ডেঙ্গুর ইতিবৃত্ত

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে আবির্ভূত হয় এবং দ্বাদশ শতাব্দীর পরে মানুষে প্রথম সংক্রমণ ঘটা ডেঙ্গি ভাইরাসের। আজ ঘরে ঘরে এতটাই পরিচিত যে নিজেদের মতো করে একটা নাম দিয়েছি—ডেঙ্গু। আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষায় কা-ডিংগা পেপো (অর্থাৎ অশুভ আত্মার অভিশাপ) থেকে এসেছে রোগটির নাম। এডিস মশাবাহিত এ জীবাণুর সাম্প্রতিক প্রকোপের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মতো বহুমাত্রিক কারণ রয়েছে। এসব নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে বিস্তর, তবে ডেঙ্গু কীভাবে মানবদেহে এত মারাত্মক হয়ে উঠছে, তার ভেতরের কার্যকারণ জনমানসের আড়ালে রয়ে যাচ্ছে—এ লেখায় সেদিকটা তুলে ধরা হলো।

ডেঙ্গু ভাইরাস কী দিয়ে তৈরি?

যেকোনো ভাইরাস আসলে প্রোটিনে তৈরি প্যাকেটে রাখা কিছুটা নিউক্লিয়িক অ্যাসিড ছাড়া আর কিছু নয়। বাইরের ওই প্যাকেটটিকে বলে ক্যাপসিড। ভেতরের নিউক্লিয়িক অ্যাসিড হলো ভাইরাসের জিনোম। সেটি হয় ডিএনএ, নয়তো আরএনএ হবে—দুই রকম একসঙ্গে থাকে এমন ভাইরাস এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কোনো কোনো ভাইরাসে ক্যাপসিডের বাইরেও আর একটি আবরণ থাকে, যার নাম এনভেলোপ। এটি ফসফোলিপিড, প্রোটিন ও গ্লাইকোপ্রোটিন ইত্যাদি দিয়ে গঠিত। এগুলো কোষঝিল্লির উপকরণ। তাই বলে ভাইরাস কোষ নয়। এনভেলোপ মূলত সেই কোষের থেকে চুরি করে নিয়ে আসা অংশ, যার ভেতরে ভাইরাসটি এর আগে বংশবৃদ্ধি করেছে। ডেঙ্গু ভাইরাস একপ্রকার আরএনএ ভাইরাস, অর্থাৎ ক্যাপসিডের ভেতরে শুধু আরএনএ আছে।

একই প্রজাতির সদস্য হলেও সব মানুষ যেমন এক রকম নয়, সব ডেঙ্গু ভাইরাসও এক রকম নয়। তাদের জিনোমে আরএনএ সংকেতের তারতম্যের কারণে প্রোটিনের গঠনে পার্থক্য দেখা যায়। এ কারণে একই ভাইরাসের একেকটি প্রকরণের সঙ্গে দেহের সুরক্ষাব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ার সূক্ষ্ম কিন্তু উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হয়। এ পার্থক্যের ভিত্তিতে ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি সেরোটাইপ DENV1, DENV2, DENV3 ও DENV4 নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও সূক্ষ্ম পার্থক্যের ভিত্তিতে প্রতিটি সেরোটাইপের অন্তর্ভুক্ত একাধিক স্ট্রেইন নির্ণয় করা হয়েছে। তবে এ আলোচনায় ততটা না জানলেও চলবে। অন্য সব জীবের মতো ভাইরাসও পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে ডেঙ্গুর পঞ্চম সেরোটাইপ DENV5। এর সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য খুবই অপর্যাপ্ত।

আরও পড়ুন

ডেঙ্গু ভাইরাস কীভাবে বংশবৃদ্ধি করে?

