১৯৭২ সালে গর্ভবতী এক নারীর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে অদ্ভুত এক সমস্যা পেলেন চিকিত্সকেরা। তাঁরা আবিষ্কার করলেন, সেই সময়ে পরিচিত সব লোহিত রক্তকণিকায় যে পৃষ্ঠপ্রোটিন অণু পাওয়া যায়, রহস্যজনকভাবে তা এই নমুনায় নেই। প্রায় ৫০ বছর পরে এই অদ্ভুত অণুটির অনুপস্থিতির রহস্য সমাধান করেছেন যুক্তরাজ্য ও ইসরায়েলের গবেষকেরা। এভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের রক্তের নতুন গ্রুপ!
আপনার মনে নিশ্চয়ই অনেক প্রশ্ন। কী এই গ্রুপ? পৃষ্ঠপ্রোটিন কী? এর অনুপস্থিতির সঙ্গে নতুন রক্তের গ্রুপের সম্পর্কই-বা কী! বলছি।
আমরা সবাই এ, বি, ও এবং এবি গ্রুপের রক্ত ও রেসাস ফ্যাক্টরের (প্লাস বা মাইনাস) সঙ্গে পরিচিত (এ ব্যাপারে জানতে পড়ুন: রক্তের গ্রুপ কি বদলে যেতে পারে)। এগুলো মূলত রক্তে বিশেষ ধরনের প্রোটিন ও সুগারের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। এর ওপর ভিত্তি করে রক্তের গ্রুপ ভিন্ন রকম হয়। এই প্রোটিন ও সুগার আমাদের লোহিত রক্তকণিকাকে ঢেকে রাখে। এই প্রোটিনগুলোকে বলতে পারেন পৃষ্ঠপ্রোটিন বা সারফেস প্রোটিন। শরীর এসব অ্যান্টিজেন (প্রোটিনের আরেক নাম) অণু ব্যবহার করে। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি এসব অণু সম্ভাব্য ক্ষতিকারক অণু থেকে নিজেদের আলাদাভাবে চিনতে পারে।
রক্ত সঞ্চালনের সময় যদি এই প্রোটিন ও সুগারের চিহ্নগুলো না মেলে, তবে এগুলোকে শরীর বহিরাগত ভেবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। স্বাভাবিক। কারণ, অপরিচিত প্রোটিনের কারণে মানুষের জীবনরক্ষার কৌশল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি হতে পারে জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি।
৯৯.৯ শতাংশের বেশি মানুষের রক্তে এএনডব্লিউজে নামে একধরনের অ্যান্টিজেন থাকে। এই অ্যান্টিজেন ১৯৭২ সালে পাওয়া গর্ভবতী সেই নারীর রক্তে অনুপস্থিত ছিল।
বেশির ভাগ রক্তের গ্রুপ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে শনাক্ত হয়েছিল। এর প্রায় ৫০ বছর পরে এসে সম্প্রতি ২০২২ সালে গবেষকেরা প্রথম ইআর (Er) নামে আরেকটি নতুন রক্তের গ্রুপের কথা জানিয়েছিলেন। এ রক্ত কেবল অল্প কিছু মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়। নতুন আবিষ্কৃত এ রক্তের গ্রুপ অবশ্য খুব বিরল।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের হেমাটোলজিস্ট লুইস টিলি ২০ বছর ধরে এ রক্তের গ্রুপ নিয়ে দলীয়ভাবে গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, ‘এটা বিশাল অর্জন। অনেক লম্বা সময় ধরে দলগত প্রচেষ্টার ফল এটি। এই নতুন রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার হওয়ায় বিরল এই রক্তধারী রোগীদের সেবা দিতে পারব আমরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার করা সহজ ছিল না। কারণ, এই জেনেটিক ঘটনা খুব বিরল।’
আগের গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ৯৯.৯ শতাংশের বেশি মানুষের রক্তে এএনডব্লিউজে (AnWj) নামে একধরনের অ্যান্টিজেন থাকে (এএনডাব্লিউজে পজিটিভ)। এই অ্যান্টিজেন ১৯৭২ সালে পাওয়া গর্ভবতী সেই নারীর রক্তে অনুপস্থিত ছিল। মেলিন ও লিম্ফোসাইট প্রোটিনের ওপর নির্ভর করে এই অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি। তাই গবেষকেরা নতুন খুঁজে পাওয়া এই রক্তের গ্রুপকে বলছেন এমএএল (MAL)। এটি খুঁজে পাওয়া রক্তের গ্রুপের মধ্যে ৪৪তম।
কারও রক্তে মেলিন এবং লিম্ফোসাইট—দুটি প্রোটিনের মিউটেশন বা রূপান্তরিত প্রতিলিপি থাকলে তাঁদের রক্তের গ্রুপ হয় এএনডাব্লিউজে নেগেটিভ (AnWj-negative)। টিলি এবং তাঁর দল এই বিরল রক্তের গ্রুপের তিনজন রোগীকে চিহ্নিত করেছেন, যাঁদের এই মিউটেশন ছিল না।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ডের কোষবিজ্ঞানী টিম স্যাচওয়েল। তিনি বলেছেন, ‘এমএএল হলো কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত খুব ছোট একটা প্রোটিন। এগুলোর কারণে রক্তের গ্রুপ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। অর্থাৎ, এই রক্তের গ্রুপ নির্দিষ্ট করার জন্য অনেকভাবে অনুসন্ধান করতে হয়েছে।’
গবেষণায় অংশ নেওয়া এএনডাব্লিউজে নেগেটিভ রোগীদের মধ্যে সবারই একই মিউটেশন দেখা গেছে। তবে এই মিউটেশনের সঙ্গে অন্য কোনো কোষের অস্বাভাবিকতা বা রোগের সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
রোগীদের রক্তে সঠিক জিন রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে এক দশক পরে গবেষকেরা রোগীদের রক্তের কোষে সাধারণ এমএএল জিন প্রবেশ করিয়েছিলেন। এটা ছিল এএনডাব্লিউজে নেগেটিভ। এ পরীক্ষা কাজ করেছে। কোষে এমএএল জিন এএনডাব্লিউজে অ্যান্টিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে।
এমএএল প্রোটিন কোষের ঝিল্লি স্থিতিশীল রাখে। আগের গবেষণায় দেখা গেছে, এএনডাব্লিউজে আসলে নবজাতক শিশুদের মধ্যে থাকে না। তবে জন্মের পরপর তৈরি হয়।
মজার বিষয় হলো, গবেষণায় অংশ নেওয়া এএনডাব্লিউজে নেগেটিভ রোগীদের মধ্যে সবারই একই মিউটেশন দেখা গেছে। তবে এই মিউটেশনের সঙ্গে অন্য কোনো কোষের অস্বাভাবিকতা বা রোগের সম্পর্ক পাওয়া যায়নি।
এখন গবেষকেরা এমএএল মিউটেশনের পেছনে জেনেটিক চিহ্ন শনাক্ত করছেন। রোগীদের নেগেটিভ এমএএল রক্তের গ্রুপ উত্তরাধিকার সূত্রে এসেছে কি না, তা জানার চেষ্টা করছেন। আবার রক্তের কোনো রোগ এই অ্যান্টিজেনকে দমন করছে কি না, তারও পরীক্ষা চলছে। এই গবেষণার সাহায্যে অন্য অনেক রোগের খোঁজও পাওয়া যেতে পারে।
বিরল এ রক্তের গ্রুপ রক্ত সঞ্চালনের সময় রোগীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এ গ্রুপ নিয়ে যত বেশি জানা যাবে, জীবন বাঁচবে তত বেশি।