বন্যপ্রাণীদের বন্ধু ছাতারে

এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…

ছবি: উইকিপিডিয়া

বেতঝোপের ভেতরে খেলছে তিনটি খরগোশের বাচ্চা। বয়স ওদের কম। শরীরে রং ফোটেনি। হাবাগোবা চেহারা। মিষ্টি-মিষ্টি চাহনি। খেলছে জড়াজড়ি করে। লম্বা লম্বা কান মাঝে-মাঝে খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করছে—আশপাশে কোনো বিপদ আছে কি না।

ওদের মা-বাবা একটু ওপাশে উপুড় হয়ে শুয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। খেলতে খেলতে বাচ্চা তিনটি ঝোপের বাইরে চলে এলো। সামনেই খোলা মাঠ। মাঠভরা সর্ষে ফুল। রোদ পড়ে হলুদ ফুলগুলো যেন জ্বলছে।

ছয়টি পাখি চরছে মাটিতে। সর্ষেক্ষেতের কিনারে। ওরা এগোচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ওগুলোকে দেখে খরগোশের বাচ্চা তিনটি ভয় পেল না। পাখিগুলোও এগিয়ে আসছে বাচ্চা তিনটির দিকে। যেন একসঙ্গে খেলবে।

আচমকা একটি পাখি কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাঁচটিও যোগ দিল। সে কী চেঁচামেচি! তারপর উড়ল খরগোশের বাচ্চা তিনটির মাথার ওপর দিয়ে। বসল গিয়ে চালতা গাছের ডালে। খরগোশের বাচ্চা তিনটি সাঁই করে ঘুরেই ছুটল বেতঝাড়ের দিকে। সর্ষেক্ষেতের ভেতর থেকে যেন উড়ে এলো একটি বনবিড়াল (Jungle Cat)। অল্পের জন্য মিস করল শিকার। শিকার মিস করেও সে ছুটল খরগোসের বাচ্চা তিনটির দিকে। ছোটা না বলে লাফ দেওয়া বলাই ভালো। খরগোশ মা-বাবাও ততক্ষণে ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে লাফিয়ে পালাচ্ছে। পেছনে বনবিড়াল। চেঁচিয়ে বাগান মাত করছে পাখি ছয়টি। বাচ্চা তিনটিও ছুটছে প্রাণপণে।

ছবি: উইকিপিডিয়া

এই যে সতর্ক সঙ্কেত দেওয়া, যে সঙ্কেত ওই পাখিরা যেমন দিতে পারে, বাংলাদেশের খুব কম পাখিই তা পারে। ওরা শুধু গ্রামের বন-বাগানেই সতর্ক সঙ্কেত দেয় না, সুন্দরবনেও ওরা এভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হামলার কবল থেকে বাঁচিয়ে দেয় হরিণ বা শূকরদের। সিলেট- চট্টগ্রামের জঙ্গলেও চিতাবাঘ, গেছোবাঘের হামলা থেকে বাঁচিয়ে দেয় নিরীহ প্রাণীদের। গুটি মেরে যখন শিকারের দিকে এগোচ্ছে বাঘ-চিতাবাঘ বা বনবিড়াল, তখনই সতর্ক সঙ্কেত দেয়। বাঘ-চিতাবাঘ আর বনবিড়ালের মেজাজ যায় খিঁচড়ে।

নিরীহ পাখি ও বন্যপ্রাণীদের বন্ধু এই পাখিটির নাম ছাতারে। সাতভাইও বলা হয়। ইংরেজরা বলে 'সেভেন সিস্টার' বা 'সাতবোন' পাখি। এই নামের পেছনে যুক্তি আছে। এরা ছোট ছোট দলে থাকে। প্রতি দলে ৫ থেকে ৭টি পাখি থাকে। প্রায় সময়েই চেঁচায় বা ডাকাডাকি করে। মনে হয় নিজেদের ভেতর ঝগড়া-ফ্যাসাদ করছে। আসলে তা নয়।

ছাতারে (Jungle Babler) বাংলাদেশের সব গ্রামেই আছে। ভালো অবস্থায় আছে। ওদের খাবারের অভাব যেমন নেই, তেমনি নেই বাসা বাঁধার জায়গার অভাব। মাটিতে নেমে ওরা ঝোপ-জঙ্গল ঠেলে ও শুকনো পাতা উল্টে খাবার সংগ্রহ করে। এতে বন-বাগানের মাটির যেমন উপকার হয়, তেমনি গাছপালার স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। ক্ষতিকর পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ খেয়ে ওরা পরিবেশকে ভালো রাখে। ছাতারেরা তাই উপকারী পাখি। প্রকৃতির বন্ধু।