পরিণত ডেঙ্গু ভাইরাসের এনভেলোপে থাকা ই এবং এম প্রোটিন এসব কোষে তার প্রবেশে সহায়তা করে
ছবি: দীপু মালাকার

যেকোনো জীবের বংশবৃদ্ধি করতে হলে প্রোটিন তৈরি করতে হয়। প্রোটিন তৈরি করতে হলে দরকার কাঁচামাল হিসেবে অ্যামিনো অ্যাসিড, নির্দেশনা বা নকশা হিসেবে জিনোম, নকশাটি বাস্তবায়ন করার কারখানা হিসেবে রাইবোজোম এবং কারখানার কর্মী হিসেবে বিভিন্ন প্রকার অ্যানজাইম ও বিশেষ আরএনএ। এগুলোর মধ্যে ভাইরাসের শুধু জিনোম আছে আর কিছু নেই। তাই বংশবৃদ্ধি করতে হলে সে কোনো একটি কোষের ভেতর ঢুকে সেই কোষের অ্যামিনো অ্যাসিড, রাইবোজোম ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজের জিনোমের নকশামাফিক প্রোটিন বানায়। এরপর সেগুলোকে জোড়াতালি দিয়ে ভাইরাসকুলের নতুন সদস্যরা জন্মায়। ডেঙ্গু ভাইরাসও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে যেকোনো ভাইরাস চাইলেই যেকোনো কোষে ঢুকে পড়তে পারে না। ভাইরাসের এনভেলোপ (কিংবা তা না থাকলে ক্যাপসিড) এমন কিছু প্রোটিন ধারণ করে, যা একপ্রকারের চাবি হিসেবে কাজ করে। আর কোষের ঝিল্লির বাইরের দিকেও থাকে বিভিন্ন প্রকারের প্রোটিন। সেগুলো কাজ করে তালা হিসেবে। যে চাবির সঙ্গে যে তালা খাপ খায়, সেই চাবি দিয়ে তো সেই তালাই খুলবে, অন্য তালা নয়। কোনো ভাইরাসের বাইরের স্তরের প্রোটিন যে কোষের বাইরের দিকের প্রোটিনের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে বন্ধন তৈরি করতে পারে, সেই কোষ হলো সেই ভাইরাসের টার্গেট। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে টার্গেট কোষ হলো আমাদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনোসাইট, ম্যাক্রোফেজ ও ডেনড্রাইটিক কোষ।

কোনো একটি বিশেষ অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর মতো প্রোটিন তৈরি হয় মাত্র গুটিকতক (10-1000) লিম্ফোসাইটের মধ্যে। বি-লিম্ফোসাইট ও টি-লিম্ফোসাইটের ক্ষেত্রে সেই প্রোটিনকে যথাক্রমে অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল রিসেপ্টর (TCR) বলে।

পরিণত ডেঙ্গু ভাইরাসের এনভেলোপে থাকা ই এবং এম প্রোটিন এসব কোষে তার প্রবেশে সহায়তা করে। উল্লেখ্য, অপরিণত ভাইরাসের বেলায় এম প্রোটিনের জায়গায় তার বিকৃত রূপ প্রি-এম প্রোটিন থাকে। কোষের ভেতরে ভাইরাস যখন বংশবৃদ্ধি করতে থাকে, তখন এমন কিছু প্রোটিন তৈরি হয়, যেগুলো শেষ পর্যন্ত ভাইরাসের কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। তবে সেগুলো ছাড়া ভাইরাস বানানোও যায় না। অনেকটা ছাদ ঢালাই দেওয়ার সময় ব্যবহৃত কাঠের পাটাতনগুলোর মতো। সেগুলো ঢালাই জমে যাওয়ার পর খুলে ফেলা হয়। এসব প্রোটিনকে বলে নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিন বা সংক্ষেপে এনএস। ডেঙ্গু ভাইরাসের এ রকম সাতটি এনএস থাকে (১ থেকে ৭) যার মধ্যে এনএস১ সবচেয়ে নিশ্চয়তার সঙ্গে শনাক্ত করা যায় বলে জ্বরের প্রথম দিন থেকে এটি রোগনির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুন

দেহ কীভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করে?

