প্রাণিজগৎ
কালকূট পাখির কাহিনি
এ দেশে কত রকম, কত ধরনের পাখি। রং-বেরঙের এসব পাখি নিয়ে লিখেছেন পাখিবিশারদ ও প্রকৃতিবিদ শরীফ খান…
পাশাপাশি দুটি লম্বাটে বিল। নাম ‘জোড়ার বিল’। ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে দেশ জুড়ে। আগস্ট মাস পর্যন্ত দু-চার ঘর হিন্দু গ্রামে ছিল। রাজাকারদের অত্যাচারে তারাও চলে গেল একদিন। গ্রামের গরু-ছাগলগুলো রাজাকার আর লুটেরা বাহিনী নিয়ে গিয়েছিল মে মাসের মধ্যেই। বহু মোরগ-মুরগি ও তিতির পাখি, রাজহাঁসসহ রয়ে গিয়েছিল গ্রামে। ছিল অনেক পাতিহাঁস। সবই ছিল পোষা। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত টিকে ছিল খুব কম সংখ্যক। শিয়াল, খাটাস আর বনবিড়ালের কবলে পড়ার পরে বেঁচেবর্তে ছিল যেগুলো, সেগুলো বেশ চালাক-চতুর হয়ে গিয়েছিল বলা যায়। পুরোপুরি বুনো হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে পুকুর-জলাশয়ের অভাব ছিল না। ছিল বনবাগান। খাদ্যসঙ্কট তাই ছিল না। পাতিহাঁসগুলো সারাদিন থাকত জোড়ার বিলের পানিতে। রাতে থাকত বিলের মাঝে হোগলা বনের ভেতর। সেই নভেম্বরে শীতের পাখি তথা পরিযায়ী পাখি বরাবরের মতো এসেছিল ওই বিলে, ছিল দেশি জলের পাখি। সরালি, দিঘর, মুরহেন, চখাচখী, বালিহাঁস, মেটেহাঁস, জলপিপি, বড় হালতি, কালিম ও ডুবুরিসহ আরও কত পাখি! শিকারিরা আসে না বিলে। পাখিদের তাই যেন মেলা বসে গিয়েছিল সেবার ওই জোড়ার বিলে। পোষা হাঁসগুলোও ওদের সঙ্গে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছিল।
ওই বিলে সেবার বেশি দেখা গিয়েছিল কালো রঙের একটি পাখি। কুচকুচে কালো ওর ঘাড়-মাথা-গলা ও চিবুক। ঠোঁট চকচকে সাদা। মজবুত মোটা ঠোঁট, শক্ত পাথরের মতো। কপালে বর্ম, সেটাও ঠোঁটের মতো সাদা ও মজবুত। মনে হয়, ওপরের ঠোঁটটা কপালে গিয়ে মিশেছে। ওই কপালের সাদার পাশে কুচকুচে কালোর ভেতরে কুঁচফলের মতো চোখ দুটি দেখতে ভারি সুন্দর! পিঠের রং শ্লেটপাথরের মতো কালচে, বুক-পেট ধূসর কালো। কিন্তু ওরা থাকে হাঁসের মতো জলে ভেসে। তাই এক নজরে কালো বলেই মনে হয়, মনে হয় সরালি হাঁসের চেয়েও বড়। সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে ওদের সাদা ঠোঁট ও কপাল। যখন ওড়ে তখন ডানার প্রান্তের সাদা পালক নজরে পড়ে। পা নীলচে। পায়ের লম্বা লম্বা আঙুলগুলো নীলচে-বাদামি। নখগুলো ধারালো।
১৯৭১ সালের নভেম্বরে ওরা বেশ আরামেই ছিল। গোলাগুলো নেই। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নানা প্রজাতির পাখিতে বিল একেবারে সরব হয়ে উঠল। এ রকম নির্ভয় পরিবেশ ওরা বহুকাল পায়নি।
দু’একটা গুলি করলে প্রচুর পরিমাণে মাংস খাওয়া যাবে। কমাণ্ডারের সিদ্ধান্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা বন্দুকে কার্তুজ পুরে বেশ কাছ থেকে গুলি করল সরালির ঝাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে বিলের সব পাখি বাতাসে ঝড় তুলে উড়াল দিল। কিন্তু অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করল ওই কুচকুচে কালো পাখিগুলো।
ডিসেম্বরের সেদিন ছিল ৭ তারিখ। একদল মুক্তিযোদ্ধা রাতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল জোড়ার বিলের পাশে। তারা যাবে ফকিরহাটের (বাগেরহাট) দিকে। ভোরে পাখির কলকাকলিতে তারা বিস্মিত। জোড়ার বিলের দিকে তাকিয়ে তারা পাখির প্রজাতি ও সংখ্যা দেখে হতবাক। এত পাখি এল কোত্থেকে! ওদের মাঝে আবার পাতিহাঁসের ঝাঁকও দেখা যাচ্ছে! দু’একটা গুলি করলে প্রচুর পরিমাণে মাংস খাওয়া যাবে। কমাণ্ডারের সিদ্ধান্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা বন্দুকে কার্তুজ পুরে বেশ কাছ থেকে গুলি করল সরালির ঝাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে বিলের সব পাখি বাতাসে ঝড় তুলে উড়াল দিল। কিন্তু অভাবনীয় সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করল ওই কুচকুচে কালো পাখিগুলো। ওরা ছিল এক জায়গায়, প্রায় একশটি পাখি। ওরা জলজ উদ্ভিদ-গুল্মের ওপর দিয়ে, শাপলা-পদ্ম পাতার ওপর দিয়ে দ্রুতবেগে দৌড়ে পাড়ি দিল প্রায় ৫০ গজ জায়গা। তারপর ঢুকে পড়ল হোগলাবনে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মনে হলো, ওরা যেন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। গুলির শব্দটাই ছিল দৌড় শুরুর সঙ্কেত। ডানা মেলে লাফানোর ভঙ্গিতে ওরা যেন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নশিপে দৌড় দিয়েছে সবাই। সে এক চোখজুড়ানো দৃশ্য। শাপলা-পদ্মপাতার ওপরে পা ফেলে যে ভঙ্গিতে ওরা দৌড়েছে, পা পড়ছে শরীরের আগে আগে। তাতে ওদের বলতে হয় দৌড়বিদ পাখি। জলের আর কোনো পাখি সম্ভবত এমন চমৎকার ভঙ্গিতে দৌড়াতে পারবে না। পারবে না এদের সঙ্গে জিততে। ওদের সঙ্গে দৌড় লাগিয়েছিল কালিমও। পারেনি। অথচ কালিমের চেয়ে কালো এই পাখিরা ভারি ও মোটাসোটা।
তিনজন মুক্তিযোদ্ধা পাখি কুড়াতে নামল। ৯টি সরালি হাঁস পেল। পাতিহাঁসগুলো দূরে সরে গিয়ে তখনো তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা কালো একটি পাখিকে ঘাপটি মেরে থাকতে দেখে হাত বাড়াল, গুলির রেঞ্জে পড়ে আহত হয়েছে দারুণ। হাত বাড়িয়ে যেই না ধরেছে কালো পাখিটিকে সঙ্গে সঙ্গে ওটি ডাক ছেড়ে কামড়ে ধরল মুক্তিযোদ্ধার ডান হাতের অনামিকা। যেন ছোবল দিল। প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার দিল মুক্তিযোদ্ধা, সরাতে চাইল হাত। পারল না। শক্ত ঠোঁটে পাখিটি কষে চেপে ধরেছে একটি আঙুল। আঙুলটি অবশ, এই বুঝি দুই টুকরো হয়ে যায়। অন্য দুই জন এগিয়ে এল। অনেক টানাটানি করেও তারা ছাড়াতে পারল না আঙুল, বরং আঙুলের চামড়া গেল খসে। তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা গলা চেপে মেরে ফেলল পাখিটিকে। তারপর আঙুল মুক্ত হল। ঠোঁটের চাপে আঙুলের মাংস থেঁতলে গেছে। পাখিটি মরণ কামড় দিয়েছিল। গুলিতে সে আহত হয়েছিল দারুণ, তবু কামড় দিতে ভোলেনি। কম আহত হলে জলের তলা দিয়ে ডুব দিয়ে চলে যেত অনেক দূরে। শুধু সাদা ঠোঁটসহ নাকটি পানির ওপরে জাগিয়ে রেখে শরীর রাখত জলের তলায়। বন্দুকের গুলিতে একখানা পা আহত বা ভেঙে গেলে ডুব দিয়ে জলের তলা দিয়ে এগোতে কষ্ট হয়। তখন উড়াল দেয়। ভালোই উড়তে পারে। ওড়ার সময় আহত বা ভাঙা পা খানার জন্য অসুবিধা হয় বলে ঝুলন্ত পা-খানাকে ঠোঁটের ফাঁকে ধরে ওড়ে। সে এক দারুণ দৃশ্য।
বাসা বাঁধার জন্য এরা পছন্দ করে বড়সড় হাওর-বাওড়ের বা মরা নদীর (যে নদীর ভেতরে জন্মেছে জলজ উদ্ভিদ-গুল্ম শেওলা ও স্রোত নেই) জলজ উদ্ভিদ-গুল্ম বা ঘাসবন। জলের পাশের ঝোপ-ঝাড়ের ওপরে বা মাটিতে বাসা করে। দুই জনে মিলেই বাসা সাজায়। ডিম পাড়ে ৯টি।
সাদা ঠোঁট আর কালো রঙের এই পাখিটির নাম কালকূট। কালকুঁচও বলে। ইংরেজি নাম Common Coot। বৈজ্ঞানিক নাম Fulica atra। শরীরের মাপ ৪০ সেন্টিমিটার। লেজ খুবই ছোট। কালকূট পানির পাখি। নিরিবিলি বিল-ঝিল, জলাশয় ও হাওর-বাওড়ই বেশি পছন্দ। দলবেঁধে থাকে, চরে বেড়ায়। অন্যান্য পানির পাখিদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। ভালো সাঁতার জানে। ডুব দিতেও ওস্তাদ। হাঁসের মতো ডুব দিয়ে উল্টে গিয়ে পানির তলায় খাবারও খুঁজতে পারে, শুধু লেজটাই জেগে থাকে জলের ওপর। বেশ সাহসী, বুদ্ধিমান ও চালাক।
কালকূটের খাদ্য তালিকায় আছে পানির তলার উদ্ভিদ-গুল্মের কচি অংশ, ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙ ও জলজ পোকামাকড়। ডাঙায় উঠেও এরা হাঁটতে পারে স্বচ্ছন্দে। সুযোগ পেলে ধানও খায়।
বাসা বাঁধার জন্য এরা পছন্দ করে বড়সড় হাওর-বাওড়ের বা মরা নদীর (যে নদীর ভেতরে জন্মেছে জলজ উদ্ভিদ-গুল্ম শেওলা ও স্রোত নেই) জলজ উদ্ভিদ-গুল্ম বা ঘাসবন। জলের পাশের ঝোপ-ঝাড়ের ওপরে বা মাটিতে বাসা করে। দুই জনে মিলেই বাসা সাজায়। ডিম পাড়ে ৯টি। বাফরঙা ডিম, তাতে বাদামি ছিটছোপ থাকে। ৭ ও ৮টি ডিমের সংখ্যাই বেশি। আবার ৫/৬টিও হয়। দুই জনে পালা করে ডিমে তা দেয়। ২০/২২ দিনে বাচ্চা ফোটে। বাচ্চারা উড়তে পারে ২৫-২৮ দিনে। তবে জন্মের ১/২ দিনের ভেতরই তারা বাসা থেকে জলে নেমে পড়ে এবং মা-বাবার পেছনে পেছনে ঘোরে ও ওদের পিঠেও চড়ে সুযোগ পেলে। বাচ্চাগুলো খুব চঞ্চল।
বছরের অন্যান্য সময় কালকূটকে তেমন দেখা না গেলেও শীতকালে দেখা যায় প্রচুর। আমার মনে হয়, আশপাশের দেশ থেকে আসা কালকূটদের সঙ্গে আমাদের দেশের দুই চারটা কালকূট মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আমার আরও মনে হয়েছে, খুব কম সংখ্যক কালকূট আমাদের দেশে আছে বা থেকে যায়। ওরাই এদেশে ডিম-বাচ্চা তোলে।
একথা আমি জোরের সঙ্গে বলতে চাইছি যে, কিশোরবেলায় কমপক্ষে আমি ৪ বার কালকূটের বাসা দেখেছি। একবার দেখেছিলাম ওই জোড়ার বিলে। ডিমে তা দেওয়া অবস্থায় একটি পাখিকে গুলি করে মারা হয়েছিল, ৭টি ডিম বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। ভাজতে গিয়ে দেখা গেল সবগুলোর ভেতরই রক্ত জমাট বেঁধেছে, খাওয়ার উপযোগী নয়।
সেই জোড়ার বিল এখন মরে গেছে একেবারে। আজ আর পাখি নামে না। নেই একটি জলপিপি বা ডুবুরিও। এভাবেই বিল-ঝিল-জলাশয়, হাওর- বাওড় মরে যাচ্ছে আমাদের দেশে। পাশাপাশি বাড়ছে শিকারির সংখ্যা। জলের পাখিরা তাই আবাসভূমির পাশাপাশি চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কোথাও শান্তি নেই। দুদণ্ড সুস্থ হয়ে বসার জো নেই। বাসা বাঁধার জায়গার অভাবও প্রকট। পাশাপাশি খাদ্যসঙ্কট। দেশীয় জলের পাখিরা তাই চরম সংকটে আছে। শীতকালে বাংলাদেশের বহু হাটবাজার ও শহর-বন্দরে দেশি-বিদেশি জলের পাখি বিক্রি হয়। আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এটা। সেই অপরাধই করছে অনেকে। আমাদের সবারই সচেতন হওয়া উচিত। সব ধরনের পাখিকে রক্ষা করা জরুরি। কেননা, পাখিরা শুধু প্রকৃতির উড়ন্ত-দুরন্ত সুন্দরই নয়, নয় শুধু প্রকৃতির শোভা, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় ওদের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা। সুন্দর কালোপাখি কালকূটকেও শীতকালে হাটবাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়। দেশের আইনে এটা নিষিদ্ধ। আইনের পক্ষে কি দাঁড়াতে পারি না আমরা সবাই?