মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের দখলে মানব মস্তিষ্ক

পৃথিবীজুড়ে এক আতঙ্কের নাম প্লাস্টিক দূষণ

মস্তিষ্কেও প্লাস্টিক! অসম্ভব! শিরোনাম দেখে এ কথা মনে আসাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। আমাদের মস্তিষ্কেও প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। কীভাবে আমাদের অজান্তেই মস্তিষ্কে বাসা বাধছে এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক?

পৃথিবীজুড়ে এক আতঙ্কের নাম প্লাস্টিক দূষণ। মাটিতে, বায়ুতে, নদীতে এমনকি সমুদ্রের তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এটি। কিন্তু প্লাস্টিক কেন এত ক্ষতিকর? কারণ এটা মাটির সঙ্গে মেশে না। মানে নন-বায়োডেগ্রিডেবল বা অপচনশীল বস্তু। মাটি ও পানি—এই দুই স্থানেই আছে প্লাস্টিকের রাজত্ব। বাকি ছিল বাতাস। এখন সেখানেও রাজত্ব শুরু করছে প্লাস্টিক। এরা আকারে খুবই ছোট, ধূলিকণার মতো। এত ছোট বলেই এদের নাম মাইক্রোপ্লাস্টিক। প্লাস্টিক পণ্য তৈরি ও রিসাইকেল করার সময় তৈরি হয় এই অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা। এরপর তা ভেসে বেড়ায় বাতাসে।

প্লাস্টিক মূলত ৪ ধরনের। ন্যানোপ্লাস্টিক, মাইক্রোপ্লাস্টিক, মেসোপ্লাস্টিক, ও ম্যাক্রোপ্লাস্টিক। ন্যানোপ্লাস্টিককে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক বলা হয়। এর আকার ১-১০০০ ন্যানোমিটার। ক্ষুদ্র বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ১-১০০০ মাইক্রোমিটার। মাঝারি আকারের প্লাস্টিক কণা বা মেসোপ্লাস্টিকের আকার ১-১০ মিলিমিটার এবং বড় প্লাস্টিক কণা বা ম্যাক্রোপ্লাস্টিক ১ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় হয়। এসব প্লাস্টিক কণা মাটিতে বা পরিবেশে টিকে থাকতে পারে ২৫০-৪০০ বছরেরও বেশি।

প্রাথমিকভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রধান উৎস ৭টি। সিন্থেটিক টেক্সটাইল, টায়ার, সামুদ্রিক/মেরিন কোটিং, রোড মার্কিং, প্রাইভেট কেয়ারিং পণ্য, প্লাস্টিক বড়ি (পিলেট), এবং সিটি ডাস্ট। এর মধ্যে টেক্সটাইল, টায়ার এবং সিটি ডাস্ট—এই ৩টি উৎসই শতকরা ৮০ শতাংশ দূষণের জন্য দায়ী। সামুদ্রিক দূষণের শতকরা ৩৫ ভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক আসে টেক্সটাইল ও পোশাক থেকে।

আরও পড়ুন
মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিক কণাগুলোর বেশিরভাগই আমাদের চোখে প্রায় অদৃশ্য। এগুলোর উৎস আমাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলোই। সকালে টুথপেস্ট থেকে শুরু করে ফেসওয়াশ, স্ক্রাব, বডিওয়াশ, নেইল পোলিশ, প্রসাধনী সামগ্রী, এমনকি ডিটারজেন্ট পাউডারেও রয়েছে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিক।
মাইক্রো বা ন্যানো প্লাস্টিক বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে অনায়াসে

মাইক্রোপ্লাস্টিক কীভাবে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তার আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দেখে নেয়া যাক। ঢাকার স্থানীয় বাজারের চিনি এবং টি-ব্যাগের ওপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দুটি পৃথক গবেষণা করেন। সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উদ্বেগজনক মাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এ গবেষণা অনুযায়ী, চিনি এবং টি-ব্যাগের মাধ্যমে বাংলাদেশে বছরে গড়ে ১০.২ টন মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করছে ১৭ কোটি মানুষের দেহে। এখন ঢাকার বাতাসেও মিলছে বিষাক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক। এ তো গেল শুধু বাংলাদেশের পরিসংখ্যান। এবার একটু বৈশ্বিক পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যাক। বর্তমানে বার্ষিক প্লাস্টিক উৎপাদন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টনেরও বেশি। ২০২৩ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের মহাসাগরগুলোতে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন টন মাইক্রো প্লাস্টিক ভাসছে, যা ২০০৫ সালের তুলনায় প্রায় দশগুণেরও বেশি।