রোগজীবাণু কিংবা ক্ষতিকারক জিনিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দেহে দুই ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা (immune system) রয়েছে—সহজাত (innate) ও অভিযোজনমূলক/অর্জিত (adaptive/acquired)। সহজাত সুরক্ষা অনেকটা মোটা দাগের ব্যবস্থা। সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিটি হুমকির মোকাবিলা আলাদা উপায়ে না করে সেটা অনেকটা একই ধাঁচে কাজ করতে থাকে। যেমন: একটা নির্দিষ্ট আকারের থেকে বড় এবং ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত গৎবাঁধা নকশাওয়ালা কোনো অণু বা অণুসমষ্টি পেলেই ডেনড্রাইটিক কোষ তা কোষভক্ষণ (phagocytosis) প্রক্রিয়ায় খেয়ে হজম করে ফেলে। সেই বস্তুটি আসলে কিসের এবং কী ধরনের ঝুঁকি তার থাকতে পারে অথবা আদৌ সেটা খাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না কিংবা কীভাবে তা ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায়, এত সব বাছবিচার করে না।

কোনো কোনো ভাইরাসে ক্যাপসিডের বাইরেও আর একটি আবরণ থাকে, যার নাম এনভেলোপ। এটি ফসফোলিপিড, প্রোটিন ও গ্লাইকোপ্রোটিন ইত্যাদি দিয়ে গঠিত। এগুলো কোষঝিল্লির উপকরণ। তাই বলে ভাইরাস কোষ নয়।

অন্যদিকে ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকির জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশেষায়িত সমাধান দেয় অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা। প্রায় ৪০ কোটি বছর আগে কনড্রিকথিস শ্রেণিভুক্ত (অর্থাৎ হাঙর প্রভৃতি চোয়ালবিশিষ্ট তরুণাস্থিময় মাছ) জীবে প্রথম উদ্ভূত এই ব্যবস্থা কিন্তু আগে থেকে থাকা সহজাত সুরক্ষাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। যেমন: ডেনড্রাইটিক কোষ যখন কোনো কিছু খেয়ে হজম করে, এরপর সেই জিনিসের ছোট ছোট টুকরো (antigen) তার নিজের কোষঝিল্লির বাইরের দিকে লাগিয়ে রেখে একরকমের প্রদর্শনী করতে থাকে। একে বলে অ্যান্টিজেন উপস্থাপন (antigen presentation)। অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত কোনো কোষ যেমন: লিম্ফোসাইট সেই উপস্থাপিত টুকরোটির সঙ্গে নিজের কোষঝিল্লির বিশেষ প্রোটিনের সংযোগ স্থাপন করতে পারলে উদ্দীপ্ত হয় এবং সুনির্দিষ্টভাবে সেই টুকরোটির আসল বাহকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ শুরু করতে পারে। আমাদের দেহের অর্জিত সুরক্ষাব্যবস্থা এ রকম প্রায় ১০ লাখ থেকে এক কোটি (107–108) ধরনের ভিন্ন ভিন্ন অ্যান্টিজেন আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে এবং সেগুলোর প্রতিটির বিরুদ্ধে পৃথকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রত্যেক প্রকার অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সংযোগ স্থাপন করতে হলে কমপক্ষে তত প্রকার প্রোটিন দরকার। আর প্রত্যেক প্রকার প্রোটিন তৈরির সংকেত দেওয়ার জন্য কমপক্ষে একটি করে জিন দরকার। কিন্তু মানুষের জিনের সংখ্যা তো সাকুল্যে কুড়ি হাজারের মতো!

