বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ১০ প্রাণী

প্রকৃতির অফুরন্ত বিস্ময় আমাদের মুগ্ধ করে। এরকম এক অভূতপূর্ব বিস্ময় হলো কিছু প্রাণীর অসাধারণ শক্তি ও ক্ষমতা। অনেক প্রাণীর শক্তি, সাহস এবং ক্ষমতা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। শারীরিক গঠন, অসাধারণ দক্ষতা এবং প্রকৃতিতে টিকে থাকার অদম্য ইচ্ছা এদের কোনো কোনোটিকে অনন্য করে তুলেছে। এরকম উল্লেখযোগ্য শক্তিশালী ১০টি প্রাণীর জানা-অজানা বিভিন্ন দিক নিয়ে এ আয়োজন।

১০

হারপি ঈগল

নারী হারপি ঈগল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী শিকারী পাখি হিসেবে পরিচিত। পুরুষের তুলনায় স্ত্রী হারপি ঈগল অনেক বেশি শক্তিশালী। ১৮ কেজি পর্যন্ত ওজন বহন করতে পারে এরা, যা এর নিজের ওজনের প্রায় দ্বিগুণ। হারপি ঈগল ৩৬ থেকে ৪০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পুরুষ ঈগলের ওজন ৯ থেকে ১৫ পাউন্ড, আর স্ত্রী ঈগলের ওজন হতে পারে ১৩ থেকে ২০ পাউন্ডের মতো। এরা শিকার ধরতে গায়ের রং, শক্তিশালী থাবা, দ্রুতগতি এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। হারপি ঈগল মেক্সিকো থেকে শুরু করে উত্তর আর্জেন্টিনা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বাস করে। হারপি ঈগলের বৈজ্ঞানিক নাম হারপিয়া হারপিয়া (Harpia harpyja)। এটি অ্যাক্সিপিট্রিডি পরিবারের সদস্য। অন্যান্য শিকারী পাখিও এ পরিবারের সদস্য। যেমন বাজপাখি।

চিতাবাঘ

পুরুষ চিতার ওজন ৩০ থেকে ৭০ কেজির মধ্যে হয়। সবচেয়ে বড় চিতা তাদের শক্তিশালী চোয়ালের পেশী, শক্তিশালী পা এবং নখর ব্যবহার করে ১২৫ কেজি ওজনের শিকার ধরে গাছে তুলে ফেলতে পারে। হ্যাঁ, সত্যিই চিতা প্রায়ই ছোট-বড় শিকার টেনে গাছে তুলে ফেলে, যাতে প্রতিদ্বন্দ্বীরা—যেমন সিংহ বা হায়েনা—শিকার ছিনিয়ে নিতে না পারে।

চিতার বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থেরা পার্ডাস (Panthera pardus)। প্যানথেরা গণের পাঁচটি প্রজাতির একটি এই চিতা। চিতার দেহ সরু, পেশীবহুল। দৈর্ঘ্য ৩৬ থেকে ৭২ ইঞ্চি। আর লেজের দৈর্ঘ্য ২৬ থেকে ৪০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। চিতা জোরে ছোটার সময় ভারসাম্য রক্ষার জন্য লেজ ব্যবহার করে। এই লেজ দিকনির্ধারণী যন্ত্রের মতো কাজ করে—দ্রুত গতিতে দিক পরিবর্তন করতে ও বাঁক নিতে সাহায্য করে।

মেরু ভালুক

প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মেরু ভালুক ৩০০ থেকে ৭০০ কেজি ওজনের হতে পারে। আর স্ত্রী মেরু ভালুক সাধারণত ১৫০ থেকে ৩৫০ কেজি ওজনের হয়। মেরু ভালুক আর্কটিক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ভালুক প্রজাতি। এরা নিজেদের দেহের ওজনের প্রায় ০.৭ গুণ ওজন তুলতে পারে। মানে ৪৫০ কেজি ওজনের একটি পুরুষ মেরু ভালুক প্রায় ৩১৫ কেজি ওজনের শিকার টেনে নিতে পারে নিমেষে। শক্তিশালী চোয়াল ও পেশী ব্যবহার করে এরা সীল, বেলুগা হোয়েল এবং অন্যান্য বড় প্রাণী শিকার করে। 