সারা দুনিয়ায় ছাতারে আছে ত্রিশ রকমের। বাংলাদেশে আছে সাত রকম। সবারই স্বভাব-চরিত্র, খাদ্য ও বাসা প্রায় একই রকম।

ছবি: উইকিপিডিয়া

ছাতারে লম্বায় হয় ২৯ সেন্টিমিটার। চওড়া ধরনের লম্বাটে লেজ। চওড়া পাখা। তবুও ওরা এক নাগাড়ে বেশিক্ষণ উড়তে পারে না। বেশি উঁচুতেও ওঠে না। তবে একটু দূরে যখন উড়ে যায়, তখন ডানা থাকে স্থির। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। তাই বলে ছাতারেদের সুন্দর পাখি বলা যাবে না। ছেলে ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। মেটে-বাদামি শরীরের রং।

চোখের মনি লাল। পা, ঠোঁট ও তলপেট হালকা হলুদাভ। গলার স্বর কর্কশ। গলায় জোর আছে বেশ।

কোনো গাছে কলা, পেঁপে বা আম পাকলে ছাতারেরা আগে খবর পেয়ে যায়। নানান রকম ফল যেমন ওরা খায়, তেমনি খায় পোকামাকড় ও কেঁচো। মাছও খায়। ধান ও ভাত খেতে ওরা গ্রামের বাড়ির উঠোনেও চলে আসে। সুযোগ পেলে ঘর ও রান্নাঘরেও ঢুকে পড়ে। বর্ষাকালে উঠোন বাড়িতে বেশি আসে। বাল্য-কৈশোরে আমি বহুবার মুরগি ঢাকা খাঁচার ফাঁদ পেতে ছাতারে আটকেছি। আটকা পড়লে ওরা কিন্তু একটুও ডাকাডাকি করে না। নার্ভাস হয়ে পড়ে। ভয়ে চোখ যায় ঘোলাটে হয়ে।

ওরা বাসা করে ঝোপঝাড় ও গাছের ডালে। বেশ বড়সড় গোলগাল বাটির মতো বাসা। দুজনে মিলে জায়গা নির্বাচনে ব্যয় করে ২-৩ দিন। দুজনে মিলেই বাসা বাঁধা শেষ করে ৪-৮ দিনে। 

ডিম পাড়ে ২-৪টা। তবে প্রায় সময়েই হয় ৩টা ডিম। ডিমের রং নীল। ওই ডিমের সঙ্গে মিল আছে কোকিল, পাপিয়া ও বউ কথা কও পাখির ডিমের। ওই সব পাখিরা তাই সুযোগ পেলেই ছাতারের বাসায় গোপনে ডিম পাড়ে। ছাতারেরা ওই ডিমে তা দেয়, বাচ্চা ফোটায়।

ছাতারেরা ডিমে তা দেয় পালা করে। ১৩-১৫ দিনে বাচ্চা ফোটে। বাবা-মা খাওয়ায়, চাচা-ফুফু-খালা-খালুরাও খাওয়ায়। অর্থাৎ দলের বড়রা ছোটদের খাওয়ায়, সমান ভালোবাসে। আবার সময় সুযোগ মিললে একজনের ডিমে অন্যরাও তা দেয়। বাচ্চারা উড়তে পারে ১৭/১৮ দিনে।

ছাতারেরা নিরীহ ও ভদ্রগোছের পাখি। পোষ মানে। পাশাপাশি প্রয়োজনে দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে। ঢাকা শহরের শিশু-কিশোরেরা ইচ্ছে করলে ঢাকা শহরের পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিড়িয়াখানা এলাকায় গিয়ে ছাতারেদের কর্মকাণ্ড দেখে আসতে যেমন পারে, তেমনি পারে ওদের কর্কশ ডাক শুনতে। দেখতে পারে ওদের ওড়ার চমৎকার কৌশলটা।

লেখক: প্রকৃতিবিদ ও পাখিবিশারদ

* লেখকের বাংলাদেশের পাখি (৩য় খণ্ড), শিশু একাডেমি (২০০৮) থেকে নেওয়া