আরও পড়ুন

এ সমস্যার সমাধান বের করে ১৯৮৭ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পান জাপানের সুসুমু তোনেগাওয়া। তিনি দেখান, গুটিকতক জিন নিজেদের মধ্যে বিন্যাস-সমাবেশ ঘটিয়ে লাখো-কোটি ধরনের ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন তৈরির সংকেত দিতে পারে। অর্জিত সুরক্ষার অন্যতম কোষ লিম্ফোসাইটগুলো। যখন জন্মায়, তখন সেগুলোর মধ্যে উল্লিখিত জিনগুলোর ওলট-পালট ঘটে অনেকটা র৵ান্ডম বা দৈবচয়ন ভিত্তিতে। তাই কোনো একটি বিশেষ অ্যান্টিজেনের সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর মতো প্রোটিন তৈরি হয় মাত্র গুটিকতক (10-1000) লিম্ফোসাইটের মধ্যে। বি-লিম্ফোসাইট ও টি-লিম্ফোসাইটের ক্ষেত্রে সেই প্রোটিনকে যথাক্রমে অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল রিসেপ্টর (TCR) বলে। এ রকম হতে পারে যে হয়তো সেই অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে জীবনে কখনোই আসা হলো না কিংবা প্রকৃতিতে হয়তো সেই অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার মতো অ্যান্টিজেনই নেই। কিন্তু যদি এমন কোনো অ্যান্টিজেন দেহে ঢোকে, যেটা লিম্ফোসাইটের সিলেবাসে ‘কমন’ পড়েছে? অর্থাৎ লক্ষাধিক প্রকারের অ্যান্টিবডি বা টিসিআরের মধ্যে কোনো একটির সঙ্গে তা সুনির্দিষ্টভাবে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাহলে সেই বিশেষ প্রোটিন ধারণকারী গুটিকতক লিম্ফোসাইট সাঁই সাঁই করে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলে। এরপর ওই অ্যান্টিজেন ও তার বাহককে আক্রমণ করতে থাকে।

প্রথমবারে লিম্ফোসাইটগুলো উদ্দীপ্ত হতে ও সংখ্যাবৃদ্ধি করতে যতটা সময় নেয়, দ্বিতীয়বার সয়ম নেয় অর্ধেকেরও কম। এই সময়ের মধ্যে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে এই পূর্বপ্রস্তুতির কারণে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের ক্ষেত্রে আক্রমণ বলতে বোঝানো হচ্ছে মূলত দুটি বিষয়। প্রথমত, ডেঙ্গু ভাইরাসের ই এবং প্রি-এম প্রোটিনের সঙ্গে আটকে যেতে পারে, এমন অ্যান্টিবডি দিয়ে ভাইরাসটিকে রীতিমতো চারপাশ থেকে আবৃত করে ফেলা যেতে পারে। ফলে সেটা নতুন করে কোনো কোষে ঢুকতে না পারে। কেননা, ওই প্রোটিনগুলোই তো ভাইরাসের কোষে ঢোকার চাবি। সেই চাবির আকৃতি পাল্টে গেলে তা আর কাজ করবে না। দ্বিতীয়ত, এনএস১ অ্যান্টিজেন উপস্থাপনকারী কোষগুলোর সঙ্গে টি-লিম্ফোসাইটের উপযুক্ত টিসিআর আটকে দিয়ে সেই কোষটিকে ধ্বংস করে ফেলা। কেননা, এনএস১–বাহী কোষটির পেটের ভেতর নিশ্চয়ই ডেঙ্গু ভাইরাস কিলবিল করছে। নইলে এনএস১ আসবে কোত্থেকে! এ জন্যই ডেঙ্গু জ্বরের তিন থেকে চার দিন পর থেকে এটা রক্ত পরীক্ষায় আর শনাক্ত করা যায় না। কেননা, এনএস১বাহী কোষগুলো এর মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়।

আরও পড়ুন

ডেঙ্গু কীভাবে সুরক্ষাব্যবস্থাকে বোকা বানায়?

মশা
প্রতীকী ছবি

প্রাথমিকভাবে কোনো অ্যান্টিজেনকে প্রতিহত করা সম্ভব হলে পরে দেখা যায় শরীরে সেই অ্যান্টিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করতে সক্ষম বেশ কিছু লিম্ফোসাইটের রয়ে গেছে। সেগুলো একই অ্যান্টিজেন দিয়ে পরবর্তী সময়ে শরীর আবারও আক্রান্ত হলে বেশ দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে পারে। সেগুলোকে বলে মেমোরি সেল। প্রথমবারে লিম্ফোসাইটগুলো উদ্দীপ্ত হতে ও সংখ্যাবৃদ্ধি করতে যতটা সময় নেয়, দ্বিতীয়বার সয়ম নেয় অর্ধেকেরও কম। এই সময়ের মধ্যে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে এই পূর্বপ্রস্তুতির কারণে। এ জন্য প্রথমবার ডেঙ্গু সংক্রমণের ক্ষেত্রে তার যেকোনো সেরোটাইপের জন্য নির্ধারিত আইজিজি ও আইজিএম অ্যান্টিবডিগুলো পরীক্ষায় ধরা পড়তে অন্তত পাঁচ-ছয় দিন সময় লাগে। তবে দ্বিতীয়বার সংক্রমণের বেলায় তা একেবারে প্রথম বা দ্বিতীয় দিন থেকেই পজিটিভ আসতে পারে, বিশেষ করে আইজিজি।

দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত কেউ যদি প্রথমবারের মতো একই সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হয়, তাহলে তো খুবই ভালো। কারণ, দ্বিতীয়বারে তার খুব একটা ভুগতে হবে না। আগে থেকে জমে থাকা মেমোরি সেলগুলো প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করে খুব সহজে ডেঙ্গুকে কাবু করে ফেলবে। যেমন কেউ প্রথমবার DENV2 দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল এবং পরের বারও DENV2 দিয়ে আক্রান্ত হলো। প্রথমবার তাকে হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয়বার সে হয়তো অসুখটা বুঝতেও পারবে না। কিন্তু প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বারের সেরোটাইপ আলাদা হলে এবং দুটি সংক্রমণের মধ্যে তফাত হয় তিন মাসের বেশি হলে বিপদ আছে! সে ক্ষেত্রেও মেমোরি সেলগুলো প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরি করে ঠিকই, তবে তা ডেঙ্গু ভাইরাসের সঙ্গে পর্যাপ্ত বন্ধন তৈরি করতে পারে না। কোনো অ্যান্টিবডি তার নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেনের যে অংশে দৃঢ়ভাবে আটকে যেতে পারে, সেই অংশটিকে বলে এপিটোপ। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ডেঙ্গু ভাইরাসের ই প্রোটিনের অন্তত ৩০টি এপিটোপে যদি অ্যান্টিবডি আটকে যেতে পারে, তখনই কেবল ভাইরাসটি নতুন করে আর কোনো কোষে সংক্রমণ ঘটাতে পারে না। কিন্তু একটি সেরোটাইপের জন্য নির্ধারিত অ্যান্টিবডি অন্য একটি সেরোটাইপের ই প্রোটিনের এতগুলো এপিটোপ দখল করতে পারে না।

যে কারও প্রথমবার সংক্রমণেই রক্তক্ষরণ শুরু হলো কিংবা রক্তনালি থেকে পানি হারিয়ে শকে চলে গেলেন। কেউ আবার দ্বিতীয়বার ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পরও দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন। এ রকম পার্থক্যের কারণগুলো এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি।

এতে হিতে বিপরীত হয়; কারণ অ্যান্টিবডির যে দিকটি এপিটোপে লেগে থাকে, তার বিপরীত দিকটি এ ক্ষেত্রে মনোসাইট, ম্যাক্রোফেজ ও ডেনড্রাইটিক কোষে ঢোকার চাবি হিসেবে কাজ করে। এগুলো ডেঙ্গু ভাইরাসের টার্গেট কোষ! কোনো অ্যান্টিবডি ডেঙ্গু ভাইরাসের সঙ্গে গিয়ে না লাগলে এমনিতে যতগুলো ভাইরাস কোষে ঢুকতে পারত, ভিন্ন সেরোটাইপের অ্যান্টিবডির এমন অপর্যাপ্ত বন্ধনের দরুণ তার চেয়ে অনেক বেশি ভাইরাস এখন কোষে ঢুকে পড়ে। একে বলে অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহান্সমেন্ট বা সংক্ষেপে এডিই। এটা ডেঙ্গু ছাড়াও জিকা, ইয়েলো ফিভার, এইচআইভি ইত্যাদি ভাইরাসের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। তা ছাড়া পরিবর্তিত সেরোটাইপের জন্য নতুন করে সুনির্দিষ্ট ও সঠিক প্রকারের লিম্ফোসাইট আর উদ্দীপ্ত হয় না। কারণ, বেশি মেমোরি সেল থাকায় সুরক্ষাব্যবস্থা ‘অপচয়’ রোধ করার জন্য তা হতে দেয় না। অর্থাৎ দেহ বোকা বনে যায়। সেভাবে যে সুরক্ষাব্যবস্থা খুব ভালো সুরক্ষা দিচ্ছে অথচ বাস্তবে ঘটনা ঠিক উল্টো। কোষের ভেতরে ও বাইরে ডেঙ্গু ভাইরাস গিজগিজ করছে। সেগুলোকে প্রতিহত করার জন্য সুরক্ষাব্যবস্থার কোষগুলো থেকে সাইটোকাইন নামক একজাতীয় রাসায়নিক নিঃসৃত হচ্ছে ক্রমাগত। তাতে ভাইরাসের খুব একটা কিছু হচ্ছে না। তবে সেগুলোর প্রভাবে রোগী তার রক্তনালি থেকে পানি হারাচ্ছে, প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং কখনো কখনো প্রাণও হারাচ্ছে।