মেরু ভালুকের বৈজ্ঞানিক নাম উরসাস মেরিটিমাস (Ursus maritimus)।

সিংহ

বনরাজ সিংহ শক্তি, সাহস এবং নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। পুরুষ সিংহের ওজন ১৫০ থেকে ২৫০ কেজি এবং উচ্চতা ১.২ থেকে ১.৪ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। শক্তিশালী পায়ের পেশীর কারণে দ্রুত দৌড়াতে পারে এরা। বিশাল থাবা ও চোয়ালের জন্য বড় শিকারও ধরতে পারে সহজে। তীক্ষ্ণ দাঁত এবং বাঁকানো নখ এদের শিকার ধরে টেনে নিতে সাহায্য করে। আর গর্জন করে এরা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখায় ও নিজেদের এলাকা চিহ্নিত করে দেয়। একটি আফ্রিকান সিংহের কামড়ের শক্তি প্রায় ৬৫০ থেকে ১ হাজার পিএসআই (পাউন্ড/বর্গ ইঞ্চি)। এটা কত বেশি, তা বুঝতে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটা গাড়ির টায়ারের চাপ ৩০-৩৫ পিএসআই হতে পারে। 

সিংহের বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থেরা লিও (Panthera leo)। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকভাবে এরা প্যানথেরা বা বিড়াল প্রজাতির সদস্য। মূলত আফ্রিকা ও ভারতে এদের দেখা যায়।  

গ্রিজলি বিয়ার

পায়ের শক্তি ও পেশীবহুল শরীরের সংমিশ্রণের জন্য গ্রিজলি বিয়ার বা ভালুকেরা হলো আদর্শ শিকারী। অত্যন্ত বুদ্ধিমান। গ্রিজলি ভালুক ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টি এবং স্পর্শের অনুভূতি ব্যবহার করে ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চল নিজেদের আওতায় রাখে। অর্থাৎ এ অঞ্চলে অন্য কোনো গ্রিজলি ভালুক বা প্রাণীকে এরা সহজে শিকার করতে দেয় না। একটি পূর্ণবয়স্ক গ্রিজলি ভালুক মাত্র একটি থাবা দিয়ে ২২৭ কেজি ওজন তুলতে পারে, যা প্রায় পাঁচজন শক্তিশালী মানুষের সম্মিলিত শক্তির সমান। অসাধারণ শক্তি, তীক্ষ্ণ দাঁত ও দীর্ঘ, শক্তিশালী নখ তাদের প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারীদের অন্যতম করে তুলেছে। গ্রিজলি ভালুকের চোয়ালের কামড়ের শক্তি প্রায় ১ হাজার ১৬০ পিএসআই পর্যন্ত হতে পারে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার

বাংলার বাঘ—রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সিংহের চেয়ে বেশি চটপটে এবং দ্রুতগামী এ প্রাণী নিজের আকারের দ্বিগুণ ওজনের শিকার ধরতে সক্ষম। পেশীবহুল পায়ের জন্য ঘণ্টায় ৬৫ কিমি বেগে দৌড়াতে পারে। ওজন হতে পারে ৩০৬ কেজি বা ৬৭৫ পাউন্ড পর্যন্ত। বাঘের থাবা এত শক্তিশালী যে একজন মানুষ বা কোনো প্রাণীকে তাৎক্ষণিকভাবে মেরে ফেলতে পারবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কামড়ের শক্তি প্রায় ১ হাজার ৫০ পিএসআই। 

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থেরা টাইগ্রিস (Panthera tigris)। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঘের উপপ্রজাতি।