এখন প্রশ্ন হলো, এই বিষাক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক কী করে ঢুকছে মানবদেহে? মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিক কণাগুলোর বেশিরভাগই আমাদের চোখে প্রায় অদৃশ্য। এগুলোর উৎস আমাদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলোই। সকালে টুথপেস্ট থেকে শুরু করে ফেসওয়াশ, স্ক্রাব, বডিওয়াশ, নেইল পোলিশ, প্রসাধনী সামগ্রী, এমনকি ডিটারজেন্ট পাউডারেও রয়েছে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিক। আবার সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্যগুলোও সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির সহায়তায় ভেঙে মাইক্রো-ন্যানো প্লাস্টিকে পরিণত হয়। তারপর খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে ঢুকে যায় মানবদেহে।

আগেই বলেছি, এসব মাইক্রো বা ন্যানো প্লাস্টিক বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে অনায়াসে। বাইরের বাতাসের তুলনায় ঘরের ভেতরের বাতাসে এসব প্লাস্টিকের কণা বেশি থাকে। কারণ, আমাদের পোশাক, আসবাবপত্র এবং প্লাস্টিকজাত পণ্যগুলো থেকে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণাগুলো ঝরে পড়ে। পরে এখান থেকেই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মাইক্রো-ন্যানো কণাগুলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে গিয়ে জমা হয়। মোট কথা, বিভিন্ন উপায়ে এই ক্ষুদ্র কণাগুলো মানবদেহে প্রবেশ করছে। এটা সত্যিই আশঙ্কাজনক।

আরও পড়ুন
প্লাস্টিক মূলত ৪ ধরনের। ন্যানোপ্লাস্টিক, মাইক্রোপ্লাস্টিক, মেসোপ্লাস্টিক, ও ম্যাক্রোপ্লাস্টিক। ন্যানোপ্লাস্টিককে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক বলা হয়। এর আকার ১-১০০০ ন্যানোমিটার। ক্ষুদ্র বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ১-১০০০ মাইক্রোমিটার।
মানুষের মস্তিষ্কের টিস্যুতে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি বেড়েছে
ছবি: রয়টার্স

বিগত কয়েক বছরে মানবদেহের বৃক্ক, যকৃৎ, রক্ত এমনকি মলেও এসব মাইক্রো-ন্যানো প্লাস্টিক শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, সম্প্রতি মানবমস্তিষ্কেও এর আশঙ্কাজনক উপস্থিতি নির্ণয় করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ৩ ফেব্রুয়ারি, সোমবার বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল নেচার মেডিসিন-এ এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, যেসব মস্তিষ্কের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাতে গড়ে ৭ গ্রাম করে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছিল। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে মারা গেছে এমন ২৪ জন মৃত মানুষের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পাশাপাশি ২০১৬ সালে ২৮ জন মৃত মানুষের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখা হয়। এই দুই পরীক্ষা থেকে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেন, এক দশকের কম সময়ের মধ্যেই মানবমস্তিস্কে এসব কণার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ, আমাদের মস্তিষ্কের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিকের দখলে।

বড় মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো

অন্যদিকে, মৃত্যুর আগে ডিমেনশিয়া রোগ ধরা পড়েছে এমন ১২ জন মানুষের মস্তিষ্কও পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের মস্তিষ্কে সঞ্চিত প্লাস্টিকের মাত্রা স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় ৫ গুণ বেশি! নেচারসহ আরও কিছু আন্তর্জাতিক জার্নালের গবেষণাপত্রগুলোতে উঠে এসেছে, মাইক্রো-ন্যানো প্লাস্টিক কণাগুলোর সঙ্গে নিউরো-ডিজেনারেটিভ রোগের সূক্ষ্ম সম্পর্ক থাকতে পারে।

আমাদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল। মস্তিষ্কের ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ারের (BBB) কার্যপ্রণালি অনেকটা আমাদের ব্যবহৃত ওয়াটার ফিল্টারগুলোর মতোই। ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার একধরণের অর্ধভেদ্য ঝিল্লি, যা রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান মস্তিষ্কে প্রবেশে বাধা দেয়। আগে মনে করা হতো, সবচেয়ে ছোট ন্যানো প্লাস্টিক কণাগুলো এই ব্যারিয়ার অতিক্রম করতে পারে না। কিন্তু ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বড় মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলোও এই দেয়াল অতিক্রম করে মস্তিষ্কে পৌঁছে যেতে পারে খুব সহজেই! অবশ্য এর কিছু কারণ রয়েছে। প্লাস্টিক পছন্দ করে ফ্যাট। আমরা খাবারের মাধ্যমে যে ফ্যাট গ্রহণ করি, সেগুলোর সঙ্গে মাইক্রো-ন্যানো প্লাস্টিক দেহে প্রবেশ করে। তারপর তা মস্তিষ্কসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যায়।

আরও পড়ুন
মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে কি না, তা নির্ধারণ করা কঠিন। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সঙ্গে প্রদাহজনিত লিভারের রোগ, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো সমস্যার সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
প্লাস্টিক বর্জ্য
ছবি: রয়টার্স

মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় ৬০ শতাংশ ফ্যাট, যা অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি। ওমেগা ৩-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো মস্তিষ্কের কোষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানব শরীর যেহেতু নিজের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করতে পারে না, তাই এগুলো খাবারের মতো বাহ্যিক উপাদান থেকে শরীর গ্রহণ করে। আবার নাকের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বাতাসে থাকা মাইক্রো-ন্যানো কণাগুলো আমাদের মস্তিষ্কের অলফ্যাক্টরি বাল্বে গিয়ে পৌঁছায়। অলফ্যাক্টরি বাল্ব গন্ধ বা ঘ্রাণ প্রসেসিং করে। নাকের অলফ্যাক্টরি বাল্বের পথ ধরে এই ক্ষুদ্র কণাগুলো সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।

মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে কি না, তা নির্ধারণ করা কঠিন। মাইক্রোপ্লাস্টিকের সঙ্গে প্রদাহজনিত লিভারের রোগ, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের মতো সমস্যার সঙ্গে সম্ভাব্য সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তবে এগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিকই সৃষ্টি করে কি না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর মেডিসিন ও সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী গবেষণা অধ্যাপক সুঝাও লি গবেষণায় দেখিওয়েছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিককে শরীর অপরিচিত কণা হিসেবে ধরে নিয়ে আক্রমণ করে। ফলে প্রদাহ দেখা যায়। তিনি বলেছেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিজ্ঞান এত নতুন যে, আমরা এখনো এর তেমন কিছু জানি না’।

ইংরেজ উদ্ভাবক আলেকজান্ডার পার্ক্সের হাত ধরে ১৮৫০ সালে প্রথমবার উদ্ভাবিত হয় প্লাস্টিক। সেটাই আজ বৈশ্বিক দুশ্চিন্তার কারণ। অবশ্য উদ্ভাবনের প্রথমদিকে প্লাস্টিকের নাম ছিল পার্কজাইন। উদ্ভাবনের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৩০ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদন করেছে মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৬৩০ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক পরিণত হয়েছে আবর্জনায়। মাত্র ৯ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়েছে আর ১২ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর বাকি প্রায় ৭৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে রয়ে গেছে। প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিকের আবর্জনা নদী-নালা, খাল-বিল হয়ে সমুদ্রে জমা হচ্ছে। বলা হয়, এখন পর্যন্ত যত প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্র এবং স্থলভাগে আছে, তার সব যদি এক জায়গায় করা হয়, তবে তা মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও উঁচু হবে!

এই যুগে প্লাস্টিক উৎপাদন নিষিদ্ধ কঠিন, কারণ এটি আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের উচিত বিকল্প উদ্ভাবনের প্রতি নজর দেওয়া। সম্প্রতি পাটজাত প্লাস্টিক ব্যাগ উদ্ভাবিত হয়েছে, এটা পরিবেশবান্ধব। আমাদের উচিত এরকম পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন কাজে লাগানো এবং এর প্রসার নিশ্চিত করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষিবিজ্ঞান বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, নেচার এবং দ্য গার্ডিয়ান

আরও পড়ুন