আরও পড়ুন

সবার কেন একই দুরবস্থা হয় না?

প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে কেন মারাত্মক পরিণতি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, তা ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা গেছে নিশ্চয়ই। গত কয়েক বছরে প্রায় সবাই (বিশেষ করে ঢাকায়) অন্তত একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকেরই তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তাই এবারের সংক্রমণ বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই নম্বর সংক্রমণ। এটিও ডেঙ্গুর এবারকার মাত্রাতিরিক্ত তীব্রতার একটা কারণ হতে পারে। তবে এমনও তো হয় যে কারও প্রথমবার সংক্রমণেই রক্তক্ষরণ শুরু হলো কিংবা রক্তনালি থেকে পানি হারিয়ে শকে চলে গেলেন। কেউ আবার দ্বিতীয়বার ভিন্ন সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পরও দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন। এ রকম পার্থক্যের কারণগুলো এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে জিনগত পার্থক্য এর জন্য দায়ী হতে পারে বলে গবেষণায় বলছে। তা ছাড়া সেরোটাইপ ভেদে রোগের লক্ষণের তীব্রতার পার্থক্য দেখা যায়। সেরোটাইপ পরীক্ষার জন্য আরএনএ-ভিত্তিক পিসিআর করতে হয়, যা তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল এবং বাংলাদেশের দু-চারটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোথাও হয় না। তা ছাড়া তেমন কোনো লক্ষণ ছাড়াই হঠাৎ করে ডেঙ্গুরোগীর হৃৎপেশি আক্রান্ত হওয়ার (myocarditis) মতো অদ্ভুত ব্যাপারগুলোর পেছনে কী কারণ রয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে।

আরও পড়ুন
ডেঙ্গুর টিকা তৈরির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সব কটি সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি যদি একই সঙ্গে কার্যকর করা না যায়, তাহলে এডিইর কারণে রোগীর রোগ প্রতিরোধের বদলে উল্টো বেশি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।

ডেঙ্গুর কোনো টিকা আছে?

ব্যাকটেরিয়ার জন্য যেমন আছে বহুসংখ্যক অ্যান্টিবায়োটিক, তেমনি ভাইরাসজনিত অসুখের সুনির্দিষ্ট ওষুধ খুব কমই আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টিকাই ভাইরাসের বিরুদ্ধে একমাত্র ভরসা। টিকা সাধারণত কাজ করে সুরক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে, যাতে ওই বিশেষ জীবাণুর সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে সংযুক্ত হতে পারে, এমন অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিংবা টিকা হিসেবে অনেক সময় সরাসরি সেই অ্যান্টিবডি অণুগুলো শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ডেঙ্গুর টিকা তৈরির ক্ষেত্রে একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সব কটি সেরোটাইপের অ্যান্টিবডি যদি একই সঙ্গে কার্যকর করা না যায়, তাহলে এডিইর কারণে রোগীর রোগ প্রতিরোধের বদলে উল্টো বেশি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। এ জন্য ডেঙ্গাভেক্সিয়া নামে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এফডিএ অনুমোদিত একটিই টিকা বাজারে আছে, যেটি একই সঙ্গে চারটি সেরোটাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এটি ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাদের আগে একবার ডেঙ্গু হয়েছে। দুঃখের বিষয়, এ টিকা মাত্র ২০টি দেশে পাওয়া যায়, যে তালিকায় বাংলাদেশ নেই।

লেখক: চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত