উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য সূর্যালোক অপরিহার্য—কথাটা নিশ্চয়ই সবার জানা। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ সূর্যালোকের সাহায্যে খাদ্য তৈরি করে। কিন্তু সূর্যালোক ছাড়াই যদি বেড়ে উঠতে পারে উদ্ভিদ, কেমন হবে? হ্যাঁ, সেটা সত্যিই সম্ভব। এ জন্য ফোটন নয়, ব্যবহৃত হবে বিদ্যুৎ!
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এই কাজে সফল হয়েছেন একদল বিজ্ঞানী। তাঁরা এমন এক কৃষি প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন, যা প্রচলিত কৃষির ধারণা সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে। এই প্রযুক্তির নাম ইলেকট্রো-এগ্রিকালচার, সংক্ষেপে ইলেকট্রো-এজি। বাংলায়, বৈদ্যুতিক-কৃষি। গবেষকেরা কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ইলেকট্রোলাইসিস বা তড়িৎ-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অ্যাসিটেটে রূপান্তর করে তা উদ্ভিদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার উপায় বের করেছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান জার্নাল জুল-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রযুক্তি খাদ্য উৎপাদনে বিপ্লব আনতে পারে। এতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির ব্যবহার কমবে, কমবে পানির অপচয় এবং যেখানে চাষাবাদ অসম্ভব, সেখানেও চাষাবাদ করা যাবে।
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ সূর্যালোকের মাত্র ১ শতাংশ শক্তি খাদ্যে রূপান্তর করতে পারে। কিন্তু নতুন এই পদ্ধতিতে উদ্ভিদ খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে আরও ৪ গুণ বেশি। কিন্তু জিনিসটা কাজ করে কীভাবে?
সূর্যালোকের তুলনায় এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর। গবেষণায় বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সম্পূর্ণভাবে ইলেকট্রো-এগ্রিকালচার পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে, তাহলে দেশটির কৃষি জমির প্রয়োজনীয়তা ৮৮ ভাগ কমে যাবে।
গবেষকেরা প্রথমে বিদ্যুতের সাহায্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে কার্বন মনোক্সাইডে রূপান্তর করেন। তারপর রূপান্তর করেন অ্যাসিটেটে। উদ্ভিদ ও ছত্রাক এই অ্যাসিটেট শোষণ করে এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় জৈব উপাদান, যেমন চিনি ও অ্যামিনো অ্যাসিড উৎপাদন করে। ফলে সূর্যালোকের সাহায্য ছাড়াই বাড়তে পারে উদ্ভিদ।
এই প্রযুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গবেষকেরা ভার্টিক্যাল ফার্মিং মডেল ব্যবহার করছেন। এতে ভবনের ছাদে বসানো হয় সৌর প্যানেল। সেখান থেকে পাওয়া বিদ্যুতের সাহায্যে চালানো হয় ইলেকট্রোলাইসিস। এই সবকিছু হয় ওপরে। আর নিচের তলাগুলোতে স্তরে স্তরে সাজানো চেম্বারে ফসল জন্মানো হয়, যেখানে গাছপালা অ্যাসিটেট শোষণ করে বাড়তে থাকে। এখন পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে সফলভাবে ছত্রাক, ইস্ট এবং শৈবাল চাষ করেছেন বিজ্ঞানীরা। ইতিমধ্যেই তারা টমেটো, লেটুস এবং অন্যান্য ছোটখাটো ফসলের ওপর পরীক্ষাও শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে গম ও মিষ্টি আলুর মতো প্রধান খাদ্যশস্যও চাষের উপযোগী করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
গবেষকদের দাবি, সূর্যালোকের তুলনায় এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর। গবেষণায় বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি সম্পূর্ণভাবে ইলেকট্রো-এগ্রিকালচার পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে, তাহলে দেশটির কৃষি জমির প্রয়োজনীয়তা ৮৮ ভাগ কমে যাবে। ফলে বিপুল পরিমাণ জমি বনাঞ্চলে রূপান্তর করা সম্ভব হবে। এই বনাঞ্চল কাজে লাগবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে। বলা বাহুল্য, এ ক্ষেত্রে বনাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষকেরা কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ইলেকট্রোলাইসিস বা তড়িৎ-বিশ্লেষণের মাধ্যমে অ্যাসিটেটে রূপান্তর করে তা উদ্ভিদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার উপায় বের করেছেন।
খাদ্য নিরাপত্তা একটা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন, সংঘাত এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এটা আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের মতে, ২০২৩ সালে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হয়েছে প্রায় ৭৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। এর সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে ইলেকট্রো-এগ্রিকালচার প্রকল্প। এর মাধ্যমে শহরাঞ্চলেও খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে ম্যাককেলভে স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এনার্জি, এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষক এবং এই পদ্ধতির প্রস্তাবক ফেং জিয়াও বলেন, ‘যেখানে প্রচলিত কৃষি অত্যন্ত কঠিন, আমরা আশা করছি, এই প্রযুক্তি সেসব অঞ্চলে কাজে আসবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক উর্বর ভূমি কৃষির অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই সংকট কাটানো সম্ভব। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে এ প্রযুক্তি।’
তবে অনেক বিজ্ঞানীই জিয়াওর সঙ্গে একমত নন। কর্নেল ইউনিভার্সিটির মাটি ও পানি বিশেষজ্ঞ হ্যারল্ড ভ্যান এস বলেন, ‘এটি কি সত্যিই কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারবে? নাকি এটি শুধু উদ্ভিদ জন্মানোর একটি নতুন পদ্ধতি?’ তাঁর মতে, প্রযুক্তিটি অত্যন্ত জটিল এবং খুব ব্যয়বহুল। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট সমাধানে এই প্রযুক্তি তেমন কাজে আসবে না।
হ্যারল্ডের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আসলেই এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে অনেক বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। গবেষকদের অনুমান, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে এই প্রযুক্তিতে খাদ্য সরবরাহ করতে গেলে ২০২৩ সালের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের পাঁচগুণ বেশি শক্তি লাগবে। নবায়নযোগ্য শক্তিতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা না হলে এই প্রযুক্তিকে বড় পরিসরে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া খরচও একটা বড় সমস্যা।
শুধু পৃথিবীতেই নয়, এই প্রযুক্তি মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রেও হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে ৯৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড রয়েছে, যা অ্যাসিটেট উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত হতে পারে।
ইলেকট্রো-এগ্রিকালচার পদ্ধতিতে উদ্ভিদ বেঁচে থাকে ঠিকই, কিন্তু এটি কিছু নতুন চ্যালেঞ্জও তৈরি করে। এত বিদ্যুৎ ও অর্থ খরচ করে আসলেই কি উদ্ভিদ বাঁচানোর দরকার আছে? যেখানে সূর্যের আলোর সাহায্যে বিনামূল্যেই কাজটা করা যায়।
এ ক্ষেত্রে একটা ‘কিন্তু’ আছে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী হচ্ছেন, কারণ, এই প্রযুক্তি সঠিকভাবে উন্নত করা গেলে ভবিষ্যতে কৃষি পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হতে পারে। শুধু পৃথিবীতেই নয়, এই প্রযুক্তি মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রেও হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে ৯৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড রয়েছে, যা অ্যাসিটেট উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা যদি এই প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে নভোচারীরা হয়তো মঙ্গলের মাটির নিচেই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে পারবেন।
এই প্রযুক্তি এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তবে গবেষকেরা আত্মবিশ্বাসী। জিয়াও বলেন, ‘এটি কেবল প্রথম ধাপ। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী দুই বছরের মধ্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখা যাবে।’