মাস্ক অক্স

মাস্ক অক্স বা ষাঁড় আর্কটিক অঞ্চলের স্তন্যপায়ী প্রাণী। শক্তিশালী পেশী এবং মোটা, লম্বা পা এদের ভারী বস্তু বহন করতে এবং উঁচু, খাড়া এলাকায় চলাফেরা করতে সাহায্য করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক মাস্ক অক্স ১৮০ থেকে ৪১০ কেজি ওজনের হতে পারে। শিকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় এরা মাথা নিচু করে আক্রমণাত্মক অবস্থানে দাঁড়াতে পছন্দ করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক মাস্ক অক্স নিজ দেহের ওজনের প্রায় ১.৫ গুণ, অর্থাৎ ৯০০ কেজি পর্যন্ত তুলতে পারে।

নর্দান হোয়াইট রাইনো

নর্দান হোয়াইট রাইনো বা উত্তুরে সাদা গণ্ডার তৃণভোজী প্রাণী হিসেবে পরিচিত হলেও, এদের শান্ত চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে বিপুল শক্তি। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ গণ্ডারের ওজন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে, যা একটি গড়পড়তা গাড়ির চেয়েও বেশি। একটি সাদা গণ্ডার কত শক্তিশালী, তা পরিমাপ করা কঠিন। তবে অনুমান করা হয়, এরা ৮০০ থেকে ১ হাজার ১০০ কেজি পর্যন্ত ওজন টেনে নিতে পারে। গণ্ডার অবশ্য এ শক্তি ব্যবহার করে আত্মরক্ষার্থে, নিজ এলাকা রক্ষা এবং জঙ্গলে পথ তৈরি করার জন্য। বর্তমানে পৃথিবীতে মাত্র দুটি নর্দান হোয়াইট রাইনো টিকে আছে। এরা প্রজাতির শেষ দুই নারী সদস্য—নাজিন ও ফাতু। এরা কেনিয়ার একটি সংরক্ষিত এলাকায় বাস করে। 

সাদা গণ্ডারের বৈজ্ঞানিক নাম সেরাতোথেরিয়াম সিমাম (Ceratotherium simum)।

গরিলা

গরিলা অত্যন্ত শক্তিশালী প্রাণী। ক্রমাগত শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে এরা নিজেদের শক্তি বজায় রাখে। এদের বিশাল পেশী গাছ থেকে গাছে ঝুলতে ও নিজেদের এলাকা রক্ষা করতে সাহায্য করে। এভাবে নিজেদের শারীরিক গঠন যথাযথভাবে ধরে রাখে গরিলা। পুরুষ গরিলা স্ত্রী গরিলার তুলনায় আকারে বড় হয় এবং পূর্ণ বয়স্ক হলে ২০০ কেজি পর্যন্ত ওজন তুলতে পারে। গরিলা মূলত উদ্ভিদভোজী প্রাণী। তবে এদের কামড়ের শক্তি অনেক বেশি—১ হাজার ৩০০ পিএসআই পর্যন্ত হতে পারে। এত প্রচণ্ড শক্তির কারণ এদের বিশাল চোয়ালের পেশী এবং শক্তিশালী দাঁত। 

আফ্রিকান বুশ হাতি

বিশ্বের বৃহত্তম স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী আফ্রিকান বুশ হাতি প্রোবোসিডিয়ান বর্গের সদস্য। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ আফ্রিকান হাতির উচ্চতা ৩.২ থেকে ৪.০ মিটার বা ১০.৫ থেকে ১৩ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত আফ্রিকান হাতির ওজন ৪ হাজার ৭০০ থেকে ৬ হাজার ৪৮ কেজির মতো হয়। এ হাতির শুঁড়ে থাকে ৪০ হাজারেরও বেশি পেশী। এই শুঁড় দিয়ে আফ্রিকান বুশ হাতি ২০০ কেজি পর্যন্ত তুলতে পারে। আফ্রিকান বুশ হাতির এ শক্তি বনের অন্যান্য প্রাণীরা ভয় পায়, আশপাশে ঘেঁষতে চায় না।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস, উইকিপিডিয়া