্যাখ্যা আছে, তবে খুব একটা জুতসই নয় সেগুলো। বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে খটোমটো একটি বৈজ্ঞানিক শব্দ ব্যবহার করা হয়—ফটোট্যাক্সিস। অর্থাৎ কীটপতঙ্গের আলোর প্রতি সাড়া দেওয়ার প্রবণতা। সাড়া দেওয়ার ফলে এসব কীটপতঙ্গের গোটা দেহ আলোর দিকে এগিয়ে আসে বা দূরে চলে যায়।

যেসব জীব ধনাত্মকভাবে ফটোট্যাকটিক, তারা আলোর প্রতি আকর্ষিত হয়, আলোর দিকে এগিয়ে আসে। যেসব জীব ঋণাত্মকভাবে ফটোট্যাকটিক, তারা আলো থেকে দূরে সরে যায়। যেমন তেলাপোকা।

এখন বিষয়টা হলো, এই ব্যাখ্যা কতটা যৌক্তিক। অনেক ব্যাকটেরিয়ার দেহে ফটোসিন্থেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। এসব ব্যাকটেরিয়া আলোর দিকে এগিয়ে যায়। সালোকসংশ্লেষণ তাদের খাদ্যের যোগান দেয়। কাজেই তাদের জন্য বিষয়টা যৌক্তিক। কিন্তু মথ বা ড্রাগন ফ্লাইয়ের দেহে তো সালোকসংশ্লেষণ ঘটে না। তাহলে? এই ব্যাখ্যা সে ক্ষেত্রে আর যৌক্তিক ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে না।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাখ্যা বলে, কৃত্রিম আলোকে এসব কীটপতঙ্গ চাঁদ বা সূর্যের মতো প্রাকৃতিক উৎসের আলো বলে ভুল করে এবং সে অনুসারে দিক নির্ণয়ের চেষ্টা করে। সে জন্যই এসব পোকা ছুটে আসে আলোর দিকে। প্রশ্ন আসে, সে ক্ষেত্রে তাদের আচরণ অমন এলোমেলো হয়ে যায় কেন?

অনেক বিজ্ঞানী বলেন, এসব আলোর রশ্মি হয়তো পোকাদের কাছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাধাহীন, মুক্ত পথ বলে মনে হয়। সে জন্যই তারা ওই পথ ধরে ছোটে। অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যেতে চায় না।

আরেকটি ব্যাখ্যা বলে, কিছু ফুল সামান্য অতিবেগুনি রশ্মি নিঃসরণ করে। যেসব বাতি অতিবেগুনি রশ্মি নিঃসরণ করে, বিশেষ করে আগের দিনের ইনক্যানডেসেন্ট বাতি, এগুলোকে ফুল ভেবে বিভ্রান্ত হয় এসব পোকা।

ম আলোকে এসব কীটপতঙ্গ চাঁদ বা সূর্যের মতো প্রাকৃতিক উৎসের আলো বলে ভুল করে
ছবি: সংগৃহীত
গবেষকরা এসব কীটপতঙ্গের এ ধরনের নড়াচড়া বিশ্লেষণ করে দাবি করেছেন, পোকামাকড় কৃত্রিম আলো দেখেও মনে করে, এগুলো আকাশ থেকে আসছে অন্ধকারের মধ্যে।

এসব ব্যাখ্যার কোনোটিই আলাদাভাবে ঠিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় সাম্প্রতিক একটি গবেষণা থেকে। যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক এই গবেষণাটি করেছেন। এ জন্য তাঁরা হাই-রেজুল্যুশনের মোশন ক্যাপচার ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন। তারপর ত্রিমাত্রিক কাইনেমাটিকস ব্যবহার করে মূল ঘটনার ত্রিমাত্রিক সিমুলেশন তৈরি করে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু মূল ঘটনাটি কী ছিল?

একটি শেডের ওপর থেকে অন্ধকারে আলোর ব্যবস্থা করেছেন তাঁরা। দেখা গেছে, পোকার দল সেই আলোকরশ্মির দিকে ছুটে এসেছে এবং ওপরে-নিচে আসা-যাওয়া করছে বারবার।

এই গবেষকরা এসব কীটপতঙ্গের এ ধরনের নড়াচড়া বিশ্লেষণ করে দাবি করেছেন, পোকামাকড় কৃত্রিম আলো দেখেও মনে করে, এগুলো আকাশ থেকে আসছে অন্ধকারের মধ্যে। অর্থাৎ তারা ভাবে, প্রাকৃতিক কোনো উৎস থেকেই এসেছে এ আলো। সে অনুযায়ী তারা আলোকরশ্মি অনুসারে নিজেদের বিন্যস্ত করতে চায় এবং ওই পথ ধরে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু অনেক পোকা ছোট্ট একটি আলোর উৎসের দিকে ছুটে যেতে গিয়ে তাদের ছোটার পথ এলোমেলো হয়ে যায়। সে জন্যই দেখা যায় অমন ঘোরগ্রস্থ, এলোমেলো আচরণ। কিন্তু ঠিক কেন এলোমেলো হয়ে যায়?

গবেষক দলের দাবি, সূর্যের আলো দেখে এসব কীট যেভাবে দিক নির্ণয় করে (এ সময় তারা নিজেদের পিঠ ফিরিয়ে রাখে সূর্যের দিকে), কৃত্রিম আলোর ক্ষেত্রে তারা তা করতে পারে না। আলো দেখে দিক নির্ণয়ের অঙ্গাণুগুলো অন্ধকারে কৃত্রিম আলোর প্রতি সঠিকভাবে সাড়া দিতে পারে না। সে জন্যই তারা অমন এলোমেলো, দিশেহারা আচরণ করে।

নিরাপদে পথ চলাচলের জন্য বাতি আমাদের প্রয়োজন অবশ্যই। তবে অন্তত পরিবেশবান্ধব এলইডি বাতির ব্যবস্থা করা যেতে পারে সে ক্ষেত্রে। তা ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাতির ব্যবহারও কমানো প্রয়োজন।

তবে এলইডি (লাইট এমিডিং ডায়োড) বাতি অনেক পরিবেশবান্ধব। এগুলো কীটপতঙ্গদের খুব একটা সমস্যায় ফেলে না। সে তুলনায় পুরোনো ইনক্যানডেসেন্ট বাতি অনেক বেশি সমস্যা করে এসব কীটদের। তাই অনেকে ধারণা করছেন, বাতিকে ফুল ভেবে ভুল করুক না করুক, আলো দেখে আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে অতিবেগুনি নিঃসরণ হয়তো কিছুটা ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ এতদিনের ধারণাগুলো কোনো একটি আলাদাভাবে এসব কীটের আচরণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও, সবগুলো মিলিয়ে বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে আসে।

তাঁদের এই গবেষণা অবশ্য এখনো প্রি-প্রিন্ট পর্যায়ে রয়েছে, আছে পিয়ার-রিভিউয়ের অপেক্ষায়। পিয়ার রিভিউ হলেই কেবল নিশ্চিতভাবে জানা যাবে, এই ব্যাখ্যা ঠিক আছে কি না।

তবে একটা কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা প্রয়োজন আমাদের। তাঁদের এ ব্যাখ্যা ঠিক থাকুক না থাকুক, ইনক্যানডেসেন্ট বাতির (এখনো যা অনেক রাস্তায়ই দেখা যায়, স্ট্রিট ল্যাম্পে) মতো কৃত্রিম আলো যে শুধু পোকাদেরই ক্ষতি করে, তা নয়। শহরের পথে পথে এত বাতি আলোকদূষণও ঘটায় প্রচুর। যে কারণে শহর থেকে রাতের আকাশ দেখা যায় না।

নিরাপদে পথ চলাচলের জন্য বাতি আমাদের প্রয়োজন অবশ্যই। তবে অন্তত পরিবেশবান্ধব এলইডি বাতির ব্যবস্থা করা যেতে পারে সে ক্ষেত্রে। তা ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাতির ব্যবহারও কমানো প্রয়োজন। এই পোকারা আমাদের যত বিরক্তই করুক, তারা আমাদের বন্ধু। আপনি যে শহরে এখন আর এত পোকা দেখেন না, এর কারণ, আমাদের এই বন্ধুরা মারা যাচ্ছে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। এর মাশুল একসময় আমাদেরই দিতে হবে। আর, সেটা না চাইলে সচেতন হতে হবে এখনি।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, ইন্ডিয়া টুডে, উইকিপিডিয়া, ওয়ান্ডারোপোলিস